ফরোয়ার্ড নয়, অ্যানফিল্ডে জয় হল ডিফেন্ডারদের
দ্বিতীয়ার্ধের মিনিট পাঁচেক বাকি তখন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বায়ার্ন মিউনিখের রক্ষণব্যুহ ভেদ করতে পারেনি লিভারপুল। ৮৫ মিনিটে বাঁ-প্রান্তে বল পেলেন লেফটব্যাক অ্যান্ডি রবার্টসন। ক্রস করলেন ডিবক্সে। বায়ার্ন ডিফেন্ডার নিকোলাস সুলেকে ফাঁকি দিয়ে হেড করলেন সাদিও মানে, প্রথমার্ধে ম্যানুয়েল নয়্যারকে একা পেয়েও যিনি গোল করতে হয়েছিলেন ব্যর্থ। মানের হেড যাচ্ছে বায়ার্নের গোলের দিকে, উদযাপনের পূর্বপ্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন জর্ডান হেন্ডারসন। অ্যানফিল্ডে উপস্থিত অনেক দর্শকই আসন ছেড়ে উদযাপনের অপেক্ষায়। কিন্তু তখনই বাধ সাধলেন নয়্যার। দারুণ এক সেভে আবারও মানেকে ফিরিয়ে দিলেন নয়্যার। দুর্দান্ত সব ফরোয়ার্ড দিয়ে ঠাসা ম্যাচে জয় হল রক্ষণেরই। গোল করতে পারেননি মোহামেদ সালাহ, রবার্ট লেভানডফস্কিরা। আরিয়েন রোবেনের ভাষ্যমতে 'দু:স্বপ্নের' অ্যানফিল্ড থেকে গোলশূন্য ড্র নিয়েই ফিরল বায়ার্ন।
গত সপ্তাহে অ্যানফিল্ডকে কেন প্রতিপক্ষের জন্য 'দু:স্বপ্নের মাঠ' বলেছিলেন বায়ার্ন উইঙ্গার আরিয়েন রোবেন, আজ প্রথমার্ধেই তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে 'বাভারিয়ান'রা। ম্যাচের শুরু থেকেই ইয়ুর্গেন ক্লপের 'গেগেনপ্রেসিং'-এ খেই হারিয়ে ফেলে বায়ার্ন। রক্ষণে জেরোম বোয়াটেংয়ের অভাবটা বেশ ভুগিয়েছে নিকো কোভাচের দলকে। বোয়াটেংয়ের বদলি নামা নিকোলা সুলে অ্যানফিল্ডের বৈরী পরিবেশের সাথে একেবারেই মানিয়ে নিতে পারেননি। লিভারপুলের প্রেসিংয়ে বেশ কয়েকবারই বল হারিয়েছেন তিনি। বায়ার্নকে চেপে ধরলেও গোলের প্রথম সুযোগের জন্য ১২ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে লিভারপুলকে। তব্র অ্যান্ডি রবার্টসনের ক্রস থেকে মোহামেদ সালাহর ভলি নিয়ন্ত্রণে আনতে তেমন বেগ পেতে হয়নি বায়ার্ন অধিনায়ক ম্যানুয়েল নয়্যারকে। প্রথমার্ধে গোলের তেমন সুযোগ না পেলেও লিভারপুলের ভুলে আরেকটু হলেই ১৩ মিনিটে লিড নিতে পারত বায়ার্ন। ফরোয়ার্ড সার্জ গ্নাব্রির ক্রস জোয়েল মাতিপের গায়ে লেগে গোলের দিকে ছুটে আসা বল দারুণভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। দারুণ সেভে প্রথমার্ধ শুরু করলেও বেশ কয়েকবার অ্যালিসনের কারণেই বিপদে পড়তে হয়েছে লিভারপুলকে। ২২ মিনিটে তার ভুলেই ডিবক্সে বল পেয়ে যান কিংসলে কোমান। কিন্তু মাতিপের চার্জে বল লক্ষ্যে রাখতে পারেননি।
