'সুপার' সাঙ্গা
১.
বারবার পড়া উপন্যাস। অসংখ্যবার দেখা কোনো সিনেমা। জানেন, এরপর কী ঘটতে চলেছে। কোন সংলাপটা আসবে। কোন দৃশ্যটা ভেসে উঠবে। সবই জানা। তবুও আপনি নতুন করে রোমাঞ্চিত হবেন। মনের অজান্তেই হেসে উঠবেন, কততমবারের মতো, তার ইয়ত্তা নেই। অথবা চোখে একটু ঝাপসা দেখবেন। বলে উঠবেন, ‘ধুর ছাই, চোখের কী হয়েছে!’
পরিচিত দৃশ্য, চেনা সুর বা জানা সংলাপের ক্ষমতা আছে, আপনাকে নতুন করে রোমাঞ্চিত করার। থাকে এমন। শেষ হয়ে গেলে একটা তৃপ্তি থাকবে। থাকবে আক্ষেপ। আরেকটু বেশী না পাওয়ার চিরকালীন আক্ষেপ!
২.
ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কা। পাহাড়ঘেরা শহর। একজন একগুঁয়ে বাবা। ছেলেকে ক্রিকেট শেখাতে ব্যস্ত যিনি। পেশায় আইনজীবি চোকশান্দা। হয়তো মক্কেল এসেছে, তিনি ব্যস্ত তখন ছেলেকে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ শট শেখাতে। হয়তো সকালে কোনো টেকনিক নিয়ে বাবা-ছেলেতে তুমুল মতপার্থক্য ঘটেছে। অথবা একটা টেকনিক শিখিয়েছেন কুমারকে। মাসের পর মাস ধরে। তারপর একদিন হঠাৎ করে এসে বলবেন, এর আগে যা যা বলেছিলেন, সব ভুলে যেতে। শুরু করতে হবে নতুন করে! বদলাতে হবে অনেক কিছু!
এই বদলে যাওয়ার শিক্ষাটা বাবার কাছেই পেয়েছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। যখন দলে আসেন, শ্রীলঙ্কা দলে তখন একঝাঁক বিশ্বজয়ী তারকা! যে মাহেলা সমবয়সী, তিনিও তখন দলের সহকারী অধিনায়ক! ক্যান্ডির পিচে ঘাস থাকতো, খানিকটা পেস বোলিং সহায়ক সব উইকেট। পেসে সমস্যা ছিল না খুব একটা সাঙ্গার। তবে ভড়কে যেতেন স্পিন খেলতে গিয়ে। মাহেলার মতো যারা কলম্বোতে বেড়ে উঠেছিলেন, তাঁরা কী অবলীলায় খেলতেন ‘ঘূর্ণি’ বল। আর সাঙ্গার যেন পা নড়তোই না!
শুরুর দিকের সিরিজগুলোতে সাঙ্গা রান পেয়েছিলেন মোটামুটি, তবে ছিলেন ভীষণ নড়বড়ে। প্রথম ফিফটি চতুর্থ টেস্টে, তিন অঙ্কের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৯ টেস্ট, আর ১৬ ইনিংস। তখন কে জানতো, এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান পরিবর্তিত হয়ে একদিন শুধু ব্যাটসম্যানে পরিনত হবেন, নামের পাশে থাকবে অনন্য সব রেকর্ড!
তখন কে জানতো, ব্যাট হাতের এই চলচ্চিত্রকার তৈরী করতে চলেছেন এক ‘মাস্টারপিস’! অথবা লিখতে চলেছেন এক ‘কালজয়ী’ উপন্যাস!
৩.
‘পরিবর্তনের’ শুরুটা হলো গ্রিপিং দিয়ে। মানে কুমার সাঙ্গাকারার হাত মকশো করা শুরু হলো আর কী!
