নাপোলি, 'ভিএআর' টপকে নেপলসে জুভেন্টাসের 'রেকর্ড'
২০১৮-১৯ ইউরোপিয়ান ফুটবল মৌসুমের অন্যতম 'হটকেক'ই বলা চলে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা 'ভিএআর'-কে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বিতর্কের জন্ম দেওয়া ফুটবলের নব্যতম প্রযুক্তি শিরোনামে এসেছে সিরি আ-তেও। গত বছর সাম্পদোরিয়ার বিপক্ষে অন্তিম মুহূর্তে 'ভিএআর'-এই জিতেছিল জুভেন্টাস। বেশ কয়েকবারই বিতর্কিত এই প্রযুক্তির সিদ্ধান্ত গেছে মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির দলের পক্ষে। কিন্তু আজ স্তাদিও সান পাওলোতে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখল জুভেন্টাস। দ্বিতীয়ার্ধের শেষদিকে ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকা নাপোলি 'ভিএআর'-এর বদান্যতায় পেয়ে যায় পেনাল্টি। পুরো দ্বিতীয়ার্ধ জর্জিও কিয়েলিনিদের নাকানিচুবানি খাওয়ানো নাপোলির হয়ে পেনাল্টি নেন অধিনায়ক লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে। পুরো সান পাওলো স্টেডিয়াম তখন উল্লাসের পূর্বপ্রস্তুতি সেরেই ফেলেছে। শট নিলেন ইনসিনিয়ে, পরাস্ত হলেন জুভেন্টাস গোলরক্ষক ওয়েচেক শেজনি। কিন্তু বাধ সাধল ভাগ্য, যে কারণে ৮৬ মিনিটে এসেও সমতায় ফেরা হয়নি নাপোলির। ইনসিনিয়ের পেনাল্টি বারপোস্টে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসল, সেই সাথে নিভে গেল নাপোলির ম্যাচে ফেরার সম্ভাবনার প্রদীপও। সিরি আ-এর শীর্ষ দুই দলের লড়াইটা হলো সমানে সমান, একেবারে 'বক্স অফিস' যাকে বলে। বিতর্ক, কার্ড এবং বাগবিতণ্ডা, হাতাহাতিতে ঠাসা রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচে শেষ হাসিটা হাসল জুভেন্টাসই। ২-১ গোলে নাপোলিকে হারিয়ে সিরি আ টেবিলের শীর্ষে লিডটা ১৬ পয়েন্টে নিয়ে গেল তারা। আজকের জয়ে সিরি আ-তে টানা ২৬ 'অ্যাওয়ে' ম্যাচ অপরাজিত থেকে নিজেদের আগের রেকর্ড (২৫) ভেঙ্গে দিয়েছে জুভেন্টাস। লিগে শেষ ৫০ ম্যাচে মাত্র একবার হেরেছে তুরিনের বুড়িরা।
নাপোলির মাঠে দুর্দান্ত এক প্রথমার্ধের পর জয়ের জন্য এতটা ঘাম ঝরাতে হবে, হয়ত ভাবেননি আলেগ্রি নিজেও। প্রথমার্ধে লাল কার্ড দেখেছিলেন নাপোলি গোলরক্ষক অ্যালেক্স মেরেট। দ্বিতীয়ার্ধে মিরালেম পিয়ানিচ দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখলে নাপোলির মতই ১০জনের দলে পরিণত হয় জুভেন্টাস। বাকিটা সময় রীতিমত ঘাম ঝরাতে হয়েছে তাদের। তবে জুভেন্টাসের বিপক্ষে নিজেদের মাঠে শুরুটা ভালোই করেছিল নাপোলি। ১০ মিনিটে গোলের সুযোগও পেয়েছিল নাপোলি। ডিবক্সের বাইরে থেকে লরেঞ্জো ইনসিনিয়ের শট জুভেন্টাস গোলরক্ষক