হ্লেবের ঘরে ফেরা
একটা সময় মনে হয়েছিল অ্যালেক্সান্ডার হ্লেবের এ স্বপ্নটাও অধরা থেকে যাবে। ক্যারিয়ারে আরও কত বড় কিছুর স্বপ্নই তো দেখেছিলেন। কিন্তু হারিয়েছেন পথ, বারবার ধাক্কা খেয়েছেন, ফিরেও আসতে পারেননি- স্বপ্নগুলো তাই ধুলোয় মিশে গেছে বহু আগেই। সেসবের সামনে এই স্বপ্নটাকে আদিখ্যেতাও বলা যেতে পারে।
২০১৭ তে ইউরোপা লিগের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের পর সঙ্গে সঙ্গে বাটে বোরিসভের প্রেসিডেন্টকে ফোন করেছিলেন হ্লেব। আর্সেনালের সঙ্গে এক গ্রুপে পড়েছে বেলারুশের ক্লাবটি। বেলারুশে হ্লেবের স্ট্যাটাসটা এমনই, যে কোনো ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে সরাসরি ফোন করে তাকে কিনে নেওয়ার কথা জানাতে পারেন তিনি। অনেকের মতে বেলারুশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত খেলোয়াড়ও তিনি। সেটা না হওয়ারও কারণ নেই, হ্লেবের সঙ্গে তুলনায় আসতে পারেন কেবল একজনই। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে বিশ্বকাপে খেলা সার্গেই আলিনিকভ। জুভেন্টাসেও ক্যারিয়ারের কয়েক বছর পার করেছিলেন তিনি। এছাড়া বেলারুশের বিখ্যাত ফুটবলের তালিকায় পরিচিত নাম খুঁজে পাওয়াও দায়। হ্লেবকে তাই বেলারুশের ফুটবলের রাজাও বলা যায়।
প্রেসিডেন্ট আনাতলি কাপস্কিকে তিনি ফোন করেছিলেন নিজের ইচ্ছার কথা জানাতে। আর্সেনালের বিপক্ষে যে কোনো মূল্যে খেলতে চান তিনি। তখন কোনো ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি ছিল না, হ্লেব ছিলেন ফ্রি এজেন্ট। নিজেকে সেধে অবশ্য নিজের সম্মানই হানি করেছিলেন হ্লেব। কাপস্কি তখন তার কথা রাখেননি বা রাখতে পারেননি। ইউরোপা লিগের গ্রুপপর্বে যারা বাটেকে নিয়ে এসেছে, তাদেরকেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেছিলেন তখন ক্লাব প্রেসিডেন্ট।
হ্লেবকে দলে না নেওয়ায় তখন একরকম বিক্ষোভেই নেমেছিলেন বাটে সমর্থককেরা। দেশের 'সম্পদ' হ্লেবের অসম্মান মেনে নিতে পারেননি তারা। এই ব্যাপারটা ক্লাব অন্যভাবেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারত বলেই বিশ্বাস করতেন বেলারুশের বাটে বোরিসভ সমর্থকেরা।
আর্সেনালের বিপক্ষে খেলাটাই স্বপ্ন ছিল হ্লেবের। এই আর্সেনালেই নিজেকে চিনিয়েছিলেন তিনি। ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের দুর্দান্ত আর্সেনালের মিডফিল্ডের কারিগর ছিলেন হ্লেব। তার দূরদর্শীতা ছিল অনুকরণীয়। বল আলতো করে নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, মাঠের ২২ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে তাকে আলাদা করা যেত ওই কারণেই। সেটা খেলোয়াড়দের জন্যে ছিল ঈর্ষনীয় আর সমর্থকদের চোখের জন্য নির্মল বিনোদন! লিকলিকে গড়নের শরীর দিয়ে প্রিমিয়ার লিগের শক্তিনির্ভর ফুটবলে নিজেকে সেরা প্রমাণ করেছিলেন। আর বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারদের একজনও তখন ধরা হত তাকে।
সেটা জানা ছিল পেপ গার্দিওলারও। বার্সেলোনায় ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারর শুরু করার আগেই হ্লেবকে পাখির চোখ করেছিলেন কিংবদন্তী বনে যাওয়া এ ম্যানেজার। "গার্দিওলা আমাকে নিজেই ফোন দিয়েছিল। তখন সে আমাকে প্রস্তাবটা জানায়। বার্সেলোনায় আমাকে নিয়মিত একাদশে সুযোগ দেবেন বলে আমাকে চুক্তি করতে বলেন তার ক্লাবের সঙ্গে। ফোনে গার্দিওলা আমাকে একাদশটাও বলে দিয়েছিল। জাভি, ইনিয়েস্তা মিডে; মেসি রাইটে, আমি লেফটে, অঁরি স্ট্রাইকে।" ইতো, ডেকো, রোনালদিনহোদের তখন ক্লাব ছাড়ার কথা ছিল। বাকি দুইজন ছাড়লেও ইতো থেকে গিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। আর হ্লেব গার্দিওলাকে দেওয়া কথা রেখে পাড়ি জমিয়েছিলেন বার্সেলোনায়। কিন্তু গার্দিওলা তার দেওয়া কথা রাখতে পারেননি। অঁরিকে লেফটে খেলিয়ে, ইতোকে স্ট্রাইকে সুযোগ দিয়েছিলেন সেবার গার্দিওলা- তাতে হ্লেবও একাদশে জায়গা হারান।
এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি হ্লেব। ক্ষোভ জমেছিল তার মনে। সেই আফসোস করেন তিনি এখনও, "আমার আচরণ খারাপ ছিল। কয়েক ম্যাচ সুযোগ না পেয়েই আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি গার্দিওলাকে দোষ দিচ্ছিলাম, আমি তাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম যে সে যদি আমাকে নাই খেলাবে তাহলে আমাকে আর্সেনাল থেকে এখানে নিয়ে এলো কেন! গার্দিওলা তখন আমাকে বলেছিল, মৌসুম অনেক বড়- সবাই একটা সময় সুযোগ পাবে। ধৈর্য্য ধরতে বলেছিল তখন সে আমাকে। কিন্তু আমি পারিনি। আমার রাগ লাগছিল, আমি উলটা পালটা আচরণে করেছিলাম বেশ কয়েকবার"- ২০১৬ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করে বলেছিলেন হ্লেব।
আচরণের সমস্যাটা ক্যারিয়ার জুড়েই ভুগিয়েছে হ্লেবকে। বার্সেলোনার হেক্সা জেতা সেই বিখ্যাত মৌসুম শেষে হ্লেব ধারে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্টুটগার্টে। আর্সেনালের আগে এখানেই নিজের ফুটবল স্কিলের পরিচয় জানান দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার স্টুটগার্টে গিয়ে আর মন টেকেনি তার। আসলে নিজেই টিকতে পারেননি। কারণ ছিল দাম্ভিকতা- স্টুটগার্টের তখনকার খেলোয়াড়দের নিজের ধারে কাছেরই মনে করতে না হ্লেব। তাই দলের সঙ্গে এক হয়ে খেলাটা উপভোগও করতে পারেননি।
স্পেনে বদমেজাজী হয়ে ওঠা এরপর জার্মানি থেকে দাম্ভিক হয়ে ফেরা- হ্লেবের ক্যারিয়ার উলটো যাত্রা শুরু করে দিয়েছে ততোদিনে। পরের মৌসুমে নিলের আরেক ভুল সিদ্ধান্ত। প্রিমিয়ার লিগে ফিরলেন, বার্মিংহাম সিটির হয়ে। কিন্তু বার্মিংহামের লং বল থিওরির সঙ্গে বড্ড বেমানান তিনি। সেখানেও থিতু হতে পারলেন না। এরপর যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ালেন হ্লেব, এখান থেকে সেখানে। রাশিয়ার দুই ক্লাবে খেললেন, একটার সঙ্গে সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বয়স আর ঘরের টানে বারেস থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারলেন না।
২০১৮ সালে পঞ্চমবারের মতো বাটে বোরিসভে ফিরলেন হ্লেব। ততোদিনে বয়স হয়ে গেছে ৩৬। ক্যারিয়ার সায়াহ্নে হ্লেব তখন দুঃস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক সম্ভাবনায় ফুটবলার। বাকি দশজন ফুবটলারের মতো যারা শৈশবের ক্লাবে এসেছেন বিদায় নিতে। হ্লেবের তখনকার চুক্তিটা ছিল এক বছরের। ডিসেম্বরেই চুক্তিটা শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু এরপর শেষবেলায় একবার বোধ হয় ভাগ্য ফিরে তাকিয়েছে তার দিকে। হ্লেব ভাবতে পারেন ঐশ্বিক ক্ষমতা বলে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন তিনি। ডিসেম্বরে ইউরোপা লিগের শেষ ৩২ এর ড্রতে আরও একবার আর্সেনাল পেল বাটে বোরিসভকে। এবার আর প্রেসিডেন্ট তাকে না করতে পারলেন না। আর্সেনালের বিপক্ষে খেলার জন্য চুক্তিটা লম্বা করলেন তিনি। ঘরের মাঠে প্রথম লেগে নামলেনও সাবেক ক্লাবের বিপক্ষে, খেললেন ৫৮ মিনিট। এবার তিনি ফিরছেন এমিরেটসে। এই মাঠ ছেড়েই ক্যারিয়ার দুর্গতি ডেকে এনেছিলেন হ্লেব। সবকিছুর শুরু যেখানে, সেই মাঠেই হয় আরেকবার ফিরে গিয়ে কিছু একটা বদলে দিতে চান তিনি। অতীত আর বদলাতে পারবেন না হ্লেব, আর্সেনাল ছাড়ার আফসোস সারাজীবনই সঙ্গী হওয়ার কথা তার।
আরেকবার এমিরেটসে ফিরে হয়ত সঙ্গী হয়ে যাওয়া আফসোসটাকে একটা তৃপ্তি দিতে চান হ্লেব। প্রথম লেগে ১-০ গোলে জিতে এগিয়ে থাকা বাটে বোরিসভের সামনে জয়ের সুযোগও আছে এই টাইয়ে। আর্সেনালকে তাদের মাঠে হারিয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়া অবশ্য সহজ কিছু হবে না বাটের জন্য। সেটা হ্লেবের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। কিন্তু এই মাঠেই হয়ত আরেকবার ফুটবলটা উপভোগ করতে চান তিনি। এখানে ওখানে ঘুরে কেবল ক্লান্ত আর ব্যর্থই হয়েছেন এতোদিন, এবার ঘরে ফিরে একবার বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে চান, নিজেকে ফিরে দেখতে চান। তাতে আফসোস যদি কমে! আর্সেনালের বিপক্ষে খেলার জন্য এতো ব্যকুলতার আর কী কারণই বা থাকতে পারে!