ইউনাইটেডের নাটকীয় ফেরায় ম্লান রোনালদোর গোল
জুভেন্টাসের জার্সিতে চ্যাম্পিয়নস লিগে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর প্রথম গোলের অপেক্ষা ফুরোল অবশেষে। কিন্তু তার পরিণতি এরকম হবে, কে জানত? চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদোর শেষ গোলটা ছিল এই মাঠেই। অ্যালিয়াঞ্জ স্টেডিয়ামে আজ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে করা রোনালদোর গোলটাও কম দর্শনীয় হয়নি। ৩৩ বছর বয়সে এসেও তিনি অতিমানবীয় গোল করবেন সেটাই বরং নিয়মিত ঘটনা। সাবেক ক্লাবের বিপক্ষে রোনালদোর গোলটাই শিরোনাম হওয়ার কথার ছিল। কিন্তু শেষ ৫ মিনিটের নাটকে খেলার মোড় গেল ঘুরে। হোসে মরিনহোর নামানো দুই বদলিই জুভেন্টাসের জয়টা ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন জুভেন্টাসের মাঠ থেকেই। হারতে বসা ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ এইচে সুবিধাজনক জায়গাতেই চলে গেছে ম্যান ইউনাইটেড। আর ড্র করলেই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হত জুভেন্টাসের, হেরে সেটাও হাতছাড়া হয়েছে মাসসিমিলিয়ানো আলেগ্রির দলের।
শেষের নাটকে জুভেন্টাসকে হারিয়ে ইউনাইটেড কোচ মরিনহো অবশ্য করে বসেছেন আরেক কান্ড। মাঠের ভেতর ঢুকে গিয়ে সাবেক ইন্টার মিলান ম্যানেজার কানে হাত দিয়ে সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। সেটা ভালোভাবে নেননি জুভেন্টাসের দর্শক থেকে খেলোয়াড়দের কেউই। মাঠের ভেতরই লিওনার্দো বনুচ্চিদের সঙ্গে প্রায় লেগে গিয়েছিল মরিনহোর। পরে অবশ্য নিজেকে সামলে টানেলের পথই ধরেছেন তিনি। ম্যাচ শেষেও তাই অ্যালিয়াঞ্জ স্টেডিয়ামে উত্তেজনা পেয়েছে নতুন রূপ। সেটা কোনোভাবেই ঘরের দলের সমর্থকদের জন্য সুখকর কিছু হয়নি, অথচ ম্যাচের প্রায় পুরোটা সময় জুভেন্টাসের জয় নিয়ে সংশয় থাকার মানুষই ছিল কম।
প্রথমার্ধ পুরোটাই ছিল জুভেন্টাসময়। যদিও ডেভিড ডি গিয়াকে বিপদে ফেলতে খানিকটা সময়ই নিয়েছিল তুরিনের ওল্ড লেডিরা। ম্যাচের আধঘন্টা পেরুনোর পর ডি গিয়ার সময় কেটেছে জুভেন্টাসের আক্রমণের স্রোত সামলাতেই। ৩৩ মিনিটে হুয়ান কুয়াদ্রাদোর ঠেকানোর পরও বিপদমুক্ত করতে পারেননি ডি গিয়া, পরে ক্রিস স্মলিংয়ের ক্লিয়ারেন্সে স্বস্তি মেলে ইউনাইটেডের। কিন্তু পরের মিনিটে বিপদ যেন আরও বাড়ে, রোনালদোই ক্রস করেছিলেন সামি খেদিরাকে। ১০ গজ দূর থেকেও গোল করা হয়নি খেদিরার, গোলপোস্টের কাছে হার মানেন তিনি। প্রথমার্ধ শেষের আগে আরও দুইবার সেটপিস থেকে পাউলো দিবালার করা সেন্টার আর কর্নার কিকও ঝামেলায় ফেলেছিল ইউনাইটেডকে। ইউনাইটেডের রক্ষণ অবশ্য মনোযোগ ধরে রেখে প্রথমার্ধে আটকেই রাখে জুভেন্টাসকে।
জুভেন্টাসের তুলনায় ইউনাইটেড পুরো ম্যাচেই ছিল সাদামাটা। প্রথমার্ধে বলার মতো কোনো আক্রমণই করতে পারেনি তারা। পল পগবার দূরপাল্লার দুর্বল একটি শট, আর অ্যালেক্সিস সানচেজের উদ্দেশ্যে বাড়ানো একটা লং বল ছাড়া- জুভেন্টাসের রক্ষণে কমই বিচরণ করার সুযোগ হয়েছে ইউনাইটেডের। দ্বিতীয়ার্ধের শেষের কিছুক্ষণ বাদ দিলেও গল্পটা থাকে একই। তার আগ পর্যন্ত জুভেন্টাসেরই জয়জয়কার। ম্যাচশেষে অবশ্য সেটা হতাশারও কারণ হয়েছে তাদের।
