ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-২ঃ গেগেনপ্রেসিং
আলো ঝলমলে ওয়েম্বলির ব্যালকনি থেকে ফিলিপ লাম উঁচু করে ধরলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি, ফেটে পড়ল মহারাণির স্টেডিয়াম। ওদিকে এক ফাঁকে ক্যামেরা প্যান করে চকিতে মাঠের ভগ্নমনোরথ ডর্টমুন্ডের খেলোয়াড়দের এক নজর দেখিয়ে গেল। ঐ মুহূর্তে কমবেশি সকল ফুটবল রোমান্টিক (বায়ার্নের সমর্থকদের হিসেবে না এনে) বুকের মাঝে সূক্ষ্ম একটা ব্যথা অনুভব করছিলেন- একথা বলাই যায়।
বরুসিয়া ডর্টমুন্ড দলটির জন্য প্রায় সকল ফুটবলভক্তদের হৃদয়েই একটা বিশেষ জায়গা আছে। তাদের সুবিশাল ওয়েস্টফালেনস্ট্যাডিওন, আম জনতা শ্রেণীর পাগল সমর্থকগোষ্ঠী, তাদের ইয়েলো ওয়াল, উচ্চারণ-অযোগ্য নামের তাক লাগানো তরুণ খেলোয়াড়ের দল এবং অতি অবশ্যই ইউর্গেন ক্লপ - সব মিলিয়ে ডর্টমুন্ডকে ভালোবাসার অনেক কারণই ছিল কিংবা আছে। তবে বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখের শান-শওকত-অর্থ-বিত্তকে টেক্কা দিয়ে তাদের ধরা-বাঁধা ট্রফি এবং ভক্ত সমাজকে এক ঝলকে হাতিয়ে নেওয়ার কাজটা সেরেছেন ঐ শ্রশ্রুমন্ডিত “হেভি মেটাল” ইউর্গেন ক্লপই। তিনি এবং তাঁর গেগেনপ্রেসিংয়ের ধাঁধায় পড়ে ইউরোপের বড় বড় দলগুলো নাকানিচুবানি খেয়েছে এবং চমৎকৃত হয়েছে বিশ্ববাসী। যদিও গেগেনপ্রেসিং ক্লপের আবিষ্কার নয় এবং এর সবচেয়ে সফল প্রয়োগকারী ম্যানেজারও হয়তো ক্লপ নন, কিন্তু এই কৌশলের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ তিনিই সর্বশেষ সবচেয়ে ভালোভাবে দেখাতে পেরেছেন এ বিষয়ে একমত হবেন অনেকেই।
গেগেনপ্রেসিং "কী" এবং "কীভাবে"?
গেগেনপ্রেসিং নামটা আসলে জনপ্রিয় করেছেন ক্লপই, এর আগে বিশ্ববাসী এই একই কৌশলকে ‘কাউন্টারপ্রেসিং’ নামেই জানতো। ২০০৮ সালে জার্মান কোচ ইউর্গেন ক্লিন্সম্যান প্রথম “তাৎক্ষণিক বলের দখল নেওয়া” ব্যাপারটার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। অবশ্য সেই সময়কার অনেক কোচেরা অবশ্য এর আগে থেকেই সফলভাবে তখন কাউন্টারপ্রেসিং-কে ব্যবহার করতে শুরু করে ফেলেছেন।
