• অ্যাশেজ
  • " />

     

    স্টিভ হার্মিসনঃ বাইশ গজ থেকে একশ' বিশে

    স্টিভ হার্মিসনঃ বাইশ গজ থেকে একশ' বিশে    

    লন্ডনের কেনিংটন থেকে নর্দাম্বারল্যান্ডের অ্যাশিংটনের দূরত্ব প্রায় ৩০০ মাইল। ২২ গজের ক্রিকেট উইকেট থেকে ১২০ গজের ফুটবল মাঠের প্রতীকী দূরত্বও বলতে পারেন। সড়কপথে মোটামুটি ছ’ ঘণ্টার রাস্তা। তা খেলার খবরে এতো হিসেব করে রাস্তা মাপা হচ্ছে কেন? যদি বলা হয় কেনিংটনের কিয়া ওভালে যখন সদ্যই অ্যাশেজ জেতা কুক বাহিনী উৎসবের আমেজে শেষ ম্যাচটা খেলছে তখন অ্যাশিংটনের ছোট্ট ফুটবল মাঠে মনোযোগী ছাত্রবেষ্টিত হয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণদুর্গ ভেদ করার ছক কষছেন মধ্যবয়সী এক কোচ? তাতেও যোগসূত্রটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না তো? এই কোচ ভদ্রলোক আর দশজন সাধারণ কোচের মতো হলে এতো হেঁয়ালির প্রয়োজন পড়ত না। ক্রিকেট-ফুটবল, ২২-১২০ গজ, মাইল-ঘণ্টা, অ্যাশেজ-অ্যাশিংটন সব জট পাকিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে কারণ ফুটবল মাঠের ওই মাঝবয়েসী কোচ বছর দশেক আগে ইংলিশদের দুই দশকের অ্যাশেজ-আক্ষেপ ঘোচানোর অন্যতম নায়ক, স্টিভ হার্মিসন! ক্রিকেটের অল্পবিস্তর খোঁজখবরও যারা রাখেন নামটা তাঁদের কাছে অপরিচিত ঠেকার কথা নয়।

     

     

    স্টিভ হার্মিসন (ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলঃ ২০০২-২০০৯)

     

    ২০০৫ সালে ঊনিশ বছর পর ইংলিশদের অ্যাশেজ জয়ে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, সাইমন জোন্সদের সাথে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবেক এই ডানহাতি পেসার। ১৪০+ কিলো গতির বলগুলো হয়তো অস্ট্রেলিয়ার সে দলের কোন ব্যাটসম্যানকে এখনও ঘুমের ঘোরে তাড়া করে ফেরে। লর্ডসে তো প্রথম টেস্টের প্রথম সকালেই ভয়ানক এক শর্ট বলে রিকি পন্টিংয়ের হেলমেটের ফাঁক গলে গাল কেটে রক্ত ঝরিয়েছিলেন। পরের ওভারেই পন্টিংকে সাজঘরে ফিরিয়ে ইনিংস শেষে ৫ উইকেট আর ম্যাচশেষে ঝুলিতে পুরেছিলেন ৮ উইকেট। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সে বছর উঠে এসেছিলেন উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার তালিকায়ও। কিন্তু পেস বোলারদের ক্যারিয়ারের চিরায়ত শত্রু ইনজুরি হার্মিসনকেও খুব লম্বা সময় মাঠে থাকতে দেয় নি। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর বছর চারেক আগেই খেলে ফেলেছিলেন শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি।

     

    এসবই গেল বাইশ গজের উইকেটে বল হাতে গতির ঝড় তোলার গল্প। কিন্তু বলের খেলা বলতে যারা মূলত ১২০ গজের মাঠে পায়ের কাজ বোঝেন তাঁদের ক’জন  স্টিভ হার্মিসনকে চেনেন? সংখ্যাটা যে খুব উল্লেখযোগ্য নয় তা বলাই বাহুল্য। তবে এতদিন না চিনলেও অনাগত ভবিষ্যতে ফুটবল অনুরাগীদের মুখে মুখেও যে ঘুরে ফিরতে পারে তাঁর নাম সেটা নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকি নেই! ৩৬ বছর বয়সী সাবেক এই ইংলিশ ক্রিকেটার সম্প্রতি ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছেন তারই শহরের ফুটবল ক্লাব অ্যাশিংটন এএফসিতে।

     

     

     

     