ওয়েচেক শেজনিকে পরাস্ত করলেও চলে যায় গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে। ১৯ মিনিটে দারুণ ইনসিনিয়ের সাথে দারুণ ওয়ান টু করে ডিবক্সে ঢুকে পড়েন হোসে মারিয়া কায়েহোন। কিন্তু ইনসিনিয়ের মতই শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি। গোলমুখে নাপোলির অক্ষমতার সুযোগটা দারুণভাবেই কাজে লাগিয়েছে জুভেন্টাস। তবে এক্ষেত্রে জুভেন্টাসের কৃতিত্বের চেয়ে নাপোলির 'আত্মাহুতি'ই ছিল মূল কারণ। ২৫ মিনিটে রাইটব্যাক মালকুইটের ব্যাকপাস আরেকটু হলেই ধরে ফেলতে পারতেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কিন্তু গোল ছেড়ে এগিয়ে এসে রোনালদোকে ফাউল করে বসেন নাপোলি গোলরক্ষক অ্যালেক্স মেরেট। 'লাস্ট ম্যান' ফাউল হিসেবে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় মেরেটকে। বদলি গোলরক্ষক ডেভিড ওসপিনাকে নামাতে স্ট্রাইকার আর্কাদিউজ মিলিককে 'বিসর্জন'ই দিতে হয় আনচেলত্তিকে। অবশ্য রোনালদোকে গোলবঞ্চিত করতে মেরেটের ফাউলে কাজ হয়নি খুব একটা। মেরেটের ফাউলে পাওয়া ফ্রিকিক নিতে রোনালদো নয়, এগিয়ে আসেন মিডফিল্ডার মিরালেম পিয়ানিচ। সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছেন বসনিয়ান মিডফিল্ডার।
২৬ মিনিটে পাওয়া ফ্রি-কিক থেকে ওসপিনাকে পরাস্ত করেন পিয়ানিচ। গোলের সুযোগ হাতছাড়া করা নাপোলি মিনিটখানেকেই হারিয়ে ফেলে সব। কিন্তু মনোবলটা অক্ষুণ্ণই ছিল তাদের। ২৯ মিনিটেই সমতায় ফিরতে পারত নাপোলি। রুইজের পাস থেকে জুভেন্টাস ডিবক্সে বল পেয়ে যান পিওতর জিয়েলিন্সকি। শেজনিকে পরাস্ত করলেও তার শট প্রতিহত হয় বারপোস্টে। ১০জন নিয়েও এমন লড়াকু প্রত্যুত্তরে আরও অনুপ্রাণিত হয়ে উঠে নাপোলি। প্রথমার্ধে জুভেন্টাস লিড নিলেও দারুণ কিছু সুযোগ পেয়েছিল নাপোলিই। কিন্তু গোল খাওয়ার আগের সুযোগ গুলোর মতই কাজে লাগাতে পারেনি। ৩৫ এবং ৩৮ মিনিটে ডিবক্সের বাইরে থেকে শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি রুইজ এবং ইনসিনিয়ে। সুযোগ হাতছাড়া করার চড়া মাশুলই দিতে হয়েছে নাপোলিকে। ৩৯ মিনিটে কর্ণার থেকে ফেদেরিকো বার্নার্দেশিকে পাস বাড়ান পিয়ানিচ। ইতালিয়ান ফরোয়ার্ডের ক্রসে হেড করে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন এমরে চান। গোলের সুযোগ পেয়ে জোর হর্ষধ্বনিতে মাতা সান পাওলো স্টেডিয়াম পরিণত হয় মৃত্যুপুরিতে। শুরুটা দারুণ হলেও প্রথমার্ধ শেষে খালি হাতেই ফিরতে হয় নাপোলিকে।
