ওয়েঙ্গারের "কুড়ি" হয়ে ফোটার গল্প
১.
পন্ডিতরা বলে থাকেন, আর কোন খেলাতেই এতটা অস্থিরতা নেই। ‘গ্যারান্টি’ বিহীন চুক্তিপত্র। নিশ্চয়তার বালাই নেই। শুধু তাৎক্ষণিক ফলাফলের পাহাড়সম চাপ। পেছনের পাইপলাইনে দাঁড়িয়ে কলেজ ফুটবল থেকে উঠে আসা অগুণতি প্রতিভা। সারাক্ষণই টেনে ধরছে জার্সি। জায়গা চাই! এসবের পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে চোট সামলানোর হ্যাপা তো থাকছেই। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফুটবল লিগ (এনএফএল), যেখানে খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারের গড় বয়স টেনেটুনে তিন বছর।
ভ্রু কুঁচকানোর কিছু নেই। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগও কম যায় না! বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই লিগে মিটিমিটি জ্বলার অবকাশ নেই কোচদেরও। সবার চেষ্টাই থাকে প্রাণান্ত। নইলে চাকুরী খতম! দুই বছর আগেও কোচ বদল করেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অর্ধেকসংখ্যক ক্লাব। গত মৌসুমে দু'টি কমে আটে নেমে আসে সংখ্যাটা। এর মধ্যে আগের মৌসুমে ম্যানেজার পাল্টানো ক্লাবও আছে! ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ চার লিগ বিবেচনায় কোচদের মেয়াদ রীতিমতো চমকে দেয়ার মতো- মাত্র ১৫ মাস! গত ২৩ বছর বিবেচনায় বর্তমান সময়টাই কোচদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু তাঁর ব্যাপারটাই আলাদা। এখনই বলে দিচ্ছি, বালাইষাট ধরনের কিছু না ঘটলে সামনের বক্সিং ডে’তেও তাঁকে দেখা যাবে আর্সেনালের ডাগ আউটে !
২.
আর্সেন চার্লস আর্নেস্ট ওয়েঙ্গার ,অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই)।
১০৭১ ম্যাচ। ৬১৬ জয়। ২৫০ ড্র। ২০৫ হার। জয়ের হার ৫৪.২১ শতাংশ। সবই আর্সেনালের ডাগ আউটে দাঁড়িয়ে! এই আগস্টেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিজের টানা কুড়িতম মৌসুমে পদার্পন ওয়েঙ্গারের। আর মাত্র একটি ধাপ। তারপর ওয়েঙ্গার আর ফার্গি সমান! ১৯৯২/৯৩ মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ চালুর পর থেকে ২০১২/১৩ মৌসুম-অর্থাৎ মোট ২১ মৌসুম ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা ফার্গিই এখনো পর্যন্ত সবার শীর্ষে। নিকট ভবিষ্যতেই ওয়েঙ্গার এ রাজ্যপাটের ভাগিদার। সেটা তাঁর বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ফুরোনোর মধ্যেই।
১৯ বছর আগে আর্সেনালের দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার আগে জীবনসঙ্গিনী অ্যানিকে ডাহা মিথ্যে বলেছিলেন ওয়েঙ্গার- মাত্র পাঁচ মৌসুম পরই সব চুকেবুকে ফিরে আসবো।
কিন্তু ওয়েঙ্গারের ফেরা হয়নি, আর অ্যানিও তাঁর জীবনসঙ্গীর হাত ছাড়েননি।
৩.
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬; এদিন আর্সেনালে ওয়েঙ্গার-যুগের শুরু। গানারদের ঠিকানা তখন হাইবুরি। তৃতীয় বিভাগে নেমে যাওয়ার দোলাচলে ছিলো ম্যানচেস্টার সিটি। ফিফা সভাপতি হিসেবে সেপ ব্লাটারকে দেখার তখনো বছর দুয়েক বাকি। আর্সেনাল কোচের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পরদিন লন্ডনের সাময়িকী 'ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড' শিরোনাম করেছিলো- ‘আর্সেন হু ?’