    নর্দার্ন লিগের প্রথম বিভাগের দলটি এবারের এফএ কাপের বাছাইপর্বে অংশ নিচ্ছে হার্মিসনের তালিমে। কিন্তু ক্রিকেটের মতো এখানে দেশ-দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেতে হার্মিসন ও তাঁর ফুটবল দলকে পাড়ি দিতে হবে লম্বা পথ। দুটোর ব্যবধান ছোট্ট একটা উদাহরণেই স্পষ্ট হবে। বছর দশেক আগের ওই ঐতিহাসিক অ্যাশেজ জয়ের পর ট্রাফালগার স্কয়ারে হার্মিসনদের অভ্যর্থনা জানাতে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। সংবর্ধনা মিলেছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর তরফেও। আর উডহর্ন লেনে অ্যাশিংটনের ঘরের মাঠে প্রতি ম্যাচে গড়ে দর্শক হয় সাকুল্যে দু’শোর মতো! মাঠটির নির্মাণাধীন গ্যালারির দর্শক ধারণ ক্ষমতাই কিনা আড়াইশ!

     

     

    অ্যাশিংটনের ঘরের মাঠ উডহর্ন লেন

     

    ইংলিশ ফুটবলের নবম স্তরের ক্লাবটিকে এফএ কাপের ‘প্রথম রাউন্ড প্রপার’-এর বাঁধা টপকাতে জিততে হবে আরও পাঁচটি ম্যাচ। তবে আশার কথা হচ্ছে হার্মিসনের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যেই এ আসরের প্রথম ম্যাচটি (এক্সট্রা প্রিলি. রাউন্ড) খেলে ফেলেছে অ্যাশিংটন এবং সেটিতে তাঁরা ৩-২ ব্যবধানে অ্যালবিওন স্পোর্টসকে হারিয়ে উঠে গেছে প্রিলিমিনারি রাউন্ডে। আগামী ২৯ আগস্ট এই পর্বের ম্যাচে হার্মিসনের ছেলেদের প্রতিপক্ষ থ্যাকলে এফসি।

     

    পেশাদার ক্রিকেটার থেকে একেবারে ফুটবল দলের কোচ! পরিবর্তনটা কি কখনও অবাস্তব মনে হয় না হার্মিসনের কাছে? জবাবটা ‘না’-সূচকই দিলেন সাবেক ক্রিকেট তারকা, “২০০৫ সালেও যদি কেউ আমাকে বলতো যে দশ বছর পর আমি অ্যাশিংটনের কোচ হব তাহলেও আমি অবাক হতাম না। এটা আমার নিজের শহরের ক্লাব। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার আগে আমি তাঁদের হয়ে খেলেছি। আমার বাবা এখানে খেলেছে, ভাই এখনও খেলছে। এমনকি আমি যখন ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলতাম তখনও অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে অ্যাশিংটনের খেলোয়াড়দের সাথে ঘাম ঝরাতাম ফিটনেস বাড়ানোর জন্য।”

     

    কেমন লাগছে নতুন দায়িত্ব? এ প্রশ্নের উত্তরও এলো কোন ভণিতা ছাড়াই, “কাজটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অপেশাদার খেলোয়াড়দের নিয়ে কিছু করতে পারছি বলে ভালো লাগছে। সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এফএ কাপের জন্য মুখিয়ে আছি।”

     

     

     

     

    যে শহরের ক্লাব নিয়ে হার্মিসনের এই চ্যালেঞ্জ-ভালোবাসা, সেই অ্যাশিংটন সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত জানা যাক। নিউক্যাসল থেকে ১৫ মাইল উত্তরে অবস্থিত নর্দাম্বারল্যান্ডের শহরটি থেকেই উঠে এসেছিলেন ইংল্যান্ডের একমাত্র বিশ্বকাপজয়ী দলের দুই ভাই ববি ও জ্যাক চার্লটন। এই শহরের জ্যাকি মিলবার্নও ইংরেজদের রাজকীয় জার্সি গায়ে তুলেছিলেন।

     

    ১৯২১ সালে সর্বপ্রথম ফুটবল লিগে খেলার অনুমতি পায় অ্যাশিংটন এএফসি। এ যাবতকালের উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলতে নর্দাম্বারল্যান্ড সিনিয়র কাপের গোটা দশেক শিরোপা আর কালেভদ্রে দুটো স্মৃতি টুর্নামেন্ট জয়। এফএ কাপে বলার মত সাফল্য খুঁজতে গেলে অবশ্য ফিরে যেতে হবে ১৯২৬-২৭ সালের দিকে। সেবারই এ টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ৩য় রাউন্ড পর্যন্ত গিয়েছিল ‘দ্য কুলিয়ার’রা।

     