খুব সহজে বলতে গেলে, গেগেনপ্রেসিং বা কাউন্টার প্রেসিং হল প্রতিপক্ষের অর্ধে বলের দখল হারিয়ে ফেললে ঐ মুহূর্ত থেকে আশেপাশের সব খেলোয়াড়কে ব্যবহার করে চাপ প্রয়োগ করে বলের দখল ফিরিয়ে আনা - প্রতি আক্রমণ বা কাউন্টার অ্যাটাক ঠেকানোর জন্য এই কৌশল; তাই এর নাম কাউন্টারপ্রেসিং বা গেগেনপ্রেসিং। বলের দখল হারানোর পর আক্রমণ থেকে রক্ষণের রূপান্তরের যে সময়টা, সেটা যথাসম্ভব কম রাখাটাই গেগেনপ্রেসিংয়ের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য ।
চোখের পলকে রক্ষণ থেকে আক্রমণে
সফলভাবে গেগেনপ্রেসিং করার বেশ কিছু পূর্বশর্ত আছে। এর মাঝে প্রথম এবং প্রধান শর্ত হল, প্রেসিং শুরু করবার আগে দলের খেলোয়াড়দের অবস্থান এবং ফর্মেশন নিশ্ছিদ্র রাখা। বল হারানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যদি প্রতিপক্ষের অর্ধে খেলোয়াড়রা একে অপরের কাছাকাছি না থাকে, তাহলে দ্রুত প্রেসিং শুরু করাটা একটু মুশকিলই বটে। তবে যেসব দল সাধারণত ছোট ছোট পাসে খেলে অভ্যস্ত, তাদের এই সমস্যাটা ভোগায় না।
এখানে শর্তটি হল বল সমেত বা বল ছাড়া প্রতিপক্ষের অর্ধে নিজ দলের সহযোদ্ধাদের কাছাকাছি থাকা। খেলোয়াড়দের মাঝে দূরত্বটা হতে হবে এমন, যাতে তারা বল হারানোর সাথে সাথেই ঐ এলাকাতে সমন্বিতভাবে প্রেসিং করতে পারে আবার বলের দখল পেলে যাতে যথেষ্ট শূন্যস্থান কাভার দিয়ে পাস বের করার জায়গাও থাকে। এক্ষেত্রে ট্রেইনাররা একটা সহজ নিয়ম ব্যবহার করেন খেলোয়াড়দের বোঝার সুবিধার্থে - “প্রতিটি খেলোয়াড়কে সবচেয়ে কম সংখ্যক এলাকা এবং সবচেয়ে বেশি পরিমাণ দূরত্ব এমনভাবে কাভার দিতে হবে, যাতে করে একজন খেলোয়াড়ের এলাকা আরেকজনের সাথে ওভারল্যাপ না করে।” এটাকেই গেগেনপ্রেসিং এর প্রথম ‘’রুল অফ থাম্ব’’ ধরা হয়।
নিশ্ছিদ্র ফর্মেশন এবং শুন্যস্থান পূরণ
গেগেনপ্রেসিং কৌশলের আরেকটা শর্ত আছে, যেটা বোঝার জন্য আগে গেগেনপ্রেসিংয়ের মৌলিক সমস্যাটা বুঝতে হবে; যে সমস্যাটার জবাব প্রতিটি দলের জন্য ভিন্ন। সমস্যাটা হল, কতক্ষণ আমরা প্রেসিং চালিয়ে যাব? কতজন খেলোয়াড় প্রেসিং করবে? এটা একটা বেশ শক্ত সমস্যা, কারণ বলের দখল হারানো মাত্র সেটা প্রতিপক্ষ দলের এক পা থেকে আরেক পায়ে ঘোরাফেরা শুরু করবে। কাজেই সেক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা কতক্ষণ পর্যন্ত পুরোদমে প্রেসিং চালিয়ে যাবে?
