• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    স্পেশাল ওয়ানের স্পেশাল ওয়ার

    স্পেশাল ওয়ানের স্পেশাল ওয়ার    

    অক্টোবর ২০১৬, অ্যানফিল্ড। দুই মাস আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ হয়েছেন হোসে মরিনহো। তখনও সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেননি দল নিয়ে। প্রিমিয়ার লিগের পয়েন্ট তালিকায় ৬ নম্বরে মরিনহোর দল। আর ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল টানা ৫ ম্যাচ জিতে দারুণ ছন্দে। সেই দলকেই তাদের মাঠে আটকে দিলেন মরিনহো। গোলশূন্য ড্র ম্যাচে মনে রাখার মতো আক্রমণও হলো না একটিও। মরিনহোর পুরনো সেই ধার যে হারিয়ে যায়নি, সেটার প্রমাণ আরও একবার রাখলেন। আপনি যদি ফল চান, তাহলে মরিনহোই আপনার টোটকা। সেই সত্যিটা আরেকবার প্রমাণ হলো নতুন করে।  

    পরের বছর  ইউনাইটেডের অ্যানফিল্ড যাত্রার সময় দুই দলের অবস্থা গেল উল্টে। শেষ ৮ ম্যাচে জয় নেই লিভারপুলের। ইউনাইটেড শীর্ষস্থানের জন্য তাড়া করছে ম্যান সিটিকে। কিন্তু এবারও ছক বদলালেন না মরিনহো। আরও একটি গোলশূন্য ড্র নিয়ে ফিরলেন লিভারপুল থেকে। ম্যান সিটির সঙ্গে সেই যে ব্যবধান বাড়ল, সেটা কেবল বেড়েই গেল সময়ের সাথে।   

    দ্বিতীয় হয়ে মৌসুম শেষ করা ইউনাইটেড ম্যানেজার অবশ্য বললেন এটা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অর্জন। খটকা লাগার মতোই, যে ম্যানেজার দুইবার জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ, যে ক্লাবে গেছেন সেখানেই লিগ জিতেছেন- তার জন্য দ্বিতীয় হওয়াটা সাফল্য হয় কেমন করে? মরিনহো আর ম্যান ইউনাইটেডের শেষের শুরু সেখান থেকেই। চলতি মৌসুম শুরুর আগে দলবদল নিয়ে অসন্তোষ ছিল মরিনহোর। বোর্ডের সঙ্গে সম্পর্কটা যে মধুর না তা বোঝা গেছে বেশ কয়েকবার। মনমতো সব খেলোয়াড় সবসময় পান না ম্যানেজাররা। সে বাস্তবতা মেনে নিতে চাননি মরিনহো। সেটাকে ইস্যু বানিয়ে বোর্ডের সঙ্গে নিজের দূরত্ব বাড়িয়েছেন আরও। এরপর রোলার কোস্টার মৌসুমের মাঝপথে এসে সেই অ্যানফিল্ডেই লেখা হয়ে গেল মরিনহোর ইউনাইটেড অধ্যায়ের এপিটাফ।

     

     

    লিগের ১৭ ম্যাচে ইউনাইটেডের গোলব্যবধান ঋণাত্মক। গোল হজম করেছে ২৯ টি, আগের মৌসুমের পুরোটা জুড়েও এর চেয়ে এক গোল কম খেয়েছিল ইউনাইটেড। ডার্বি কাউন্টির কাছে হেরে লিগ কাপ থেকে বিদায়। চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্ব কোনোমতে উতরে গেলেও, দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রতিপক্ষ পিএসজির যোজন পিছিয়ে ইউনাইটেড। এসব কিছুই মরিনহোকে বরখাস্তের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা দিচ্ছে।

    তৃতীয় মৌসুমের গেরোটা তাই আরেকবার কাটাতে পারলেন না মরিনহো। চেলসিতে দ্বিতীয় দফায় গিয়েও তৃতীয় মৌসুমের মাঝপথেই বরখাস্ত হয়েছিলেন। এর আগে রিয়াল মাদ্রিদে নিজের তৃতীয় মৌসুমে শিরোপাশুন্য থেকে বিদায় নিয়েছিলেন স্পেন থেকে। ইন্টার মিলানে অবশ্য দুইটি শিরোপায় মোড়ানো মৌসুম কাটিয়েছিলেন। তৃতীয় মৌসুম আসার আগে নিজেই ছেড়ে গিয়েছিলেন ক্লাব। আর চেলসির সঙ্গে প্রথমবার সম্পর্কছিন্ন হয়েছিল রোমান আব্রাহিমোভিচকে তৃষিত চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা না এনে দিতে পেরে।