    সংক্ষেপে এই যে দলের অবস্থা, সেটার কোচ হিসেবে একজন সাবেক জাতীয় ক্রিকেটারকে নিয়োগ দেয়ার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য খুঁজছেন অনেকেই। ক্লাবের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাংসদ ইয়ান ল্যাভেরি অবশ্য তেমনটা মানতে নারাজ, “অনেকেই বলছে স্টিভকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ক্লাবের পরিচিতি বাড়াতে। কিন্তু তা কেন হবে? আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। আর সেটা পূরণে যদি স্টিভের মত একজন তারকা ক্রীড়াবিদ পাওয়া যায় তবে আমরা সুযোগ হাতছাড়া করবো কেন?”

     

     

    ক্লাবের চেয়ারম্যান ইয়ান ল্যাভেরি (ডানে) ও অ্যাশিংটনের ছেলে আরেক ইংলিশ পেসার মার্ক উডের (মাঝে) সাথে স্টিভ হার্মিসন

     

     

    হার্মিসন নিজেও দায়িত্বটাকে ‘পাবলিসিটি স্টান্ট’ মানতে নারাজ, “শুরু থেকেই আমি বলে আসছি এটা তেমন কিছু নয়। যারা আমাকে চেনে তাঁরা জানে আমি এ ব্যাপারে কতোটা সিরিয়াস। এমনকি এই গ্রীষ্মে আমি কোচিং লাইসেন্সও করিয়ে নিতে চেয়েছিলাম।”

     

    তবে কি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই ফুটবল মাঠের ডাগআউটে আসা? এতোটা ‘সিরিয়াস’ অবশ্য এখনই হতে চাইছেন না স্টিভ, “আমি কি ফুটবল লিগ ম্যানেজার হতে চাই? আজ থেকে ১০ মাস বা ১০ বছর পরও কি আমি ম্যানেজারই থাকবো? সত্যি বলতে আমি জানি না। আমি কেবল এখন যেটা করছি সেটাই উপভোগ করতে চাইছি।”

     

     

     

     

    ইংল্যান্ডের অপরাধ বিষয়ক আইনে কাউকে আঘাতপূর্বক গুরুতর ক্ষতিসাধন করাকে ‘গ্রিয়েভাস বডিলি হার্ম’ বলে অভিহিত করা হয়। ২০০৪ সালের জ্যামাইকা টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ারসেরা ১২ রানে ৭ উইকেট দখলের পর ইংলিশ মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছিল ‘গ্রিয়েভাস বডিলি হার্মিসন’! পেস বোলারের সহজাত আগ্রাসন, তেজ কি এবার ফুটবল ম্যানেজারের মধ্যেও দেখা যাবে? না, ব্যাক্তি হার্মিসন তেমন নয় বলেই দাবী তাঁর, “আমি চায়ের কাপ ছুঁড়ে মারাদের দলে নই। ক্যারিয়ারজুড়ে ক্রিকেটের ড্রেসিংরুমে অসংখ্য চায়ের কাপ ছুঁড়ে মারতে দেখেছি। কিন্তু আমি হালকা, নির্ভার পরিবেশে থাকতে ভালোবাসি। চেঁচামেচি করে আপনি কিছু আদায় করতে পারবেন না। ভুল বুঝবেন না আবার! কেউ সীমালঙ্ঘন করলে তাঁকে এতোটুকু ছাড় দিই না।”

     

    শিষ্যদের সোহাগ-শাসনের ভারসাম্যটা যে গুরু হার্মিসন বেশ ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছেন সেটার প্রমাণ কিন্তু ইতোমধ্যেই মিলতে শুরু করেছে। ছ’মাস আগে যখন দলটার দায়িত্ব নেন তখন টানা ছ’ ম্যাচ হেরে নর্দার্ন লিগ টেবিলে অ্যাশিংটনের অবস্থান ১৭তম। নবম থেকে দশম স্তরে নেমে যাওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। অথচ স্টিভের তালিমে টানা সাত ম্যাচ জিতে কুলিয়াররা লিগ টেবিলে উঠে আসে ১৩ নম্বরে!

     

     

    হার্মিসনের সাথে অ্যাশিংটন এএফসির জার্সি গায়ে ইংল্যান্ডের আরেক সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ

     

     

    কাণ্ড দেখে তো ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন রসিকতার ছলে টুইটই করে বসেছেন, “হার্মিসনের এক বাউন্সে সাত ম্যাচ জেতার খবর শুনে মনে হচ্ছে নিউক্যাসল মালিকের কাছ থেকে ডাক এলো বলে!”