২৪ মিনিটে গোলের দারুণ এক সুযোগ পেয়েছিল লিভারপুল। রাইটব্যাক আলেকজান্ডার -আর্নল্ডের ক্রসে সালাহর হেড চলে যায় গোলের বাইরে দিয়ে। তবে প্রথমার্ধের সবচেয়ে সহজ সুযোগটা হাতছাড়া করেছেন সাদিও মানে। ৩৪ মিনিটে নবী কেইটার শট সুলে ফিরিয়ে দিলেও ফিরতি বলে ডিবক্সে নয়্যারকে একা পেয়ে যান মানে। কিন্তু সেনেগালের ফরোয়ার্ডের বাঁপায়ের শট চলে যআয় গোলের বাইরে দিয়ে। গোলের পর ক্লপের শূন্য দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল, লিড নেওয়াটা লিভারউলের জন্য ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। লিভারপুলের গোলের সুযোগ হাতছাড়ার মাঝে থেমে থাকেনি বায়ার্নও। কিন্তু ৪২ মিনিটে জশুয়া কিমিচের ক্রস থেকে রবার্ট লেভানডফস্কির হেড চলে যায় গোলের বাইরে দিয়ে। প্রথমার্ধে দারুণ খেললেও হলুদ কার্ড দেখায় দ্বিতীয় লেগ মিস করবেন কিমিচ।
প্রথমার্ধে লিভারপুলের আক্রমণজোয়ারে ভেসে যাওয়া বায়ার্ন দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে ৪-৫-১ ফর্মেশনে। মাঝমাঠে অতিরিক্ত একজন নিয়ে লিভারপুলের আক্রমণ রুখে দিতে থাকে বায়ার্ন। কোভাচের ফর্মেশন বদলে যেন কপালই খুলে যায় জার্মান চ্যাম্পিয়নদের। বল দখলে ক্লপের দল এগিয়ে থাকলেও গোলের সুযোগ তৈরি করেছিল বায়ার্নই। ৫৪ মিনিটে কোমানের ক্রস থেকে লেভান্ডফস্কির শট গোলের ঠিক সামনে থেকে ফিরিয়ে দেন মাতিপ। প্রায় পুরো দ্বিতীয়ার্ধই বায়ার্নের অর্ধে ছিল লিভারপুল, কিন্তু নয়্যারকে তেমন পরীক্ষায় ফেলতে পারেনি তারা। পাসিং ফুটবলে তেমন কাজ না হওয়ায় দূরপাল্লার শটে অ্যালিসনকে পরীক্ষায় ফেলতে থাকে বায়ার্ন। ৫৯ মিনিটে আরেকটু হলেই সফলও হয়ে গিয়েছিল তারা। প্রায় ২৫ গজ থেকে গ্নাব্রির শট অ্যালিসনকে পরাস্ত করলেও চলে যায় গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে সময় যত গড়িয়েছে, আক্রমণভাগে ঠিক ততটাই নেতিয়ে পড়েছে লিভারপুল। সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেনি বায়ার্নও। গোল করার চেয়ে গোল না খাওয়ার দিকেই যেজ নজর বেশি ছিল দু'দলেরই। মাঝমাঠের লড়াইয়েই ব্যস্ত ছিলেন হেন্ডারসন-রড্রিগেজরা।
৬৮ মিনিটে গ্নাব্রির মত ডিবক্সের বাইরে থেকে চেষ্টা করেছিলেন কেইটাও, কিন্তু নয়্যারকে পরীক্ষায় ফেলতে পারেননি। ম্যাচের বাকিটা গল্প ছিল বায়ার্নের রক্ষণ বনাম লিভারপুলের আক্রমণ। সালাহ, মানেরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছেন; কিন্তু ম্যাটস হামেলসদের সামনে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে বারবার। দুই উইংয়ে গ্নাব্রি এবং কোমানের মত গতিশীল উইঙ্গার থাকলেও প্রতি-আক্রমণেও সুবিধা করতে পারেনি বায়ার্ন। ৭৮ মিনিটে বাভারিয়ানদের তিনজনকে কাটিয়ে ডিবক্সে ঢুকে গিয়েছিলেন সালাহ, কিন্তু লক্ষ্যে শট রাখতে পারেননি। ৮৭ মিনিটে ডিবক্সের বাইরে থেকে চেষ্টা করেছিলেন মাতিপও, কিন্তু কাজের কাজ আর হয়নি। শেষ পর্যন্ত 'দু:স্বপ্নের' অ্যানফিল্ডে বিদায়টা বেশ সুখকরই হল বায়ার্নের। সপ্তাহ তিনেক পর আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে জিতলেই পরের রাউন্ডে যাবে কোভাচের দল। ইতিহাসও কথা বলছে বায়ার্নের হয়ে গ্রুপপর্বে খেলা তিন 'অ্যাওয়ে' ম্যাচেই যে হেরেছে লিভারপুল!