৫০ মিনিটে দিবালা দারুণ এক শট করেছিলেন। কিন্তু এরপর ডি গিয়া আর দিবালা দুইজনই হয়ে গেলেন হতভম্ব। নিজের ডিফেন্ডারদের ভুলে হতাশ ডি গিয়া, আর বারপোস্টের কোণায় লেগে অল্পের জন্য গোল না পেয়ে অবিশ্বাস দিবালার চোখে। ৬৫ মিনিটে অবশ্য দিবালা একাই অবিশ্বাসে চোখ কচলাননি, রোনালদোর গোল ছুঁয়ে গেছে স্টেডিয়ামের সবাইকেই। বনুচ্চি মিডফিল্ড থেকে লং বল পাঠিয়েছিলেন ডিবক্সের ভেতর, লিন্ডেলফ পাহারায় রেখেছিলেন রোনালদোকে। অফসাইড ফাঁদকে ফাঁকি দিয়ে, লিন্ডেলফকে কোনো সুযোগই দিলেন না পর্তুগিজ। এরপর দারুণ এক ভলি সোজা বল পাঠালেন ইউনাইটেডের জালে। এর আগে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে রোনালদোর শেষ গোলের উদযাপনটাও এখানেই করেছিলেন, একই জায়গাতেই। সেবার ক্ষমা চেয়েছিলেন জুভেন্টাস সমর্থকদের কাছ থেকে, এবার চেয়েছেন ম্যানচেস্টার থেকে আসা দর্শকদের কাছে। সাদা-কালো জার্সি গায়েও চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদোর উদযাপনের শুরু ঠিক সেখান থেকেই।
রোনালদোর গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর সহজেই ব্যবধানটা বাড়িয়ে নিতে পারত জুভেন্টাস। নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট করার মাশুল জুভেন্টাসকে দিতে হয়েছে ম্যাচ হেরে। ৭৩ মিনিটে কুয়াদ্রাদোর বানিয়ে দেওয়া বলে পিয়ানিচ লক্ষ্যেই শট করতে পারেননি। মিনিটখানেক পর প্রথমজনের জায়গায় রোনালদো, পিয়ানিচের জায়গায় কুয়াদ্রাদো। এবার কলম্বিয়ান সহজ সুযোগ পেয়ে মারলেন বারপোস্টের অনেক ওপর দিয়ে। ম্যান ইউনাইটেডকে ম্যাচে টিকে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল জুভেন্টাসের খামখেয়ালীপনাই।
ম্যাচ হারলেই ভ্যালেনসিয়ার পরে থেকে গ্রুপে তৃতীয় অবস্থানে থাকত ইউনাইটেড। ম্যাচ শেষের ১১ মিনিট আগে মরিনহো তাসের শেষ টেক্কাটা ছাড়েন। মারুয়ন ফেলাইনি আর হুয়ান মাতাকে নামিয়ে সবগুলো বদল করে ফেলেন তিনি। ইউনাইটেডের ডাইরেক্ট অ্যাপ্রোচ ঠেকাতে মাসসিমিলিয়ানো আলেগ্রিও কিছুটা রক্ষণাত্মক হন আন্দ্রে বার্জালিকে নামিয়ে। ৮৪ মিনিটে তখন পর্যন্ত ইউনাইটেডের সেরা আক্রমণটা করেছিলেন অ্যান্থিনি মার্শিয়াল। ডিবক্সের ভেতর ঢুকে পড়ে শট করেছিলেন কঠিন অ্যাঙ্গেল থেকে, ভোজায়িক সেজনি ঠেকানোর পর জর্জিও কিয়েলিনি ফিরতি বলও ক্লিয়ার করেন।
এরপরই ইউনাইটেডের দুই বদলি মিলে বদলে দেন খেলার চেহারা। ৮৬ মিনিটে ডিবক্সের ঠিক বাইরে থেকে ফ্রিকিক পেয়ে যায় ইউনাইটেড। মাতার নিখুঁত ফ্রি কিক গোলে ম্যাচে ফেরে ইউনাইটেড। ৮৯ মিনিটে আরও একবার ফ্রি কিক থেকেই কপাল পোড়ে জুভেন্টাসের। অ্যাশলি ইয়াংয়ের ফ্রি কিকে মাথা ছোঁয়ান ফেলাইনি। তাতে অবশ্য গোল হয়ত পেত না ইউনাইটেড। এরপর জটলার ভেতর বনুচ্চি গায়ে লেগে আবার অ্যালেক্স সান্দ্রোর গায়ে লাগে সেই বল তারপর সেটা পরিণত হয় আত্মঘাতী গোলে।
অথচ মিনিট পাঁচেক আগেও চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজদের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে শুরুর রেকর্ডটা চোখ রাঙ্গাছিল ইউনাইটেডকে। শেষ ৫ মিনিটের নাটক ইউনাইটেডকে মনে করিয়ে দিয়েছে ১৯৯৯ সালের কথা। শেষ সেবারই এক গোলে পিছিয়ে থাকা ম্যাচ, শেষে ৫ মিনিটের ফিরে আসায় জিতেছিল রেড ডেভিলরা। আবারও ইউনাইটেডের আরেকটি ফেরার সাক্ষী হলো তুরিন।