ক্রিকেটকেই যিনি করেছিলেন ধ্রুবতারা!
বরফ দিতে হলো রাতভর। অধিনায়কের হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটটা গুরুতর, তবে তিনি নাছোড়, পরদিন বল করতে নামবেনই! ফিজিও ভাবলেন, কত ওভারই বা করতে পারবেন, ৪-৫। সেই বোলার করলেন ২০ ওভার। টানা ২০ ওভার। ৫টি উইকেট নিলেন, ফিজিও আর ফিজিওলজিকে দেখালেন বুড়ো আঙ্গুল, আরেকবার। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয়ের দরজা দেখিয়ে থামলেন। ৩-২ এ জিতে ফ্র্যাঙ্ক-ওরেল ট্রফি নিল ক্যারিবীয়রা। কোর্টনি অ্যান্ড্রু ওয়ালশ ক্যারিয়ার জুড়েই চোটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন, বল করে গেছেন ওভারের পর ওভার। টেস্টে ফাস্ট বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ডেলিভারি করা বোলার তাই তো তিনিই।
****
প্রথম টেস্ট, প্রথম ইনিংস, প্রথম বল হাতে নেয়া। অনুভূতিগুলো নিশ্চয়ই চিরঞ্জীব থাকে সব বোলারেরই। ওয়ালশকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে দেখুন একবার, ওয়ালশ বলবেন, ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে তিনি বল করার সুযোগই পাননি! পাবেন কী করে, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল আর মাইকেল হোল্ডিং মিলে যে অস্ট্রেলিয়াকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ৭৬ রানেই! ওয়ালশের হাতে বল তুলের দেয়ার প্রয়োজনীয়তাই তাই ছিল না অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের।
তবে কোর্টনি ওয়ালশের প্রয়োজন ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ১৭ বছর ধরে।
১৯৯৩ সালে ক্রেইগ ম্যাকডারমটকে আউট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এক রানে জয় এনে দিলেন যখন, অথবা পরের বছর যখন তিনি আর তাঁর বন্ধু কার্টলি আমব্রোস মিলে ১৬ উইকেট নিয়ে গুঁড়িয়ে দিলেন ইংল্যান্ডকে, কিংবা ২০০০ সালে যখন ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে ছুঁলেন ৫০০ উইকেটের চূড়া- কোর্টনি ওয়ালশ নিজের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন!
জ্যামাইকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা গ্লস্টারশায়ারের হয়ে খেলাটা ভালবাসতেন ওয়ালশ। এতটাই যে, জীবনে বিয়ে করারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি!
ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধে শ্রমিক-শ্রেনীর কাজ করে গেছেন। অ্যামব্রোস বা গার্নারকে সমর্থন দিয়ে গেছেন উইকেট নিতে। নিজের প্রথম ৫ উইকেট পেতে তাই অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১২ টেস্ট পর্যন্ত। তবে দিন বদলালো। ওয়ালশের বয়স বাড়তে লাগলো, তিনি পরিণত হলেন আরও। নতুন বল হাতে নিতে লাগলেন। কার্টলি অ্যামব্রোসের সঙ্গে গড়ে তুললেন ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর এক বোলিং জুটি! ৪৯ টেস্টে এই জুটির উইকেট আছে ৪২১টি!
****
অ্যামব্রোসের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন। আসলে ওয়ালশ ছিলেন আদর্শ এক টিমম্যান, নেতা! ব্রায়ান লারার কাছে যখন অধিনায়কত্ব হারালেন, প্রকাশ্যে সমর্থন দিলেন তাঁকে। ঘরের মাঠে নামছেন, অধিনায়কত্ব নেই। অথচ জ্যামাইকায় ওয়ালশ নামলেন লারাকে সঙ্গে করে নিয়েই, যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, ভাইয়ের মতো করে! মাইকেল আথারটনের সেদিন অনুভূতি হয়েছিলে, আসলেই তো, নেতা হতে গেলেই যে অধিনায়ক হতে হয় না!
অতি-সামান্য আত্ম-অহমিকা আর অসামান্য বড় হৃদয় যে ছিল তাঁর। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে তাই সেলিম জাফরকে রান-আউট করেন নি তিনি। শেষ বলে দরকার ছিল ২ রান, শেষ উইকেট জুটি। স্ট্রাইকে আব্দুল কাদির, নন-স্ট্রাইকে জাফর। বল করতে গিয়েও ওয়ালশ করলেন না। জাফর ক্রিজ থেকে যে বেরিয়ে গেছেন আগেই! সতর্ক করলেন, অথচ করতে পারতেন আউট। ওয়ালশের শেষ বলের কাদির প্রয়োজনীয় রান নিয়ে নিলেন। হেরে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আসলে তো জিতলেন কোর্টনি ওয়ালশ, আসলে তো জেতালেন ক্রিকেটকে! সে ম্যাচের পর এক দর্শক নাকি ঘরে তৈরী একটা মাদুর উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে!