এখানে মনে রাখতে হবে প্রেসিং ব্যাপারটা রক্ষণাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ বিপজ্জনক। কারণ, প্রেসিং-এর বাধা পেরিয়ে প্রতিপক্ষ যদি বল একবার অর্ধের ওপারে পাঠাতে পারে, তবে তারা প্রতি আক্রমণে যেকোন সময়ই গোল দিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে গেগেনপ্রেসিং এর থাম্ব রুল হল “৫ সেকেন্ড প্রেসিং”। বলের দখল হারালে খেলোয়াড়রা ৫ সেকেন্ড পর্যন্ত বিপক্ষ দলকে প্রেসিং করবে। এর মাঝে যদি বলের দখল জিতে নেওয়া যায়, তবে তারা কাউন্টারে যাবে আর যদি ৫ সেকেন্ডের মাঝে বল দখল না হয় বা বল ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তবে খেলোয়াড়রা তাদের রক্ষণাত্মক ফর্মেশনে ফেরত যাবে। যদিও এই “৫ সেকেন্ড” আইন ম্যানেজারের কৌশল এবং খেলোয়াড়দের মর্জি এবং বিবেচনা-বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে পরিবর্তন হতে পারে; তবে মূল ব্যাপারটা মোটামুটি এরকমই। এক্ষেত্রে অনেক ম্যানেজার যেটা করেন পুরোপুরি প্রেসিং বন্ধ না করে প্রতিপক্ষের বল বাহকের চারদিকে বা পাসিং টার্গেটের চারদিকে দুই বা তিনজন খেলোয়াড় দিয়ে আইসোলেশন জোন তৈরী করেন যাতে অ্যাটাকার বাকি পাসিং টার্গেটদের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
পেপ গার্ডিওলার আইসোলেশন জোন
এই কৌশলের আরেকটা শর্ত হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে প্রেসিং থেকে আক্রমণে রূপান্তর। অ্যাটাকারদের সবসময় মাথায় রাখতে হবে যে যেকোন মুহূর্তেই বলের দখল ফিরে পাওয়া যেতে পারে এবং তাদের সবসময় প্রতিপক্ষের রক্ষণের ফাঁকফোকরের সুলুকসন্ধানের হদিশ রাখতে হবে, শুন্যস্থানে দৌড় লাগানোর জন্য সদা সতর্ক রাখতে হবে নিজেকে। এজন্য সফলভাবে গেগেনপ্রেসিং করার আরেকটি পূর্বশর্ত হচ্ছে, ক্ষীপ্র এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তিসম্পন্ন ফরোয়ার্ড এবং উইঙ্গার।
গেগেনপ্রেসিংয়ের রকমফের
যদিও ব্যাপারটা বিভিন্ন কোচ/ম্যানেজারের ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার তবুও গেগেনপ্রেসিংয়ের কাভারেজকে মোটামুটি চারটা প্রকরণে ভাগ করা যায়ঃ
১) ম্যান ওরিয়েন্টেড গেগেনপ্রেসিং:
ম্যান-টু -ম্যান কাভার দেওয়াটাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। নিজের দল প্রতিপক্ষের হাফে বলের দখল হারালে সাথে সাথেই প্রতিপক্ষের অর্ধে দাঁড়ানো প্রত্যেক খেলোয়াড় সবচেয়ে কাছের প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে মার্ক করবে। এই গেগেনপ্রেসিং ভ্যারিয়েশানের মূল লক্ষ্য, পাস দেওয়ার অপশন বন্ধ করে বলের দখল নেওয়া। সাধারণত কোন খেলোয়াড় বলের দখল জিতে নিলে পাস দেওয়ার জায়গার সন্ধানে থাকে। ম্যান ওরিয়েন্টেড গেগেনপ্রেসিংয়ে প্রতিটা পাসিং অপশনকে মার্ক করে চাপের মুখে ঠেলে দিয়ে বলের পুনর্দখল নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই স্টাইলকে সবচেয়ে জনপ্রিয় করেছিলেন ট্রেবল জেতা ইউপ হেইংকেসের বায়ার্ন মিউনিখ।
ইউপ হেইংকেসের গেগেনপ্রেসিং
২) বল ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড গেগেনপ্রেসিং:
এই কৌশলে প্রতিপক্ষের সকল খেলোয়াড়কে হিসেবে নেওয়া হয় না। এই প্রেসিং এর মূল উদ্দেশ্য থাকে বল বাহক। প্রতিপক্ষের অর্ধে বলের দখল হারানো মাত্র নিকটস্থ সকল খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের যার পায়ে বল আছে, তাকে ঘিরে ধরে চাপ প্রয়োগ করবে। এর ফলে, হয় প্রেশারের কারণে বল বাহক ভুল পাস দেবে বা লং বল খেলার চেষ্টা করবে - উভয় ক্ষেত্রেই বলের দখল ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই কৌশলে বল বাহক এবং তার আশেপাশের কাভারিং এরিয়ার ওপর সর্বোচ্চ প্রেশার প্রয়োগ করে বল বাহককে ভুল করতে বাধ্য করা হবে এবং একই সাথে প্রথম প্রেসিং প্লেয়ারকে সাপোর্টও দেওয়া হবে। ইউর্গেন ক্লপের ডর্টমুন্ডের পছন্দের প্রেসিং কৌশল ছিল এটিই।
ইউর্গেন ক্লপের গেগেনপ্রেসিং
৩) লেইন ওরিয়েন্টেড গেগেনপ্রেসিং:
এই প্রেসিং অনেকটা ম্যান ওরিয়েন্টেড গেগেনপ্রেসিংয়ের মতই। এ কৌশলের ক্ষেত্রেও নিজের দল প্রতিপক্ষের অর্ধে বলের দখল হারালে সাথে সাথেই প্রতিপক্ষের অর্ধে দাঁড়ানো প্রত্যেক খেলোয়াড় সবচেয়ে কাছের প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে মার্ক করবে। তবে এই কৌশলে বল বাহককে পাস দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে এবং বল বাহকের পাসিং লেইনকে ইন্টারসেপ্ট করাটাই মূল লক্ষ্য। পাসিং লেইন ব্লক করে বলের দখল নেওয়া, বা ইন্টারসেপশন ব্যর্থ হলে পরবর্তী সম্ভাব্য পাসিং টার্গেটকে দুইজন খেলোয়াড় দিয়ে মার্ক করা এই কৌশলের বৈশিষ্ট্য। পেপ গার্ডিওলার বার্সেলোনা এই কৌশলের সবচেয়ে কার্যকর প্রয়োগ দেখিয়েছে।
পেপ গার্ডিওলার গেগেনপ্রেসিং
৪) বল ওরিয়েন্টেড গেগেনপ্রেসিং:
কৌশলগত দুর্বলতার কারণে বর্তমান ফুটবল বিশ্বে এখন এর খুব একটা ব্যবহার হয় না। এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য বল হারানোর সাথে সাথে মাঠে দলের কৌশলগত কাঠামোর পরোয়া না করে বলের দখলের জন্য নিকটস্থ সকল খেলোয়াড় বলের দিকে চার্জ করবে। এক্ষেত্রে দলের গতি এবং আক্রমণাত্মক মানসিকতা যেমন সুবিধা এনে দেবে, তেমনি এবার প্রতিপক্ষের বিচক্ষণতা বা নিজের দলের বিন্দুমাত্র ভুলের কারণে দলের রক্ষণ মুহূর্তেই কাউন্টার অ্যাটাকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। ‘৭০-র দশকে আয়াক্স এবং ডাচ জাতীয় দল এই কৌশলে মাঠে প্রেসিং করতো। সম্প্রতি অস্ট্রিয়ান লিগে আদি হুটারের এসভি গ্রোডিগ এই কৌশলে খেলে বেশ সাফল্য দেখেছে।
ক্লপের হেভি মেটাল গেগেনপ্রেসিংয়ের উত্থান ও পতনঃ
গেগেনপ্রেসিংয়ের একটা অভিনব বিশেষত্ব হচ্ছে, বলের দখল ছাড়াই প্রো একটিভ হওয়া। সাধারণ রক্ষণের প্রায় সকল প্রচলিত কৌশলেই রক্ষণে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যাওয়া এবং বিপক্ষ দলকে বলের দখল নিয়ে কিছু করার সুযোগ দেওয়া। কিন্তু কাউন্টার প্রেসিংয়ের কারণে বিপক্ষ দল সাধারণত সেই চিন্তা করার অবকাশটা পায় না, এবং সদা প্রস্তুত না থাকলে বল হারানোটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর বল হারালে তো হলোই!