সেসময় ওয়েঙ্গার কেবলই জাপান ফেরত নেহায়েত সাদামাটা গোছের একজন ফুটবল কোচ, যার একহারা গড়নে নাকের ওপর চার চোখ! মানে চশমা ব্যবহার করতেন আর কি। প্রথম দর্শনেই খটকা লাগে টনি অ্যাডামসেরও, ''এরকম ফরাসি ভদ্রলোকের ফুটবলজ্ঞান কদ্দুরই বা হবে? চশমা দেখে তো মনে হয় স্কুলশিক্ষক। ইংরেজিটাই ঠিকঠাক বলতে পারে তো!''
প্রায় দুই দশক পর ফুটবলকে দূরদর্শী চোখে দেখতে এখন আর ওয়েঙ্গারের চশমার দরকার পড়েনা। ভাষার ওপরও দারুণ দখল; ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইংলিশ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ আর জাপানিজ ভাষায় কথা বলতে পারেন। প্রমোশন জুটেছে ভক্তদের কাছ থেকেও। ‘স্কুলশিক্ষক’ থেকে ওয়েঙ্গার এখন ‘লা প্রফেসর’। বিশ্বের আনাচে-কানাচে প্রতিভা অন্বেষণের ক্ষেত্রে ভাষার প্রতিবন্ধকতা তার কাছে হেঁট মাথা। লাইবেরিয়ার জর্জ উইয়াহ ওয়েঙ্গারের আবিষ্কার। থিয়েরি অঁরি, কোলো তোরে, অ্যাশলে কোল, রবার্ট পিরেস, সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, হেক্টর বেলেরিন, থিও ওয়ালকট, জ্যাক উইলশায়ার-রাও।
উত্তর লন্ডনে পা রাখার পর থেকে এ পর্যন্ত তার চোখের সামনে ১৫৬ জন ম্যানেজারের ভাগ্য বদল ঘটেছে। এ সময় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বাকি ক্লাবগুলো কমপক্ষে দুইবার ম্যানেজার পাল্টেছে। কিন্তু ওয়েঙ্গার থেকে গেছেন সুপ্রাচীন বটবৃক্ষের মতোই।
৪.
সাফল্যবুভুক্ষু এ যুগে প্রতিটি ক্লাবই একজন ১৩ বছরের ‘লিওনেল মেসি’কে আবিষ্কার কিংবা স্বাক্ষর করানোর স্বপ্ন দেখে থাকে। ওয়েঙ্গার এ পথে হাঁটলেও দর্শনটা বাকিদের থেকে আলাদা। সবাই ‘মেসি’ হতে পারেনা, কিংবা হওয়ার প্রয়োজন নেই ; ন্যূনতম ফুটবলার হয়ে আর্থিক জীবন নির্বাহের পথটা বের করে দেন ওয়েঙ্গার। ‘ফুটবলার বানানোর’- এ নীতিকে মেলানো যায় তার ফুটবল দর্শনের সঙ্গেও।
আর্সেনালে দীর্ঘ ১৯ বছরে মাত্র ১৫ শিরোপা। এর মধ্যে বিরান মরুভূমির মতো কে্টেছে ২০০৪ থেকে ২০১৪! মজার ব্যাপার, এ সময়ই আবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টানা ১৮ মৌসুম খেলার রেকর্ড গড়েছে আর্সেনাল! ধাঁধাটার জবাব লুকিয়ে ওয়েঙ্গারের ফুটবল চেতনায়, ‘শুধুই জয় নয়, বরং একটা স্টাইল বজায় রেখে যারা জিততে পছন্দ করে, তাদের দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হই। যদি একজন ভক্ত সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবে - আহা! আজ আর্সেনালের ম্যাচ; হয়তো অসাধারণ কিছু দেখা যাবে। তাহলেই আমার দায়িত্ব পালন সার্থক। যদি ম্যাচটা জিতে নিই, তাহলে খুব ভালো। কিন্তু তা না হলেও ন্যূনতম ধারাবাহিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মজাটা সবাই যেন পায়।’
