কাঁদিয়েই চলে গেলেন লেস্টারের বটবৃক্ষ
কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামের হোম গ্যালারির প্রবেশ পথের বাইরে ফুলের তোড়া জমেছে। রবিবার সকাল থেকেই সমর্থকদের ভীড় লেগেছিল। অগুণিত ফুলের তোড়ার সঙ্গে গণেশের একটা ছবিও দেখা গেল। অথচ গতরাতে এই মাঠ থেকেই খেলা দেখে বাড়ি ফিরেছিলেন সবাই। গিয়ে শুনেছেন এক দুঃসংবাদ। ক্লাবের মালিক ভিচাই শ্রীভাধানাপ্রভার হেলিকপ্টার আছড়ে পড়েছে স্টেডিয়ামের ঠিক বাইরেই, গ্যারেজে। ক্লাবের পক্ষ থেকে অবশ্য তখনও নিশ্চিত করে জানানো হয়নি কিছু। সোমবার সকালে নিশ্চিত হয়, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারে ছিলেন ভিচাই, মারা গেছেন তিনি।
***
ইংল্যান্ডের মানডে নাইট ফুটবলে এ সপ্তাহে খেলা ছিল ম্যানচেস্টার সিটি আর টটেহনাম হটস্পারের। রিয়াদ মাহরেজের একমাত্র গোলে টটেনহামকে হারিয়েছে সিটি। ৬ মিনিটে গোলের পর মাহরেজের উদযাপন দেখেই বোঝা গিয়েছিল, দুই হাত ওপরে উঠিয়ে কারও কথা মনে করছেন। ম্যাচের পর তবুও নিশ্চিত করে জানালেন, গোলটা উৎসর্গ করেছেন ভিচাইকে। মাহরেজের সাবেক ক্লাব লেস্টার সিটি, এই গ্রীষ্মেই সিটিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। লেস্টারে ছিলেন চারবছর, রূপকথার মতো কাটানো এক মৌসুমের অন্যতম কারিগর ছিলেন মাহরেজ। সাবেক ক্লাব মালিকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলেন পিতা-পুত্রের মতো। ম্যাচ জেতানো গোল করে পুরনো কথাই আরেকবার জানিয়েছেন মাহরেজ।
২০১৫-১৬ মৌসুমে লেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ জয়ের গল্পটা ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে রোমাঞ্চ জাগানিয়া উত্থানগুলোর একটি। জেমি ভার্ডি, এনগোলো কান্তে, মাহরেজরা ছিলেন সেই দলের সদস্য। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরের মৌসুমে কেবল কান্তেকেই ছেড়েছিল লেস্টার সিটি। ভার্ডি, মাহরেজদের দিকেও হোমড়া-চোমড়া ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর নজর পড়েছিল। প্রিমিয়ার লিগে জয়ের পরই তাই লেস্টার সিটিতে ভাঙনের সুর। ভিচাই তখন ভার্ডিকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের রুমে। কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামের ওই রুমটায় দলের খেলোয়াড়দের যাতায়াত নেই। ভিচাই নিজেই বুঝিয়ে শুনিয়ে ভার্ডিকে নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করালেন। ভার্ডি অবশ্য শুধু একটা সই দিয়েই রুম থেকে বের হলেন না, ভার্ডি রুম ছাড়লেন নতুন একটা স্বপ্ন নিয়েও। মাহরেজ আরও তিন মৌসুম পর ক্লাব ছেড়েছেন, কিন্তু ভিচাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ পড়েনি তারও।
লেস্টার সিটিকে স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করেছিলেন এই ভদ্রলোকই। ২০১০ এর শেষদিকে ক্লাবের মালিকানা কিনেছিলেন থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ী ভিচাই। লেস্টার সিটি তখন চ্যাম্পিয়নশিপের দল। সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই দল যখন প্রায় এক যুগ পর প্রিমিয়ার লিগে ফিরল তখন ভিচাই দেখালেন অবিশ্বাস্য এক রূপকল্প। তিন বছরের ভেতর দলকে তিনি দেখতে চান ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায়। ১৮০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিলেন ভিচাই। তিনি নিজেও হয়ত ভাবেননি তার দেখা স্বপ্নটাই সত্যি হতে এতো তাড়াতাড়ি। প্রথম মৌসুমে অলৌকিকভাবে রেলিগেশন এড়িয়ে প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকে লেস্টার। পরের মৌসুমে ক্লদিও র্যানিয়েরিকে দলের কোচ করে আনার সিদ্ধান্ত ছিল ভিচাইয়েরই।
এরপরের গল্পটা তো জানা সবারই।