কিন্তু এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না আসলে ক্লপের গেগেনপ্রেসিং এর মাহাত্ম্যটা ঠিক কোন জায়গায়। কাউন্টার প্রেসিং খুব একটা অভিনব কৌশল নয়, আক্রমণাত্মক খেলা পছন্দ করেন এরকম অনেক কোচেরই বল দখলের পছন্দের কৌশল এই গেগেনপ্রেসিং, কিন্তু ক্লপ কিভাবে এই কৌশল দিয়ে বুন্দেসলিগায় বাঘা বাঘা দলগুলোর ওপর দুই মৌসুম ছড়ি ঘোরালেন?
ক্লপের গেগেনপ্রেসিং এর আরেকটা বিশেষত্ব ছিল ‘গেগেনকনটার্ন’ বা কাউন্টার। বলের দখল জেতার সাথে সাথেই বল প্রতিপক্ষের রক্ষণের ফাঁক গলিয়ে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে কাউন্টারে চলে যাওয়া। রক্ষণ থেকে আক্রমণের এই তাৎক্ষণিক রূপান্তরের ধাক্কাটা যদি বিপক্ষ দল সামলানোর যোগ্যতা না রাখে তবেই ঐখানেই সমাধি রচিত হয়ে যাবে তাদের গেম প্ল্যানের।
গেগেনকনটার্ন ঠিকমতো কাজ করবার জন্য প্রয়োজন গতিময়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের। ফরোয়ার্ড এবং উইঙ্গারদের বলের দখল ছাড়াও সব সময় প্রতিপক্ষের রক্ষণের ফাঁকা জায়গার হদিশ রাখতে হবে, কারণ যেকোন সময়ে প্রেসিং এর কারণে বলের দখল পেয়ে কেউ একজন ঐ ফাঁক গলিয়ে বল বের করে দেবে শূন্যে, সতর্ক থাকলে এবং যথেষ্ট দক্ষ থাকলে সেই বল ধরে গোল দিয়ে আসবে স্ট্রাইকার। না, একেবারে ছেলেখেলা নয়, কিন্তু সেটাকে ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলেছিলেন তৎকালীন ডর্টমুন্ড স্ট্রাইকার রবার্ট লেফানডফস্কি। আর এই পোলিশ স্ট্রাইকারের সাথে ছিলেন দুইজন অস্বাভাবিক প্রতিভাবান এবং সম্ভাবনাময় তরুণ জার্মান অ্যাটাকার মারিও গোৎজে এবং মার্কো রয়েস। এই ভয়াবহ ত্রিশুলের গেগেনকনটার্ন-র ধাক্কা সামলাতে অনেক বড় বড় দলই নিয়মিত নাকানিচুবানি খেয়েছে।
লেফানডফস্কিঃ গেগেনকনটার্নের জন্য পারফেক্ট স্ট্রাইকার
ডর্টমুন্ডের গেগেনপ্রেসিংয়ের উত্থানের মৌসুম ছিল ২০১০-’১১ এবং সবচেয়ে বিধ্বংসী কাল ছিল ২০১১-’১২। অনভিজ্ঞতা এবং অনভ্যস্ততার দরুণ ২০১০-’১১ তে ইউরোপা লিগ এবং ২০১১-’১২ তে চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপ পর্যায় থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল ক্লপের ছত্রীসেনাদের।
তবে এর পরের বছর আর দমিয়ে রাখা যায় নি গেগেনপ্রেসিংয়ের তান্ডবকে, ঝড়ের মতো রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যান সিটি, আয়াক্স, মালাগার মত বড় বড় দলকে ঘোল খাইয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠে ডর্টমুন্ড - প্রতিপক্ষ সেই চিরচেনা শত্রু বায়ার্ন মিউনিখ। ফাইনালে শেষ বাঁশি বাজার খানিকটা আগে আরিয়েন রোবেনের গোলে স্বপ্নের পরিসমাপ্তি হয় ইয়েলো আর্মির। এরপর থেকেই ডর্টমুন্ডের দাপটও কমতে থাকে।
