চ্যাম্পিয়নদের ঘরে পরাজিত লিভারপুল
শেষদিকে দুইজন ডিফেন্ডার নামাতে হয়েছিল পেপ গার্দিওলাকে। আক্রমণই যার প্রধান অস্ত্র সেই ম্যানেজারও যে কোনো মূল্যে ম্যাচ জেতার লক্ষ্য নেমেছিলেন। নামতেই হত গার্দিওলাকে, লিভারপুলের কাছে ইতিহাদে হেরে গেলে শিরোপা স্বপ্ন এখানেই হয়ত ইতি টানতে হত সিটিজেনদের। বড় পাথরটা নেমে গেছে গার্দিওলার বুক থেকে। স্বস্তি ফিরেছে ইতিহাদেও। ২০ ম্যাচ অপরাজিত থেকে লিগের শীর্ষে থাকা লিভারপুলকে অবশেষে হারাতে পেরেছে কোনো দল। গত বছর এই জানুয়ারি মাসেই সিটিজেনদের অপরাজেয় যাত্রা শেষ হয়েছিল অ্যানফিল্ডে। এবার ঘটল উলটোটা। প্রতিশোধও নেওয়া হল সিটিজেনদের। চ্যাম্পিয়নদের মাঠে লিভারপুল হারল ২-১ গোলে। তাতে পয়েন্ট তালিকায় দুইদলের ব্যবধান দাঁড়াল ৪ এ।
ইতিহাদের প্রথমার্ধটা প্রত্যাশার তুলনাও ছিল বেশি ঘটনাবহুল। প্রথমার্ধ গোল হয়েছে একটি, সেটাও পেয়েছিল সিটি। কিন্তু বাকি সবকিছুর বিচারে নিজেদের দুর্ভাগা ভাবতেই পারে লিভারপুল। ১৮ মিনিটে মিডফিল্ডে দারুণ এক আক্রমণ সাজিয়ে তার সফল পরিণয়টাও প্রায় দেখেই ফেলেছিল তারা। আক্রমণের ত্রয়ী সালাহ-মানে-ফিরমিনোর দারুণ সমন্বয়ই তৈরি করে দিয়েছিল সুযোগটা। সালাহ-ফিরমিনোর ওয়ান টু, পরে সালাহর থ্রু বল সাদিও মানের উদ্দেশ্যে। ডিবক্সের ভেতর ঢুকে পড়া মানে এগিয়ে আসা গোলরক্ষক এডারসন মোরায়েসকে সুযোগ না দিয়েই করলেন শট। সেটা বারপোস্টের কোণায় লেগে ফেরত আসলো। ফিরতি বল ক্লিয়ার করতেই জন স্টোনস আর এডারসন মুখোমুখি হয়ে গেলেন। স্টোনস ক্লিয়ার করতে চেয়েছিলেন, এডারসন চেয়েছিল বল ধরতে। পরে এডারসনের গায়ে লেগে সেই বল প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিল সিটির জালে, সালাহও এগিয়ে আসছিলেন আরেকদিক থেকে। শেষে স্টোনসই বল ক্লিয়ার করেছেন গোললাইন থেকে। বল আর ১.১২ সেন্টিমিটার বেশি দূরত্ব অতিক্রম করলে তখনই আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে যেতে পারত লিভারপুল।
সাম্প্রতিক সময়ে রঙ হারিয়ে ফেলা সিটি লিভারপুলের বিপক্ষেও ধুকছিল প্রথমার্ধে, আক্রমণভাগে তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিল না তারা। বাম পাশ দিয়ে লিরয় সানে কয়েকটি নিষ্ফলা সুযোগ তৈরি করেছিলেন। সানে সাহায্য পাননি মেক শিফট লেফটব্যাক হয়ে খেলতে নামা আয়মেরিক লাপোর্তের কাছ থেকেও। ২৮ মিনিটে অবশ্য ডান প্রান্ত দিয়ে রাহিম স্টার্লিং একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন ডেভিড সিলভাকে। কিন্তু ভালো জায়গায় বল পেয়েও সিলভার ডান পায়ের দুর্বল শট ব্লকড হয় ভার্জিল ভ্যান ডাইকে।
ম্যাচের আধঘন্টা পেরুতেই বড়সড় বিপদে পড়ে যেতে পারত সিটিজেনরা। মোহামেদ সালাহকে দুই পায়ে ফাউল করে বসেছিলেন ভিনসেন্ট কোম্পানি। সিটি অধিনায়কের অবশ্য ভাগ্য ভালো ছিল, রেফারি অ্যান্থনি টাইলর হলুদ কার্ড দেখিয়েই ছেড়ে দিয়েছেন তাকে। প্রথমার্ধ শেষে ওই সিদ্ধান্তটা আরও বড় মনে হয়েছে সার্জিও আগুয়েরোর দারুণ এক মুহুর্তের জন্য। আগুয়েরোকে ছাড়া এতোদিন ভুগছিল সিটিজেনরা। আগুয়েরো ফিট হয়েছেন বেশ কয়েকদিন আগেই। আর ঘরের মাঠে লিভারপুল তো তার পছন্দের প্রতিপক্ষ। আগের ৬ দেখাতেই গোল করেছিলেন এই ফিক্সচারে, সেই সংখ্যাটা টেনে নিয়ে গেলেন ৭ এ। ৪০ মিনিটে বাম প্রান্ত থেকে সানেই শুরু করেছিলেন