১৫ বছর ধরে গ্লস্টারশায়ারের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। ১৯৮৬ মৌসুমে নিয়েছিলেন ১১৮ উইকেট, শেষ যে মৌসুমটা খেললেন ১৯৯৮ সালে, সেবারও নিলেন ১০৬টি! তবে ওই মৌসুম শেষেই গ্লস্টার জানিয়ে দিলো, এত বছর ধরে তাদের কাউন্টিতে খেলা একমাত্র বিদেশী আর থাকছেন না! আসলে কর্তৃপক্ষই তাঁকে রাখেননি। দর্শকরা পাছে ভুল বুঝতে পারেন, কোর্টনি তাই তাঁদের উদ্দেশ্যে এক খোলা চিঠি লিখলেন। এতদিনের সম্পর্কটা ভুল বোঝাবুঝি দিয়ে শেষ হোক, এটা যে চাননি তিনি।
****
কোর্টনি ওয়ালশ হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা পেসার নন। চোখে লেগে থাকার মতো শৈল্পিক বোলিং হয়তো ছিল না তাঁর। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতি নিবেদন যে তাঁর অতুলনীয়! ইংল্যান্ডের মাটিতে তাঁর শেষ টেস্টের পর ভিভ রিচার্ডস তাই বিবিসির কমেন্ট্রি বক্সে দাঁড়িয়ে হাততালি দেন! গলাটা বোধহয় ধরে এসেছিল তাঁর। কিং ভিভও আবেগী হয়ে যান কোর্টনি ওয়ালশের বিদায় দেখে!
বল হাতের কোর্টনি যতটাই খাটুরে হোন, ব্যাট হাতের কোর্টনি বোধহয় ততটাই অলস ছিলেন। ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশী ডাক মারার রেকর্ডটা এখনও তাই তাঁরই (৪৩টি)। অবশ্য টেস্টে সবচেয়ে বেশী (৬১) ইনিংসে অপরাজিত থাকার রেকর্ডটাও তাঁর। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছিলেন, প্রায় জিতে যাওয়া ম্যাচটা হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
****
ক্যারিয়ার যখন শুরু করেন, ক্যারিবীয় ক্রিকেটে তখন সোনালী সময়। যে সময়ে তাঁর বল হাতে নেয়ার আগেই অলআউট হয়ে যায় প্রতিপক্ষ। যখন ক্যারিয়ার শেষ করলেন, ক্যালিপসোর ছন্দে ছেদ পড়ছে তখন। ঘরের মাঠ স্যাবাইনা পার্কে যখন বিদায় বললেন, তখন টেস্টের সর্বোচ্চ উইকেট (৫১৯) তাঁর। চার বছর এই রেকর্ড অক্ষুণ্ণ ছিল। ওয়ানডেতে তাঁর সেরা বোলিং ফিগারটাও অনর্যকম, ‘১ রানে ৫ উইকেট!’
কত কিংবদন্তির আঁতুরঘর ওই ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জগুলো। তাঁদের মাঝে কোর্টনি ওয়ালশের অবস্থানটা আসলে কোথায়!
তা যেখানেই হোক, ওয়ালশ তো ছিলেন ক্রিকেটের এক অসাধারণ দূত। যিনি ক্রিকেট খেলতেন, কারণ ক্রিকেটকে ভালবাসতেন। যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গর্বিত করেছিলেন। যিনি গর্বিত করেছিলেন জ্যামাইকাকে। জ্যামাইকার কোনো এক ট্যাক্সি চালক বা দোকানদারও তাই জানেন কোর্টনি কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন। তিনি যে তাঁদের ‘ম্যা-অ্যা-ন’!
বিদায়বেলায় অনেক ব্যাটসম্যানের ঠোঁটের কোণে হয়তো হাসি ফুটেছিল, যাক, আর কেউ আউট না করা পর্যন্ত এত ‘বিরক্ত’ করবে না।
তবে কোর্টনি ওয়ালশকে মনে রাখতে হবে, তাঁর হাসিটার জন্য। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে যা ফুটে উঠতো! ক্রিকেটের প্রেমেই যে মশগুল থাকতেন তিনি!