     

    মরিনহোকে ফুটবলের দার্শনিক বলা যায়। ক্যারিয়ারের শুরুটা আরেক জায়গায় হলেও, পোর্তোকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেই তার উথান। এরপর চেলসিতে এসে স্বঘোষিত ‘স্পেশাল ওয়ান’ আসলেই প্রমাণ করেছেন তিনি আলাদা একজন। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করার পর কোচিং মনোযোগ দেন নামকরা প্রায় সব খেলোয়াড়েরাই। মরিনহো সেক্ষেত্রে একজন ‘আউটসাইডার’। যিনি বাইরে থেকে এসেও ফুটবলকে বদলে দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসে। কিন্তু যে ইতিহাস নিজেই লিখেছিলেন, সেটাই কি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য?

    ফুটবল বিবর্তনের যুগে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি মরিনহো। প্রিমিয়ার লিগে পেপ গার্দিওলা, ইয়ুর্গেন ক্লপ, মারুসিও পচেত্তিনোর দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের জোয়ারে মরিনহোকে মনে হয়েছে সাদামাটা। প্রেসিং যদি একটি ফুটবল দর্শন হয়, সেক্ষেত্রে মরিনহোর ডিফেন্সিভ অ্যাপ্রোচটাও যে আলাদা একটা দর্শন- সেটাও তাই ভুলে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে, ফল নির্ভর ফুটবলে যদি ফলটাই যদি পক্ষে না আসে তখন আর কি করার থাকে? মরিনহোর পক্ষে স্বাক্ষী হতে পারত তার শিরোপা ভান্ডার। ম্যানচেস্টার এসেও প্রথম মৌসুমে দুই শিরোপা জিতেছিলেন। ক্লপ, পচেত্তিনোরা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে আছেন যে যার ক্লাবে, শিরোপা জোটেনি একজনের কপালেও। তারপরও সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে ক্লপরা এগিয়ে আছেন অন্য  মাপকাঠিতে। বড় ক্লাবগুলোর জন্য শিরোপা জেতার মতো ক্রমাগত উন্নতি করে যাওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ইউনাইটেডের আড়াই বছরে উন্নতির পথটাই খুঁজে পাননি মরিনহো।

     

    নিজের কৌশলের বিবর্তনটাও ঘটাতে পারেননি মরিনহো। রিয়ালের তৃতীয় মৌসুম থেকেই তার সাফল্যের গ্রাফ নিম্নগামী। মাঠের কথা বাদ দিলেও, মাঠের বাইরের অবস্থা নিয়ন্ত্রণে মরিনহোকে ব্যর্থও বলা যায়। চেলসিতে তৃতীয় মৌসুমে হারিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমের নিয়ন্ত্রণ। অথচ এই ক্লাবে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। আগের মৌসুমে লিগ জিতেছিলেন প্রায় বলে কয়ে। সেই এডেন হ্যাজার্ডরাই বেঁকে বসেছিলেন মরিনহোর অধীনে খেলতে। ওল্ড ট্রাফোর্ডের ড্রেসিংরুমেও সেই একই ঘটনা। দল হিসেবে শিরোপার দাবিদার বলা যায় ইউনাইটেডকে। সেটা অবশ্য কাগজে কলমে। কারণ মরিনহোর অধীনে প্রায় সব খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স রঙ হারিয়েছে। এবার পল পগবাকে ধরা হলো মরিনহোর মূল প্রতিপক্ষ। দুইজনের রেষারেষি হয়ত প্রভাব ফেলল মরিনহোর বিদায়েও। যে দেশে, যে ক্লাবেই গেছেন, দ্বিতীয় মৌসুমে লিগ জিতেছেন- সে ধারাতেও ছেদ পড়েছে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে থিয়েটার অফ ড্রিমসে এসে মরিনহো ফিরেছেন তাই দুঃস্বপ্ন সঙ্গী করে। তাহলে আধুনিক ফুটবলের যুগে মরিনহোকে কি সেঁকেলে হয়ে গেলেন হুট করেই?

