না ভোলার ফরাসী সৌরভ
'' তুমি বাংলাদেশের লোক? ঠিক বলছো, সত্যি? ...ওয়াও, তোমাদের বাংলাদেশকে আমি কখনোই ভুলবো না। ...কী, অবাক হচ্ছো শুনে?
একটু ভেবে দেখো, আমাকে যদি মনে থাকে তোমার- তাহলে সত্যি কি পারবে বাংলাদেশকে ভুলে যেতে? আরে, উইলস কাপের কথা মনে নেই? সেই যে, তোমরা যেটাকে মিনি বিশ্বকাপ বলে ডাকছিলে? হ্যাঁ- সেটার ফাইনালে ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট নিয়েছিলাম আমি। সেমিতে দিয়েছিলাম ১০০ বলে ১১৩-র এক বিস্ফোরক। বাংলাদেশকে ভোলার তাই কোন কারণ নেই আমার। ক্রনিয়ের সাথে ট্রফি হাতে নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকছিলাম যখন- তখন থেকেই কানে আসতে শুরু করলো বাকি ক্রিকেটের দুনিয়ার ফিসফিস– পরের বছরগুলোতে যেটা রুপ নিয়েছে অক্ষম ক্রোধে। ‘হ্যাঁ, প্রোটিয়াদের অলরাউন্ডার আছে বটে একটা !’
আচ্ছা, অলরাউন্ডার বলতে কী বোঝায় বলো তো? ... কী বললে, যে ব্যাটসম্যান আর বোলার- দুই ভূমিকাতেই দলে আসতে পারে? ... তা, এটা অস্বীকার করি কি করে বলো ! একসময় তো দলের হয়ে ব্যাট আর বল দুটোই ওপেন করতাম আমি ! রেকর্ড বই যদি খুলতে বলো- দাঁড়াও- একটু দেখে নেই- ওয়ানডেতে প্রায় ৪৫ গড়ে ১১৫৭৯ রান আর সাথে ২৭৩ উইকেট। আর টেস্টে হচ্ছে- উম- ৫৫ গড়ে ১৩২৮৯ রান, আর উইকেট ২৯২টা। আর ৯০টা রান করলেই পন্টিংকেও পছনে ফেলে টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান করিয়েদের লিস্টে দুই নাম্বারে উঠে যেতাম আমি- সামনে শুধু শচীনই থাকতো। বোলারদের লিস্টিতে অবশ্য আমার সামনে আরো ২৮টা নাম রয়েছে। সেটাতো থাকতেই পারে নাকি? – ওই ২৮ জনের কয়জনকে আর টেস্ট,ওয়ানডে, আর হালের টি টোয়েন্টিতে ব্যাটে-বলে সমান সার্ভিস দিয়ে যেতে হয়েছে দলকে? আমি মাঠে নামার মানে তো আসলে প্রতিপক্ষকে ১২ জনের সাথে লড়াই করতে হয় !
কম দিন তো আর হলো না, ১৮ বছর। হ্যাঁ, সময় নামের ঘাতকটা আমার চেয়েও নীরবে কাজ সেরে যাচ্ছে। টেস্টের আঙিনায় আমার শুরুটা একদমই নড়বড়ে ছিলো-অনেকে বলে, ইনিংস শুরুর দিকে আমি এখনো যেমন থাকি। তবে সময় নিয়ে উইকেটে থিতু হবার পরেই ট্রেডমার্ক ঐ কাভার ড্রাইভ মারা আমার অভ্যাস, আমায় চিনে থাকলে তুমি তো জানোই এই কথা-তাই না? কাজেই প্রথম ২০ টেস্টে যেখানে আমার গড় ছিলো ৩২, একশোতম টেস্টে সেটাকেই টেনে তুলেছি ৫৭-তে। গড়ে প্রতি ছয় ইনিংসে একটা করে সেঞ্চুরি আমার জানো? ঐ অমানুষ স্যার ডন বাদে শচীন বলো, বা দ্রাবিড় কী পন্টিং- এদের কেউই আমার ধারে কাছেও নেই এদিক দিয়ে।... সরি, একটু বোধহয় উদ্ধত শোনালো কথাগুলো, তাই না? সেরকম হলে দুঃখ প্রকাশ করছি।