আক্রমণ। আগুয়েরো পেনাল্টির আবেদনও করেছিলেন। রেফারির সাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ততোক্ষণে বাম প্রান্ত থেকে আবারও ক্রস করেছেন বের্নার্দো সিলভা। কোণাকুণি অ্যাঙ্গেল থেকে প্রথম টাচে বল উঠিয়ে পরের দফায় করলেন বাম পায়ের জোরালো শট। ওই অ্যাঙ্গেল থেকে গোল করার চেয়ে গোল ঠেকানোই সহজ। কিন্তু অ্যালিসন সুযোগই পেলেন না আগুয়েরোর কাছে। ডেয়ান লভ্রেনও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। সিটিজেনদের মূল ভরসা সেই আগুয়েরোই স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন সমর্থকদের।
দ্বিতীয়ার্ধেও স্বস্তি কিছুটা বেশি ছিল পেপ গার্দিওলার ডাগ আউটে। বিরতির পর প্রথম দশ মিনিটে বেশ কয়েকটি আক্রমণও করেছিল সিটিজেনরা। একটা পেনাল্টির আবেদনও ছিল এর মধ্যে। অবশ্য রেফারি সঠিক সিদ্ধান্তই দিয়েছিলেন সে সময়। ম্যাচ শুরুর আগেই সিটির ফুলব্যাকের সমস্যাটা জানা ছিল। আক্রমণে খুব বেশি মনোযোগী নন কেউই। কাইল ওয়াকারের জায়গায় গার্দিওলার দানিলোকে খেলানোর সিদ্ধান্তটাও একরকম জুয়াই ছিল। লিভারপুলের দুই ফুলব্যাকও প্রথমার্ধে দলকে আক্রমণে সাহায্য করেননি খুব বেশিবার। ওই দুইজন যখন উঠলেন তখনই জ্বলে উঠল লিভারপুলও।
৬৩ মিনিটে একবার গোলরক্ষকের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল কোম্পানির, তাতে রবার্তো ফিরমিনো বল পেয়ে গিয়েছিলেন ডিবক্সের ভেতর। ফাঁকা বারে পরে কোম্পানির গায়েই মেরেছিলেন ফিরমিনো। মিনিটে খানেক পর আর মিস করলেন তিনি। অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড ডান প্রান্ত থেকে ক্রস করলেন, দানিলো নিজের জায়গা থেকেই নড়েননি। লেফটব্যাক অ্যান্ডি রবার্টসন তাই ডিবক্সের ভেতর ঢুকে পেলেন সেই ক্রস, ভলিতে করলেন আরেক ক্রস। এবার ফাঁকায় থেকে হেডে সহজ ফিনিশে লিভারপুলকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন ফিরমিনো।
চ্যাম্পিয়নদের জবাব দিতে অবশ্য এরপর খুব বেশি সময় লাগেনি। ৭২ মিনিটে স্টার্লিং কাছ থেকে বল পেয়ে বাম পায়ের শটে গোল করে সানেই করেন জয়সূচক গোলটি। কিন্তু ম্যাচের বাকি ১৮ মিনিটেও অনেকভাবেই রঙ বদলাতে পারত ম্যাচ। অ্যালিসন দুর্দান্ত কিছু সেভ করেছেন। আগুয়েরো, বের্নার্দো সিলভাকে নিশ্চিত গোল পেতে দেননি। দুই ঘটনার মাঝে এডারসনও অবশ্য সালাহর শট ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন ৮৪ মিনিটে। কিন্তু জের্দান শাকিরিদের নামিয়েও দ্বিতীয় দফায় পিছিয়ে পড়ার পর সেভাবে আর ফেরার সুযোগ তৈরি করতে পারেনি লিভারপুল। অন্যপ্রান্তে শেষদিকে সহজ সুযোগ নষ্ট করেছেন স্টার্লিংও। ডেয়ান লভ্রেনের ভুল থেকে প্রথমে সিলভার শট ঠেকান অ্যালিসন, ফিরতি বলে স্টার্লিং ফাঁকা বারেও মারতে পারেননি লক্ষ্যে। নইলে অ্যাডিশনাল টাইমের ৫ মিনিট আরেকটু স্বস্তিতেই কাটাতে পারতেন গার্দিওলা!
জয়ের পর শিরোপার আশা তো ফিরেছেই, গার্দিওলার একটা গেরোও কেটেছে। ক্লপের কাছে যতবার হেরেছেন, ক্যারিয়ারে এতোবার আর কারও কাছে হারেননি। শেষ চার ম্যাচের মধ্যে তিনবারই অপদস্থ হয়েছেন ক্লপের কাছে, আরেকবার করেছেন ড্র। লিভারপুলকে কয়েকদিন আগে গার্দিওলা বলেছিলেন সময়ের সেরা দল। চাপটা আগে থেকেই বদলি করে রেখেছিলেন প্রতিপক্ষের ঘাড়ে, লিভারপুলকে হারিয়ে এখন সত্যি সত্যিই চাপে ফেলে দিলেন ক্লপকে।