অরভিন্দ ডি সিলভা একবার এসে বলেছিলেন, স্ট্রেইট ড্রাইভ খেলতে হলে গ্রিপিংটা বদলাতে হবে সাঙ্গার। সাঙ্গা করলেন। ফলটাও পেলেন। যে তিনি থার্ডম্যান বা কাভার বাদ দিয়ে উপরের দিকে খেলতে পারতেন না, তিনিই বোলারস ব্যাক ড্রাইভ করতে পারছেন!
শ্রীলঙ্কায় যখন ‘ন্যাচারাল ট্যালেন্ট’ এর ছড়াছড়ি, তখনই কুমার সাঙ্গাকারা বেছে নিলেন এক অন্যরকমের পথ। ‘বিবর্তনের’ ‘পরিবর্ধনের’ পথ। হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাটিংয়ের পরও ছন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। তারপরই ব্যাটে বলে হলো একটা বল! মনমতো। সাঙ্গা ছন্দ পেলেন। এই ছন্দই খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি। ব্যাটিংয়ের ছন্দ আনতেই ছেড়েছেন উইকেটকিপিং।
স্কুলের দলে সহজে সুযোগ পেতে যে ছেলেটা উইকেটকিপার হবে বলে হাত তুলেছিল, সেই জনই একসময় বনে গেল পুরোদস্তুর টেস্ট ব্যাটসম্যান! তারপর যে পরিবর্তন এলো, তা অভাবনীয়! উইকেটের পেছনের দায়িত্ব পালন করতেন যখন, তখন সাঙ্গার গড় ছিল ৪০.৪৮, সেঞ্চুরি ছিল সাতটি, সেই সাঙ্গারই গ্লাভস তুলে রাখার পর গড় দাঁড়ালো ৬৭.১৩, সঙ্গে সেঞ্চুরি ৩১টি!
শুধু এই বিবর্তন নয়, সাঙ্গা ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনেক চূড়ায়! শতাধিক টেস্ট খেলা ব্যাটসম্যানের মধ্যে তাঁর গড়ই সবচেয়ে বেশী, ৫৭.৫৯। ডাবল সেঞ্চুরির সংখ্যায় তাঁর (১১টি) উপরে শুধু স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (১২টি)। শুধু সেঞ্চুরিতে তিনি চতুর্থ অবস্থানে (৩৮টি), রানের দিক দিয়ে পঞ্চম। অবশ্যই শ্রীলঙ্কার মধ্যে রান, সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি সবকটিতেই তিনি এগিয়ে!
শ্রীলঙ্কা দলে প্রথম এসে ঠিক ছন্দ খুঁজে না পাওয়া সাঙ্গা ঠিকই ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। ক্যান্ডির সেই পাহাড়ঘেড়া পরিবেশ থেকে এসে ডিঙ্গেছেন আরও কতো পাহাড়! নাম লিখিয়েছেন ক্রিকেটের রেকর্ড-চূড়ায়!
আর হ্যাঁ, ক্রিকেটবিশ্ব দেখেছে এক চলচ্চিত্র।
অথবা পড়েছে এক উপন্যাস!
৪.
সাঙ্গার পরিবর্তনের ফল শুধুই কয়েকটি সংখ্যা নয়। যিনি শুরুতে এসে প্রতিপক্ষকে জ্বালিয়ে মারতেন স্লেজিংয়ে, তিনিই একসময় এসে বন্ধ করে দিয়েছেন তা! তাঁর মতে, তিনি বুঝতে শিখেছেন, ‘আমি খুশী যে আমি বড় হয়েছি’!
সাঙ্গা বড় হয়েছেন, সঙ্গে পেয়েছেন ইয়েহেলিকে। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করার দিনগুলিতে শুধু একটা উপহার দিতে তিনি ছুটে যেতেন ক্যান্ডি থেকে কলম্বো! সাঙ্গার বাবা তাঁকে ক্রিকেট শিখিয়ে সময় পার করতেন, সাঙ্গার সময় কাটে এখন জমজ পুত্র-কন্যাকে নিয়ে।
ক্রিকেট ছাড়ার পর সাঙ্গা কী করবেন? ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় টেস্টের পর বিদায় নেবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। খেলবেন সারের হয়ে। ভবিষ্যত বলবে সময়। সাঙ্গা হয়তো নতুন কোনো দায়িত্বে নিজেকে মানিয়ে নেবেন। পরিবর্তিত হবেন। ক্রিকেট খেলতে খেলতেই যেমন বক্তা হয়েছিলেন। সুবক্তা। ক্রিকেট নিয়ে সাঙ্গা কথা বলেন, শোনেন সবাই। যেমন শুনেছিলেন লর্ডসে হলভর্তি শ্রোতা, যখন এমসিসি স্পিরিট অব ক্রিকেটের লেকচার দিয়েছিলেন!