***
ভিচাই পাদপ্রদীপের আলোতে থাকতে চাননি কখনোই। ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভার দিয়ে রেখেছিলেন নিজের ছেলের হাতে। কিন্তু ছেলে অবশ্য বাবার অনুমতি ছাড়া সিদ্ধান্ত নেন না। মিডিয়ার সামনে আসতে পছন্দ করতেন না ভিচাই, সে কারণেই হয়ত চেয়ারম্যানের পদটা নিজের কাছে রাখতে চাননি। লেস্টার সিটি যেবার প্রিমিয়ার লিগ জিতল, দলের সব খেলোয়াড়কে বিএমডব্লু গাড়ি উপহার দিলেন। সেই খবরটাও আড়াল করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লেস্টার সিটি তখন সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, ভিচাইয়ের মহানুভবতার খবর তাই ঢাকা থাকেনি।
শুধু ক্লাব নয়, লেস্টার শহরটাকেই নিজের ভেবে ভালোবেসেছিলেন তিনি। লেস্টার ইউনিভার্সিটি মেডিকেলে ১ মিলিয়ন, শহরের রয়াল ইনফার্মারিতে আরও ১ মিলিয়ন, শিশুদের একটি হাসপাতালে ২ মিলিয়ন অর্থ দান খেলার বাইরেও ভিচাইকে চিনিয়েছে আলাদা করে। ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ ক্লাবের বিদেশী মালিকেরা যেখানে খবরই রাখেন না নিজের দলের, সেখানে লেস্টারের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন ভিচাই। প্রিমিয়ার লিগ জয়ের কয়েকমাস পর র্যানিয়েরিকে বরখাস্ত হন, এ ঘটনার পর লেস্টার সমর্থকদের মনে সংশয় জেগেছিল ঠিকই কিন্তু মালিকপক্ষের ওপর থেকে তাদের ভরসা হারায়নি একদিনের জন্যও।
নিজের ষাটতম জন্মদিনটাও ভিচাই উদযাপন করেছিলেন লেস্টার সমর্থকদের সঙ্গে। ৬০ জনকে সিজন টিকেট উপহার দিয়েছিলেন সেবার। এর আগে গ্যালারিতে সমর্থকদের ফ্রি বিয়ার, ডোনাট খাইয়েও শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি। মালিক আর সমর্থকদের এই সম্পর্ক ইউরোপিয়ান ফুটবলে বিরল ঘটনা।
***
কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামে নিয়মিত খেলা দেখতেন ভিচাই। এরপর মাঠ থেকেই হেলিকপ্টারে চড়ে বার্কসায়ারে নিজের বাসার দিকে রওয়ানা হয়ে যেতেন। ওয়েস্টহামের সঙ্গে ম্যাচ শেষেও মাঝমাঠে কিক অফ লাইনের ওপর দাঁড়িয়েছিল হেলিকপটার, ভিচাইকে পৌঁছে দিতে। বাড়িতে নয় সেই হেলিকপ্টারই ভিচাইকে পৌঁছে দিয়েছে অন্যলোকে। ভিচাই অন্যভাবেও মারা যেতে পারতেন, হেলিকপ্টারটা বিধ্বস্ত হতে পারত আরও দূরে গিয়েও। সাধারণ মৃত্যুতে হয়ত এতো আলোড়ন হত না, যাওয়ার সময়ও আড়াল করতে পারেননি নিজেকে। তার মহানুভবতার গল্পগুলো তাই ফিরে এসেছে নতুন করে।
স্টেডিয়াম চত্বরও হয়ত বিদায়বেলায় ছাড়তে চায়নি তাকে। মৃত্যুটা লেস্টার শহরেই লেখা ছিল, কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামেই। তার আগে লেস্টারকেই রাজা বানিয়েছিলেন তিনি। এক ক্লাবকে নিয়ে শহরের গল্প লিখে রেখে গেছেন নতুন করে। সেই গল্প মানুষের মুখে ঘুরবে বহুদিন। মৃত্যুর পর তাই লেস্টারের মানুষ তাকে স্মরণ করেছে রাজার মতো করেই। আর ক্লাব আর খেলোয়াড়েরা হারিয়েছেন নিজের পরিবারের একজনকে। লেস্টার গোলরক্ষক ক্যাস্পার স্মাইকেলের টুইটটাই তার বড় প্রমাণ। আর দশটা মালিক আর ভিচাইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা বোঝা যায় তাতে।
“প্রিয় চেয়ারম্যান,
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি বিধ্বস্ত, আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না শেষরাতের ঘটনাটা। এটা সত্যি মনে হচ্ছে না। এই ক্লাব আর এই শহরের মানুষের জন্য আপনি কী ছিলেন সেটা কয়েক শব্দে ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা সবাই জানি আপনি এই ক্লাবের জন্য বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শুধু সে কারণেই নয়। শুধুমাত্র ক্লাব নয় এই শহরের জন্য আপনি গভীরভাবে অনুভব করতেন।”
“আপনার মতো মানুষ আমি আগে দেখিনি। কঠোর পরিশ্রমী, আপনার কাজের প্রতি একাগ্রতা, আপনার উৎসাহ, আর উদারতা ও মহানুভবতা অপরিসীম। আপনি সবাইকে ছুঁয়ে গেছেন, সবার জন্য আপনার সময় ছিল, সে যেই হোক না কেন। আমি সবসময়ই আপনাকে একজন নেতা, একজব বাবা হিসেবে দেখেছি। আপনি ফুটবল বদলে দিয়েছেন। আপনি সবাইকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন। শুধুমাত্র এই শহরেরই জন্যই নয়, পুরো বিশ্বের ফুটবলে আপনি ছড়িয়ে গেছেন। খুব বেশি মানুষ এমনটা পারেননি।"