প্রথমার্ধে ভাগ্য সহায় হলে হয়ত গোল শোধ করতেও পারত নাপোলি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ভাগ্যদেবী যেন মুখ তুলে তাকান তাদের দিকে। প্রথমার্ধে জুভেন্টাসকে লিড এনে দিয়েছিলেন তিনিই। জুভেন্টাসের একমাত্র হলুদ কার্ডটাও দেখেছিলেন পিয়ানিচই। ৪৮ মিনিটে ইচ্ছাকৃতভাবে বল হাতে লাগানোয় দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন পিয়ানিচ। আবারও গলায় জোর খুঁজে পায় নাপোলি সমর্থকেরা। সমর্থকদের নিরন্তর অনুপ্রেরণা জানানো বৃথা যেতে দেয়নি ইনসিনিয়েরা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে রাইটব্যাক মালকুইটকে উঠিয়ে দ্রিস মার্টেন্সকে নামিয়ে দিয়েছিলেন আনচেলত্তি। ইনসিনিয়ে-কায়েহন-মার্টেন্স ত্রিশূল সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে জর্জিও কিয়েলিনিদের। এই ত্রিশূলেই ম্যাচে ফেরে নাপোলি। ৬১ মিনিটে ইনসিনিয়ের ক্রসে পা ছুঁয়ে ব্যবধান কমান কায়েহন। নাপোলি সমর্থকদের উল্লাসে তখন কান পাতা দায়। দ্বিতীয়ার্ধের বাকি গল্প নাপোলির দুর্দান্ত ফরোয়ার্ডদের বিপক্ষে জুভেন্টাসের রক্ষণভাগের খাবি খাওয়া। ম্যাচে ফিরেই জুভেন্টাসের টুঁটি চেপে ধরে নাপোলি। গোলের সুযোগও আসতে থাকে অহরহ। ৬৭ মিনিটেই দলকে সমতায় ফেরাতে পারতেন জিয়েলিন্সকি। কিন্তু পোলিশ মিডফিল্ডারের শট দারুণভাবে ফিরিয়ে দেন শেজনি। কিয়েলিনি, বনুচ্চিদের বিবর্ণ হওয়ার দিনে জুভেন্টাসের লিড অক্ষুণ্ণ রাখার মূল কৃতিত্বটা অবশ্যই পোলিশ গোলরক্ষকের। কিন্তু দমে যায়নি নাপোলি।
কর্ণার, ক্রস, ছোট ছোট পাসে মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ- আক্ষরিক অর্থেই কোনও কিছু বাদ রাখেনি তারা। ৭৪ মিনিটে দুজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ডিবক্সে ঢুকে পড়েছিলেন মার্টেন্স, কিন্তু কিয়েলিনির দুর্দান্ত ট্যাকেলে শটই নিতে পারেননি। ম্যাচ যত এগিয়েছে, নাপোলির আক্রমণধার বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু সমতাসূচক গোলটা আর পাওয়া হয়নি। ম্যাচের মিনিট পাঁচেক বাকি থাকতে ইনসিনিয়ের পেনাল্টি মিসে শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি তারা। বিতর্কিত পেনাল্টি সিদ্ধান্তে উত্তাপটা ছড়িয়েছে ফুটবলারদের মাঝেও। ৮৮ মিনিটে অ্যালান এবং রড্রিগো বেন্টাঙ্কুরের মারামারিতে রঙ হারায় দুর্দান্ত ম্যাচটি। মাঠের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ডাগআউটেও। নাপোলি ডিফেন্ডার ফাওজি গুলাম এবং দানিয়েল রুগানি জড়িয়ে পড়েন বাগবিতণ্ডায়। শেষ পর্যন্ত বিতর্ক ঠাসা রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে শেষ হাসি হাসল জুভেন্টাসই। নিজেদের সেরাটা দিয়েও খালি হাতে ফিরল নাপোলি। ১৬ পয়েন্টে এগিয়ে থেকে মৌসুমের ১২ ম্যাচ আগেই টানা ৮ম সিরি আ শিরোপায় একহাত দিয়েই রাখল তুরিনের বুড়িরা।