ডর্টমুন্ডের দাপট কমার পেছনের বড় একটি কারণ হল, ক্লপের গেগেনপ্রেসিং প্রথম নজরে দেখতে ভয়ানক হলেও সেটা আসলে বড্ড বেশি একমাত্রিক এবং সোজাসাপ্টা ছিল। ঝানু ম্যানেজাররা একবার ব্যাপারটা বুঝে ওঠার পর ফাঁকফোকরগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে। গার্ডিওলা বা হেইংকেসের কাউন্টার প্রেসিংয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, বল হারালেও তাদের ধৈর্য্য এবং ধীর স্থির গতির খেলার কারণে সেটা সবসময় বড় বিপদ ডেকে আনার সম্বাবনা কম ছিল। ওদিকে ক্লপের “মরব বা মারব” নীতি সবসময় ভালো ফল বয়ে আনবে এমনটা নয়। যেমন, যেবার ডর্টমুন্ড চ্যাম্পিয়নস লীগে রানার্স আপ হল, সেবারকার 'রাউন্ড অফ সিক্সটিন' থেকে ফাইনাল পর্যন্ত ডর্টমুন্ডের স্কোরলাইনগুলি দেখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবেঃ ৫-২, ৩-২, ৪-৩, ১-২। তাদের আগ্রাসী খেলার ভঙ্গীর জন্য তারা গোল দিয়েছে এবং হজমও করেছে। যেদিন সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়েছে সেদিন জয় এসেছে, অন্যান্য দিন খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে।
ডর্টমুন্ডের স্বর্গ থেকে পতনের আরো একটি বড় কারণ ছিল তাদের ইনজুরি সমস্যা। ডর্টমুন্ডের পুরো ৯০ মিনিট পূর্ণ গতিতে খেলার মানসিকতা এর জন্য মূলত দায়ী। একটা ছোট পরিসংখ্যানই ব্যাপারটা স্পষ্ট করবেঃ ২০১২-’১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্যায়ের একটি ম্যাচে ডর্টমুন্ডের আউটফিল্ডের খেলোয়াড়রা মোট ১২২.৯ কিলোমিটার দৌড়েছেন, গড়ে প্রতি খেলোয়াড় প্রায় ১২ কিলোমিটার কাভার করেছেন (সেন্টার ব্যাকরা সহ)। এখনো হয়তো আপনাদের ব্যাপারটা যথেষ্ট অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না; কিন্তু জেনে রাখুন ঐ চ্যাম্পিয়নস লিগে লিওনেল মেসির প্রতি ম্যাচে অ্যাভারেজ দৌড়াদৌড়ির পরিমাণ ছিল ৮.৬ কিলোমিটার!
এই 'হেভি মেটাল' খেলার দাবী মেটাতে গিয়ে ক্লপের তরুণ শিষ্যেরা একে একে দীর্ঘ ইনজুরিতে পড়া শুরু করে। ডর্টমুন্ডের এই দুঃসময়কে আরো নুনের ছিটা দিয়ে বায়ার্ন একে একে তাদের তারকাদের কিনে নিতে থাকে। ওদিকে ইউপ হেইংকেস ততদিনে তাঁর নিজের গেগেনপ্রেসিংয়ের প্রকরণ তৈরী করে নিয়েছেন, সেটার জোরেই ট্রেবল হাতে চলে আসে বায়ার্নের ঘরে আর ক্লপের গেগেনপ্রেসিং সরে আসে স্পটলাইটের নিচ থেকে।
সম্প্রতি ইউর্গেন ক্লপ লিভারপুলের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। লিভারপুলে গেগেনপ্রেসিংকে নিয়ে কাজ করার মতো এক ঝাঁক তরুণ উদ্যমী খেলোয়াড়ও তাঁর হাতে আছে। তবে রক্ষণাত্মক ঘরানার ইংলিশ লীগে ক্লপের আগ্রাসী খেলা কতটুকু ফল দেবে, বা ইংলিশ খেলার শিডিউলের চাপ সামলিয়ে ক্লপের নতুন ছাত্ররা প্রতিপক্ষকে গেগেনপ্রেসিংয়ের চাপে ফেলতে পারবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে।
আরো পড়ুনঃ
ট্যাকটিকসে হাতেখড়ি-১ঃ কাতেনাচ্চিওর "কূটকৌশল"