সেখানে কঠিন কঠিন কথা বলা সাঙ্গা আবার মজাও করতে পারেন! কঠিন সময়েও! লাহোর আক্রমনের সময় ওপেনার থারাঙ্গা পরানাভিতানাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তুমি প্রথম বলেই আউট হলে একবার। তারপরের ইনিংসে রান আউট। এখন আবার ‘গুলিবিদ্ধ’। কী বিভৎস প্রথম সফর, তাই না!’
কি? এই দৃশ্যটি আপনার অজানা? তাহলে হয়তো এটি চলচ্চিত্রের পর্দার পেছনের একটা গল্প। যা সবসময় সামনে আসে না। অথবা সবটুকু আসে না!
অথবা উপন্যাস লেখার কোনো দৃশ্যপট।
৫.
বেসিন রিজার্ভ, ওয়েলিংটন। কুমার চোকশান্দা সাঙ্গাকারা যখন ক্রিজে এলেন, শ্রীলঙ্কার রান তখন ১৮। সেই চেনা তিন নম্বর পজিশন। সেই চেনা অবস্থা। দ্রুত উইকেট পড়ে যাওয়া। দ্রুতই তাঁর ক্রিজে আসা। ক্যারিয়ার রান তখন ১১৯৯৫।
টেস্টে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১২০০০ এর ক্লাবে ঢুকতে প্রয়োজন তখন এক রান। ট্রেন্ট বোল্টের লেগস্ট্যাম্প দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বলটা হাঁটুর ওপর থেকে আলতো করে ফ্লিক করলেন। মাহেলা জয়াবর্ধনে কুমারের এই শটটা নাকি নিতে চাইতেন, এই ফ্লিকের ডানহাতি সংস্করণটা।
সাঙ্গার রান তখন ১৩। শ্রীলঙ্কার উইকেট নেই তিনটি। টিম সাউদি বোলার। অফস্ট্যাম্পের উপরে সোজা, ফুলপিচড বল। সাঙ্গার পেছনের হাঁটু নেমে এলো, সঙ্গে ব্যাটটাও। টোকালেন যেন! ইএ স্পোর্টসের ক্রিকেট ০৭ গেমে আপনি যখন লফটেড শট খেলে ক্লান্ত, যখন খেলতে চান কপিবুক শট, তখন যেভাবে খেলেন। শট খেলেই ‘রান’ বলে উঠলেন, সঙ্গী অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে। ওই গেমের মতো করেই যেন! টাইমিংয়ের মান- অসাধারণ, অবশ্যই। বল লং অফে, পেছনে দৌড়াতে থাকা দুই কিউই ফিল্ডারকে পরাজিত করেছে ততক্ষণে।
শ্রীলঙ্কার উইকেট আরও একটি গেছে তখন। সাঙ্গার রান ২৬। ডগ ব্রেসওয়লের ওভারপিচড বল। অফস্ট্যাম্পের বাইরে। সাঙ্গার পেছনের হাঁটু নেমে এলো, স্ট্রেইট ড্রাইভের সময়ের চেয়ে একটু বেশী। মাটির সঙ্গে লেগে গেল। সামনের পায়ের পাতা কাভারের দিকে। ‘হেড পজিশন’ সেখানেই, যেখানে থাকার কথা। চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ, ব্যাট আর বলের সংস্পর্শ ঘটছে যেখানে। ব্যাটটা নেমে এল, যেন একটা বক্ররেখা অনুসরণ করে। রেখাটা অনুসরণ করলো ব্যাটটা, একটা নির্দিষ্ট অবস্থান পর্যন্ত। দুই হাত একটা অবস্থানে এসে স্থির হলো। আপনি জানেন, ততক্ষণে কী ঘটেছে। ব্যাটিংয়ের ব্যকরণের যেন পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রায়ন। ‘কপিবুক’ কাভার ড্রাইভ। সাঙ্গার ট্রেডমার্ক। যে ব্যাকরণ দুনিয়াজোড়া ব্যাটসম্যানেরা জেনে না জেনে মেনে চলেন, সেই ব্যাকরণসম্মত শটই সাঙ্গার ট্রেডমার্ক!