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা জয়ের নেপথ্যে অর্থের ভূমিকা স্পষ্ট - এ কথাটা প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে বুঝিয়ে দেয়া ব্যক্তিটিও ওয়েঙ্গার। ২০০৩ সালের এফএ কাপ ফাইনালে হারের পর ইংলিশ গণমাধ্যম রায় দেয়, আর্সেনালের মৌসুম ব্যর্থ। তার জবাবে ওয়েঙ্গার যা বলেছিলেন, সেটা এখন ক্লাব ফুটবল পুরাণের অংশ, ‘আমরা অবশ্যই লিগ জিততে চাই। কিন্তু আমার মনে হয় একটি ক্লাবের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আমরা এক্ষেত্রে অবিশ্বাস্যরকম ধারাবাহিক। এমন একটি দলের (ম্যান ইউনাইটেড) কাছে লিগ হেরে যাই, যারা প্রতি বছর ৫০ শতাংশ পরিমান বেশি অর্থ খরচ করে আমাদের তুলনায়। গত বছর তারা চ্যাম্পিয়নশিপ হেরেও ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের খেলোয়াড় দলে টেনেছে। আমি জানি আগামী মৌসুমেও তারা ঠিক একই কাজ করবে। এমন দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা টিকিয়ে রাখাই তো অলৌকিক ব্যাপার!’
৫
৩০ সেপ্টেম্বর আর্সেনালে ১৯ বছর পূর্ণ হলো ওয়েঙ্গারের। বর্তমানে এক ক্লাবে সবচেয়ে বেশি সময় থাকা কোচও তিনি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এ তালিকায় দ্বিতীয় ব্রেন্ডন রজার্সের সঙ্গে ওয়েঙ্গারের ব্যবধানটা প্রায় ১৬ বছরের! গত জুনে লিভারপুলে চতুর্থ বছরে পা রাখেন রজার্স। সত্যি বলতে ফুটবলের এই যাযাবর যুগে বহুদিন এক ক্লাব আঁকড়ে ধরে থাকার উদাহরণ যেমন বিরল, তেমনি এর পথটাও ভীষণ কঠিন। ভাগ্য আর অপরের অনুমোদনের হ্যাপা কম নয়।
ওয়েঙ্গারের ফুটবল দর্শন তাই এরকম, ‘চাকুরীর আয়ু শুধু কোচদের ওপরই নির্ভর করে না। আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যখন এ সমাজের চাহিদা সবসময়ই নতুন কিছু। এখনো বিশ্বাস করি স্থায়িত্ব, সাযুজ্য, ক্লাবের ইতিহাস আর মূল্যবোধের মতো ব্যাপারগুলো কাউকে না কাউকে বহন করতেই হয়। একটা ক্লাব তখনই সেরা অবস্থানে পৌঁছায়, যখন তার এমন কেউ থাকে যে নিজের দায়িত্ব সমন্ধে ওয়াকিবহাল আর তা পালনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করতে জানে।’ খুব বিরল হলেও ওয়েঙ্গারের মধ্যে দুর্দান্ত সম্মেলন ঘটেছে এ দুটি অনুমিতির। যে কারণে আজ তিনি আস্থার মতো মহামূল্য পুঁজি বিনিয়োগের ‘ট্রেডমার্ক’ ব্রান্ড। ঠিক যেমনটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ছিলেন ফার্গি, মিলানে বুট পায়ে পাওলো মালদিনি; আর্সেনালেও তেমনি ওয়েঙ্গার-এক বৃন্তের দুই কুসুম।
আর্সেনালে যোগ দিয়ে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমেই জিতে নেন ‘ডাবল’ (লিগ ও এফএ কাপ)। এসব খুঁজে পাবেন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু সেখানে যা নেই তা হলো, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সেরা কিছু স্কোয়াডের জন্মদাতা ওয়েঙ্গার; সেটা আবার তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে! যখন আবার কীনা আর্সেনাল ছাড়ার ভূত চেপেছিলো তাঁর মাথায়, ২০০১ সালে। তখন বার্সায় যোগ দিলে এখন কোথায় থাকতেন কে জানে! কোত্থেকে কি বুঝে উল্টো গানারদের সঙ্গে চার বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করার পর আবারও জিতে নেন ‘ডাবল’! কিন্তু ইতিহাস গড়ার তখনো বাকি। ২০০৩-০৪ মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নেয় আর্সেনাল। পুরো মৌসুমে কোন ম্যাচ না হেরেই !