    শিরোপা ক্ষুধা মিটে গেলে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত সাফল্যের দিকে নজর যায়। অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক ফুটবলে তখন ফরোয়ার্ডদের ডিফেন্সিভ ডিউটি পালনে অনীহা সৃষ্টি হতেও পারে। সেখান থেকে শুরু দ্বন্দ্ব, এরপর ড্রেসিংরুমে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়া রেষারেষি। অন্তত নাম না জানানো সংবাদ দাতাদের খবর তাই বলে।

     
    যে কোনো মূল্যে জয় চাই- এই দর্শনের ফুটবলে সাফল্যের স্থায়ীত্ব নিজেই প্রমাণ করতে পারেননি মরিনহো। মাঝে সাঝে ক্লাব ও খেলোয়াড়দের আড়াল করে নিজেই নায়ক বনে যাওয়া হয়ত মানায়, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে আর ফলপ্রসূ হয় না সেটা। চেলসি থেকে দ্বিতীয় দফায় বরখাস্ত হয়ে নিজেকে প্রমাণে আরও সচেষ্ট হয়ে যাওয়া মরিনহো ইউনাইটেডেও তাই করেছেন একই ভুল। চেলসিতে কাটানো সময় থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকলে এমনটা নাও ঘটতে পারত মরিনহোর কপালে। 

    ইউনাইটেড আর মরিনহোর সম্পর্কের শুরু থেকেই একটা দ্বন্দ্ব ছিল। যে মূলনীতির ওপর ইউনাইটেড দাঁড়িয়ে, তার উলটো দর্শনে বিশ্বাসী মরিনহো। সম্পর্কটা যে সৌরভ ছড়াবে না সেটা জানাই ছিল। কিন্তু মরিনহো তো নিজেকে বারবার প্রমাণেও বিশ্বাসী। ভরসা ছিল সেটাই। সে যুদ্ধে হেরেছেন মরিনহো। ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর সুনজরও কি হারালেন সেই সঙ্গে? হয়ত। মরিনহোর বাণিজ্যিক চাহিদার কথা মাথায় রাখলে তার আবেদন কমার কথা না। কিন্তু মরিনহো কি সেটা চাইবেন? ফুটবলকেই যিনি জীবনের ধ্রুবতারা করেছেন, তিনি কেন এভাবেই পন্য হয়ে বিকোতে চাইবেন? 

    চেলসিকে নিজ হাতেই গড়েছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদে গিয়েও টিকতে পারেননি। চেলসিতে যখন ফিরলেন, ততোদিনে তারাও উন্নতি করে ফেলেছে আরও। সেখানেও আর টেকা হয়নি মরিনহোর। একমাত্র ইন্টার বা পোর্তোই হতে পারে মরিনহোর নতুন ঠিকানা। সবকিছু মাথায় রেখে হুট করে হয়ত এখনই পোর্তোতে  যাবেন না মরিনহো, সেক্ষেত্রে ইন্টার থাকে একমাত্র অপশন। সেখানে তাকে বরণ করা হবে উদযাপন করেই। কিন্তু তার আগে কি এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে স্পেশাল ওয়ানের? ট্যাকটিক্যালি হয়ত ভুল ছিলেন না, কিন্তু প্রয়োগ বিধিতে গলদ ছিল- অন্তত সেই সত্যিটা কি অনুধাবন করবেন মরিনহো?

    কোচদের বরখাস্ত হওয়ার রীতিটা যতই স্বাভাবিক ঘটনা হোক না কেন, মরিনহোর মাপের কারও জন্য সেটা তো সম্মানের হানিও। নিজেকে ঢেলে সাজানোর আগে অন্তত নিজের বিশ্বাসের ভিত্তিটা আরেকবার যাচাই করবেন তিনি? একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটালে এবার ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারটাই হয়ত শেষ হয়ে যেতে পারে মরিনহোর। স্পেশাল ওয়ানের যুদ্ধটা এবার তাই নিজের সঙ্গেই। হারানো জৌলুস ফিরে পাওয়ার লড়াই, স্পেশাল ওয়ানের স্পেশাল ওয়ার।