যখন ফিফটিতে পৌঁছুলেন, শ্রীলঙ্কার তখন পাঁচ উইকেট নেই। টিম সাউদির ওভারপিচড বল, অফস্ট্যাম্পের বাইরে। আপনি জানেন, এরপর কী ঘটতে চলেছে। আপনি এই দৃশ্য এর আগেই দেখেছেন। অথবা পড়েছেন। সাঙ্গার এই ইনিংসেই।
সাঙ্গার রান যখন ৭০, ট্রেন্ট বোল্ট একটা শর্টপিচ বল করলেন। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে ঘুরিয়ে দিলেন সাঙ্গা। মিডউইকেট দিয়ে চার। শর্ট বলেও রেহাই নেই তাহলে!
সেঞ্চুরি করলেন মার্ক ক্রেইগকে কাট করে। আবার ব্যাকফুটে। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে বলটা চার হলো না, তবে সাঙ্গা পেলেন ৩৮তম শতক। রাহুল দ্রাবিড়ের ৩৬টি শতকের রেকর্ড আগেই পেরিয়ে এসেছেন। এগিয়ে গেলেন রিকি পন্টিংয়ের ৪১টির দিকে। ও হ্যাঁ, শ্রীলঙ্কার তখন উইকেট নেই ছয়টি।
সাঙ্গার রান ১৯৯। শ্রীলঙ্কার উইকেট নেই আটটি। জিমি নিশাম বোলার, অফস্ট্যাম্পের বাইরে ওভারপিচড বল। হ্যাঁ, আপনি জানেন। এরপর কী ঘটবে। তবুও রোমাঞ্চের শিহরণ খেলে গেল। আপনার চোখে তখনও মুগ্ধতা লেগে আছে। ১১তম দ্বিশতক। সামনে রইলেন শুধুই ডন!
সাঙ্গার বিদেশের মাটিতে শেষ টেস্ট। শেষ ইনিংস বাদ দিলে শেষ দ্বিশতক। যাতে চার ছিল ১৮টি, সেই চিরচেনা কাভার ড্রাইভেই ১১টি। দলের ৩৫৬ রানের মধ্যে ২০৩-ই সাঙ্গার ব্যাট থেকে। আপনি তো জানেনই! আপনি যে সাঙ্গা নামক এই ব্যাটিং চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচিত। উপন্যাসটা পড়া আছে আপনার।
এ যেন জানা সংলাপ, চেনা দৃশ্য!
৬.
কুমার সাঙ্গাকারা সেই বারবার দেখা চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন। অথবা লিখেছিলেন অসংখ্যবার পড়া সেই উপন্যাস!
একই জিনিস। কিন্তু আবেদন কমে না। একঘেয়েমী আসে না। আজ যখন শেষ দৃশ্য অবতীর্ন, তখন একটা শূন্যতা ঘিরে ধরতে চাইছে। শেষ পাতায় এসে তৃপ্তি আর আক্ষেপের যুগপৎ ঘটছে।
এরকম ‘মাস্টারপিস’ এর কারণেই কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠেন সেই কারিগর।
কুমার সাঙ্গাকারা এভাবেই হয়ে ওঠেন কুমার ‘সুপার’ সাঙ্গাকারা!