২০০৯ সালে ওয়েঙ্গার একবার তার ‘দ্য ইনভিন্সিবলস’ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোন সন্দেহ নেই গোটা মৌসুম অপরাজিত থাকাটা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অর্জন। আপনি চ্যাম্পিয়ন হলেও জানেন একদিন অন্য কেউ এসে জায়গাটার দখল নেবে। গোটা মৌসুম অপরাজিত থাকার স্বপ্নটা তাই দেখেছি আমি। কারণ এ জায়গাটায় সবাই উঠতে পারেনা।
কোন ম্যাচ না হেরে ইংলিশ লিগ জয়ের রেকর্ডটা প্রথম গড়ে প্রেস্টন নর্থ এন্ড। ১৮৮৮-৮৯ মৌসুমে ২২ ম্যাচের লিগে। ১১৫ বছর পর ২০০৩-০৪ মৌসুমে রেকর্ডটায় ভাগ বসায় ওয়েঙ্গারের আর্সেনাল। পার্থক্য হলো লিগ আর এফএ কাপ দিয়ে ২৭ ম্যাচ অপরাজিত ছিলো প্রেস্টন। ওয়েঙ্গারের দল হারেনি টানা ৪৯ ম্যাচ !
৬.
হাইবুরি থেকে ব্যয়বহুল এমিরেটস স্টেডিয়ামে স্থানান্তরের সময় থেকে এখনো পর্যন্ত আর্সেনালের দেনা শোধের ক্ষেত্রে কাজে লাগছে ওয়েঙ্গারের ট্রান্সফার পলিসি। ২০০৭ সালে এক জরিপে উঠে আসে, ওয়েঙ্গারই ইংলিশ ট্রান্সফার বাজারে লাভবান একমাত্র কোচ! এক্ষেত্রে নিকোলাস আনেলকার উদাহারণ টানা যায়; মাত্র ৫ লাখ পাউন্ডে ফরাসি স্ট্রাইকারটিকে কেনার দুই বছর পর ওয়েঙ্গার তাকে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে বিক্রি করেন ২৩.৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যে!
মৌসুমের পর মৌসুম ধরে ট্রান্সফার বাজার থেকে ওয়েঙ্গারের তুলে আনা অর্থে আর্সেনালের দেনা শোধের পাশাপাশি ক্লাবটির পায়ের তলে মাটিও শক্ত হচ্ছে। যেমনটা এবারও, বিশ্বমানের পিওতর চেকের জন্য ১৭ মিলিয়ন ডলার খরচ করার পাশাপাশি এর চার-তৃতীয়াংশ অর্থে কিনে নেন আরও ১১ জন ক্ষুদে প্রতিভাকে। ওয়েঙ্গারের লক্ষ্যটা পরিষ্কার - তাদের ফুটবলার বানিয়ে ট্রান্সফার বাজারে বিক্রি করে গানারদের আর্থিকভাবে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। যদিও ওয়েঙ্গারের দলবদলের নীতি নিয়ে অনেক সমালোচনাই আছে। আর্সেনাল গত কয়েক মৌসুম ধরে শিরোপাজয়ী দল গড়তে পারছে না- এমন অভিযোগও অনেক ফুটবল বিশ্লেষকদের।
ওয়েঙ্গার তাই শুধুই একজন কোচ নন।
একজন ফুটবল দার্শনিক। প্রজ্ঞাবান ট্যাকটিশিয়ান। পাকা জহুরী। একজন ক্যাথলিক, যার কাছে ফলাফল কখনোই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায়নি। আর্সেনালের আস্থার বাহক। ক্লাবটির ভবিষ্যত সমৃদ্ধির কান্ডারি।
ইংলিশ ফুটবলের শেষ ক্রুসেডার !