তুমি তো জানোই, মাঠে কখনোই- তীব্রতম স্লেজিং বা হাত ফসকে ম্যাচ বেরিয়ে যাওয়া মুহূর্তেও কখনো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাই না আমি। আমার অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরির গল্পটাই বলি। ম্যাচ বাঁচানো ছয় ঘন্টার সেই ইনিংসে অজিরা কিছুতেই আমায় আউট করতে না পেরে শেষতক গালিগালাজই শুরু করলো মন খুলে- মনে পড়লে এখনো হাসি পায় আমার! কিন্তু বিশ্বাস করো, এমন কী সেইদিনও দম্ভের বোধটা হয় নি আমার। শুধু অবসরের কথা ভেবেই কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে মনটা।
জানি, অনেক গ্রেট যেটা পারেন নি, সেই নিজের শেষটা আমি নিজেই লিখেছি- স্ব ইচ্ছায়। তবুও, আর ওয়ানডাউনে ব্যাট করবো না- ফার্স্ট স্পেলে পুরনো হলেই গ্রায়েম আমার দিকে লালরঙা বলটা আমার দিকে আর বাড়িয়ে দেবে না, অলস ক্ষিপ্রতায় স্লিপে দাঁড়িয়ে ক্যাচ ধরবো না আর- এসব বিশ্বাস হয়, বলো? ক্রিকেটের কসম, এখনো- এই ৩৮ বছরেও ঘন্টায় ১৪০ কিমিতে বল করতে পারি আমি- কিন্তু এটাও জানি; আমার মানদণ্ড- অন্যান্য গ্রেটদের মতোই যেটার উচ্চতা ঠিক করেছি আমি নিজ হাতে- সেটা এরচেয়েও ঢের উপরে। আমার মনে হয়েছে, অবসরে যাবার এটাই সঠিক সময়...
... বুঝিনি, গ্যারি সোবার্স? ...মানে, স্যার গ্যারির সাথে তুলনা করছো তোমরা আমাকে? ধ্যাত- তাই কখনো হয় ! ...কী বললে, মানে অনেকে পরিসংখ্যান মাথায় রেখে আমাকেই এগিয়ে রাখে? ... হাহাহা। এ যে দেখি পুরো আমার মতোই চমকে দেয়া বাউন্সার দিলে, ব্যাটারের উপায় নেই আউট হওয়া ছাড়া! হাহাহা... পরিসংখ্যানকে তার জায়গাতেই থাকতে দাও। খালি সংখ্যা দেখে কী শিল্পের বিচার চলে? আজ আমি স্যার গ্যারিকে পেছনে ফেলেছি, কাল কেউ আমায় পেছনে ফেলবে হয়তো।
দিনশেষে আমি বিশ্বাস করি- ক্রিকেট নিছক একটা খেলা নয় শুধু। ক্রিকেট ঈশ্বরের দান, জীবনের সবচাইতে কারুকার্যে ভরা শিল্প। শুধু জানি, মনের খিদে মেটানোর সেই শিল্পে ফাস্ট ফুডের সস্ আমি সজ্ঞানে ঢালিনি কখনো। আমি বরং চেয়েছি সমঝদারের সুগন্ধী হতে। তোমরা, যারা ক্রিকেট সুধা ভালোবাসো তার গতির উদ্দামতা নয়, নীরবতার গভীরতা দেখে- আমি তোমাদের দিতে চেয়েছি না ভোলার ফরাসী সৌরভ...
... অবসরের পরে কী করবো জানতে চাচ্ছো? এটা তো বেশ কঠিন প্রশ্ন ! ...দাঁড়াও, একটু ভেবে নিই।... উমম, মনে হয় বন্ধু মার্ক বাউচারের সাথে গলফ খেলবো আমি। ...কী বললে, খুব কঠিন খেলা ওটা, শিখতে সময় লাগবে?... শোনো, আমার নাম জ্যাকুয়েস হেনরি ক্যালিস- প্রশ্নসাপেক্ষে আমি সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার; ধৈর্য্যের পরীক্ষায় মনে হয় না গলফ আমায় হারিয়ে দেবে ! ''