মাশরাফি এবং 'ম্যাডনেস ইজ ইন দ্য লেংথ'
‘ম্যাডনেস ইজ ইন দ্য লেংথ’, বা ‘খ্যাপাটে যা কিছু, সবই ওই লেংথে’
-শোয়েব আখতার
ইতিহাসের অন্যতম দ্রুত পাকিস্তানী ফাস্ট বোলার কদিন আগে কথাটা বলেছিলেন উত্তরসূরী মোহাম্মদ আব্বাসকে নিয়ে। আব্বাসের সঙ্গে তার গতির পার্থক্য বেশ বড়সড়, তবে শোয়েব মনে করিয়ে দিয়েছিলেন পেস বোলিংয়ের মূল আকর্ষণটা। পেস আপনাকে পরাজিত করবে, আর লেংথ আপনাকে দেবে ধোঁকা। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহগোছের একটা বলও তাই হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর। আর সেই লেংথের সঙ্গে যদি যোগ করা হয় কাটারের ধার বা স্লোয়ারের দীর্ঘসূত্রিতা, তাহলে তো কথাই নেই! বোলারের কাছে পেসে পরাজিত ব্যাটসম্যানের চেয়ে তাই কোনও অংশে কম নয় লেংথ থেকে ওঠা বল আগবাড়িয়ে খেলতে গিয়ে ব্যাটসম্যানের ধোঁকা খাওয়ার দৃশ্যটা।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে যে চারটি উইকেট নিয়ে টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করলেন মাশরাফি, সবকটিই ওই ‘খ্যাপাটে লেংথ’-এর কান্ড।
তামিম ইকবাল বলটাকে স্লটে ভেবে লাইন ধরেই খেললেন। আগের বলটা শর্ট ছিল, এবার মাশরাফি ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন স্পিনারদের মতো করে, তামিম বলের পিচিংয়ে পৌঁছাতে না পেরে ধোঁকা খেলেন। টাইমিংটা ঠিকঠাক হলো না তাই। তামিম ক্রিজ ছাড়লেন শ্যাডো করতে করতে, কিভাবে খেলা উচিৎ ছিল তার সেটা ভাবতে ভাবতে।
ইমরুল লেংথ থেকে ওঠা অফকাটারটা বুঝতেই পারেননি, অনসাইডে খেলতে গিয়ে আউটসাইড-এজে ধরা পড়লেন পয়েন্টে! এভিন লুইসও তুলে মেরেছিলেন, মার খেয়ে গেলেন মাশরাফির কমিয়ে আনা লেংথেই। যদিও ম্যাচশেষে স্মিথের উইকেটটার চেয়ে তামিমেরটা মূল্য একটি বেশি বলছেন মাশরাফি, তবে স্মিথের ধোঁকা খাওয়ার দৃশ্যটা যে কোনও বোলিংপ্রেমী দর্শককেই আলোড়িত করবে। অফস্টাম্পের বাইরে স্লোয়ার, ইনসাইড-আউট খেলার চেষ্টারত স্মিথ শটের পজিশনে চলে এলেন আগেভাগেই। পরিণতি তামিম-ইমরুল-লুইসের মতোই।
এই খ্যাপাটে লেংথের গুণগাণের সঙ্গে মনে করতে হবে, বোলারের উইকেট পড়তে পারার ব্যাপারটাও। বিশেষত যখন স্লোয়ার কাটারের ব্যাপার থাকে, তখন উইকেট বুঝতে পারার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়তো খুব কম কিছুই আছে। কুমিল্লার বিপক্ষে ম্যাচে প্রথম বল থেকেই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন মাশরাফি, “প্রথম বল করার পর আমার কাছে মনে হয়েছে যে উইকেটে ডাবল পেস (টু-পেসড উইকেট) হওয়ার চান্স আছে। ওইখান থেকে মনে হচ্ছিল যে ঠিক লেংথে হিট করতে পারলে ভালো কিছু হবে এই উইকেটে। সৌভাগ্য যে আমরা দ্রুত উইকেটগুলো নিতে পেরেছি। খালি উইকেট পেলে তো হয় না, ঠিক লেংথে বল করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার পরে যারা এসেছে সবাই ঠিক জায়গায় বলটা করতে পেরেছে।”
২৪টি বৈধ বলের মাঝে এদিন অন্তত ১৮টি মাশরাফি করেছিলেন ওই লেংথে।
আর কাটারের ব্যাপারে তিনি বলছেন, বল পিচ করাতে চেয়েছেন জোরের ওপর, “আমি হিট করতে চেয়েছি জোরে। ঠিক জায়গায় বল করতে পেরেছি সবাই, এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সবাই ভালো বল করেছে।”
চারটি উইকেট নিয়েছেন, এর মধ্যে তিনটিই পাওয়ারপ্লের ভেতরে। কুমিল্লার লম্বা ব্যাটিং লাইন-আপও মূলত খেই হারিয়েছে তখনই। তবে স্মিথ বা অন্য দুইটির চেয়ে মাশরাফি এগিয়ে রাখছেন তামিমের উইকেটটা, “চার উইকেটের ভেতরে অবশ্যই তামিমের উইকেটটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্মিথেরটাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তামিম সবসময় আমাকে ভালোভাবে সামলেছে। একটা দীর্ঘ সময় ধরে, তা টি-টোয়েন্টি, পঞ্চাশ ওভার বা দীর্ঘ সংস্করণ- যাই বলুন না কেন, ও আমাকে ভালভাবে খেলে। স্ট্রাইক রেটও ভালো থাকে আমার বিপক্ষে। সে উইকেটটা অবশ্যই আমার জন্য ইতিবাচক ছিল তাই। যেহেতু ও আমার বিপক্ষে সবসময় সফল থাকে, ওর উইকেটটা নেওয়ার কারণে আমার আত্মবিশ্বাসের জন্য ভালো হয়েছে। তারপরে স্মিথ, লুইস, ওরা কী করতে পারতে পারে আমরা সবাই জানি। তবে আমার ক্ষেত্রে তামিমের উইকেটটার গুরুত্ব (বেশি) ছিল।”
টি-টোয়েন্টিতে এর আগে একবার চার উইকেট পেয়েছিলেন, সেটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে। এবার সেটিকে ছাড়িয়ে গেলেন। তবে আন্তর্জাতিক ম্যাচকেই সবসময় এগিয়ে রাখতে চান ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়া মাশরাফি, “আমি যখন যেটা খেলছি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে খেলার চেষ্টা করি। কিন্তু যদি আপনি বিশেষভাবে বিবেচনা করার কথা বলেন, তাহলে আমি শুধু আন্তর্জাতিক ম্যাচকেই গোণায় ধরি।”
তবে যে পর্যায়েই হোক, একবার শুধু দৃশ্যটা ভাবুন।
তামিম- তর্কসাপেক্ষে দেশের সেরা ব্যাটসম্যান- আজ ধুঁকলেন মাশরাফির বিপক্ষে। ৬ বল, ২ রান। শেষের বলটিতে চূড়ান্ত ধোঁকা খেয়ে তামিম বেড়িয়ে যাচ্ছেন শ্যাডো করতে করতে। আর মাশরাফির বাড়ছে আত্মবিশ্বাস। মাশরাফি ততক্ষণে উইকেটটা বুঝে ফেলেছেন। ঠিক লেংথটা ধরে ফেলেছেন। যে লেংথে হিট করে যাবেন এরপর।
সবই তো ওই “ম্যাডনেস ইজ ইন দ্য লেংথ” এর ব্যাপার!