• ট্রিবিউট
  • " />

     

    বাবার চোখে 'সেরা' নন সাঙ্গা

    বাবার চোখে 'সেরা' নন সাঙ্গা    

    তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি লঙ্কান কিংবদন্তীর। ভদ্রলোকের দাবী পুত্রের সবচেয়ে বড় সমালোচকও তিনিই। সাঙ্গাকারার বিদায়ে যখন গোটা ক্রিকেট বিশ্ব তাঁকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছে তখন বাবার বয়ানে অতৃপ্তির সুরটা স্পষ্টই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের পাতায় বাবা খেমা সাঙ্গাকারার কলমবন্দী হয়েছেন কুমার সাঙ্গাকারা

     

     

    প্রথমেই বলে রাখি যে ছেলের ব্যাটিংটা সবসময়ই আমাকে খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে থেকে দেখতে হত। কথাটা কেমন শোনায় জানি না কিন্তু সে কখন আউট হবে তা আমি আগে থেকেই টের পেতাম। কুসংস্কার বলতে পারেন কিন্তু আমার অনুমান কখনই ভুল হত না। আর ঠিক এ কারণেই আমি আরও বেশী স্নায়ুচাপে ভুগতাম। এক ওভার আগেই ধরে ফেলতাম যে সময় হয়ে গেছে।

     

    মাঠে বসে তাঁর খেলা দেখতে না চাওয়ারও এটা একটা অন্যতম কারণ। এমনকি বাড়িতেও আমি শুধুমাত্র ততক্ষণই তাঁর ইনিংস দেখতাম যতক্ষণ সে ছন্দে থাকতো।

     

    আমি বরাবরই তাঁর সবচেয়ে কট্টর সমালোচক। সেও এটা খুব ভালো করে জানে। পুরো পৃথিবীর কাছে সে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমার মতে সে তাঁর সেরাটুকুতে পৌঁছতেই পারে নি। তাঁর যেটুকু দক্ষতা ছিল তা দিয়ে সে আরও অনেক ভালো কিছু করতে পারতো।

     

    ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচের পর পরিবারের সাথে কুমার সাঙ্গাকারা।

     

    তাঁর গড় গ্রায়েম পোলক, গ্যারি সোবার্সদের সমমানের হওয়ার বিষয় সবাই গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করছে। কিন্তু কুমার আরও ভালো করতে পারতো। প্রায়ই সে বোলারদেরকে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। আমার বিবেচনায় কেবল ডন ব্র্যাডম্যানই ব্যাটসম্যানদের পূর্ণতার মানদন্ড। তিনি গড়ে প্রতি তিন টেস্টে একটি করে সেঞ্চুরি করেছিলেন। আপনি যদি নিজেকে সত্যিকারের একজন আন্তর্জাতিক মানের ব্যাটসম্যান ভাবতে চান তবে আপনাকে তেমন কিছুই করে দেখাতে হবে। ভুল বুঝবেন না, কুমার ভালো অবস্থানে থেকেই ক্যারিয়ার শেষ করেছে। কিন্তু সে কি তাঁর প্রতিভার সবটুকু ব্যবহার করতে পেরেছে? আমার মনে হয় না।

     

    কুমারের খুব অল্প বয়স থেকেই আমি ওর ক্রিকেট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ব্যাটে-বলে সংযোগের জায়গাটায় সে সবসময়ই পটু। তাঁর ব্যাট চালানোর ধরণেই সেটা স্পষ্ট ছিল। কিন্তু ‘টেকনিক’ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয়। আমার মতে জয়াবর্ধনের টেকনিক অনেক ভালো ছিল। তাঁর রক্ষণাত্মক কৌশলও ছিল অনেক বেশী দৃঢ়। কুমার মাহেলার চেয়ে বেশী রান আর গড় করতে পেরেছে ধৈর্য আর মনের জোর পুঁজি করে। কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি যে মাহেলা, আতাপাত্তু, ডি সিলভারা খেলার নিয়ন্ত্রণটা অনেক বেশী নিজেদের হাতে রাখতে পারতো।

     

    আমি দেখিয়ে দিই নি অথচ সে খেলেছে এমন মার নেই বললেই চলে। শর্ট বলে সে বরাবরই দক্ষ ছিল। পিছনের পায়ের কাজটা ভালো বুঝতো। ক্যান্ডির পিচগুলোতে বল অনেক বেশী ‘বাউন্স’ আর ‘ক্যারি’ করে। কুমার এসব উইকেটে খেলে বড় হয়েছে। প্রথম বয়সে মাহেলা অনেক বেশী স্পিন খেলার সুযোগ পেয়েছে বলে এইদিক থেকে সে ভাগ্যবান ছিল। কুমার সেভাবে স্পিন খেলার সুযোগ পায় নি বলে প্রথমদিকে ঘূর্ণি বলে তাঁর বেশ দুর্বলতা ছিল। সময়ের সাথে সে সেটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও ততদিনে ঢের দেরী হয়ে গিয়েছিল। সেটাও আমার অবিরাম বকবকানির ফসল। প্রায়ই সে বিরক্ত হয়ে যেত। এখনও মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় সে বড্ড ধীরগতিতে পা চালাচ্ছে।

     

    ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন ব্যাটসম্যানকে খুব পছন্দ করি। তিনি সুনীল গাভাস্কার। ভদ্রলোক প্রথমে বোলারদেরকে ধৈর্যের পরীক্ষায় হারিয়ে দিতেন। অতঃপর স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে তাঁদের উপর চড়ে বসতেন। তাঁকে ধৈর্যচ্যুত করতে বোলারের নিরলস প্রচেষ্টার কাছে তিনি কখনই হার মানতেন না। একজন সফল ব্যাটসম্যান অনেকটা মুষ্টিযোদ্ধার মতো। জিততে হলে আগে তো আপনাকে ১২তম পর্বে যেতে হবে। আমি কুমারকে বড় করেছি প্রচুর পরিমানে ব্র্যাডম্যান-গাভাস্কারদের খেলা দেখিয়ে, তাঁদের নিয়ে লেখা বই পড়িয়ে।

     

     

    তাঁকে আমি সহজাত প্রতিভা বলবো না। সে পরিশ্রম করে হাত পাকিয়েছে। খুব বেশী মানুষ জানে না, কুমার খুব ভালো টেনিসও খেলতে পারতো। টেনিসই তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল। তাঁর বোন সারাঙ্গা অবশ্য তাঁর থেকেও ভালো খেলতো। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মেয়েটা সিনিয়রদের জাতীয় খেতাব জিতেছিল। আমার ধারণা এখনও দেশের মধ্যে এটা একটা রেকর্ড। আমেরিকা গিয়েও সে নজর কেড়েছিল। তাঁর সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কাঁধের একটা চোটের কারণে। ওর ফোরহ্যান্ড স্ট্রোকের সামনে শ্রীলংকার যে কোন পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়কেও বোধকরি হিমশিম খেতে হতো। সেই সারাঙ্গা একদিন একটা পারিবারিক দ্বৈরথে কুমারকে হারিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকেই সে টেনিসটা আর কোনদিন গুরুত্বের সাথে খেলে নি। ওই হারের পর ক্রিকেটই হয়ে গেলো তাঁর প্রধান আকর্ষণ। যদিও আমি নিশ্চিত এই তত্ত্বের সাথে সে একমত হবে না।

     

    আমাদের মধ্যে সবসময়ই বিতর্ক হত, ক্রিকেট নিয়েই মূলত। শ্রীলংকার রাজনীতি, সাধারণ জীবন নিয়ে তাঁর খুব আধুনিক একটা দর্শন ছিল যেটা আমার ছিল না। সে দুনিয়া ঘুরেছে, অনেককিছু দেখেছে। প্রতিটা ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য করা চাই। তবে আমার মনে হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের এই সুস্থধারার আলোচনায় যুক্তিতর্কে আমি তাঁকে হারিয়ে দিতাম। আমার স্ত্রীর বদ্ধমূল ধারণা যে ছেলে হয়েছে বাপের মতো আর যে কোন বিষয়ে আমরা দু’জনই স্ব স্ব মতামত একই রকম একগুঁয়েমির সাথে জাহির করি।

     

    কুমারের কিছু ইনিংস আমার প্রিয় ছিল। সবগুলোর কথা অবশ্য মনে নেই। হোবার্টে অস্ট্রেলিয়ার সাথে একটা হারা ম্যাচে তাঁর ১৯২ রানের ইনিংসটি নিয়ে লোকে এখনও আলোচনা করে। ওটা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। একেবারে নিখুঁত। বিশ্বকাপের চার ম্যাচে চার শতকও ভালো অর্জন ছিল।

     

    আমার ছেলে ক্রিকেটার হতে পারে কিন্তু ক্রিকেটটা আমার খুব প্রিয় কিছু না। খেলাটা হিংসাবিদ্বেষে ভরে গেছে। আমার ছেলে যতোই সততার সাথে ক্রিকেট খেলুক না কেন এটা এখন আর ভদ্রলোকের খেলা নেই। আইপিএলে অনেক দুর্নীতির কথা আমরা শুনি। টিটোয়েন্টি লিগগুলো ক্রিকেটের গায়ে অমোচনীয় কালিমা লাগিয়ে দিয়েছে।

     

    কুমার যখন আমাকে তাঁর অবসরের সিদ্ধান্তের কথা জানালো তখন খুব একটা কষ্ট হয় নি। আমরা দু’জনেই একমত হয়েছিলাম যে তাঁর সময় শেষ, অহেতুক আর কালক্ষেপণের কোন মানে হয় না।

     

     

    আমি জানি না সে ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছে। ৩৭ বছর বয়সে আইনের প্রতি নতুন করে আগ্রহী হওয়ার সুযোগ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমার তাঁর বিষয়ে একটা পরিকল্পনা আছে এবং আশা করি এতে সে অমত করবে না। আমি চাই এখন সে গলফের প্রতি মনোযোগী হোক। তাঁর হাতের দক্ষতা এই খেলাটায় কাজে দেবে। দুই দশকের উপর সে পেশাদার খেলোয়াড়। তাঁর প্রতিযোগিতামূলক সত্ত্বাটা কখনই মরে যাবে না। গলফে সে এটা কাজে লাগাতে পারবে এবং এই খেলায় সে চাইলে আরও ৩০ বছরও কাটিয়ে দিতে পারবে। বয়সটা যে এখানে মুখ্য নয় তা বলাই বাহুল্য।

     

    আর হ্যাঁ নিশ্চিত থাকুন, গলফ কোর্সে তাঁকে দেখতে আমি অর্ধেক স্নায়ুচাপেও ভুগবো না!