• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    বার্নাব্যুতে রিয়ালের এপিটাফ লিখল নির্ভীক আয়াক্স

    বার্নাব্যুতে রিয়ালের এপিটাফ লিখল নির্ভীক আয়াক্স    

    রিয়াল মাদ্রিদ আর আয়াক্সের ম্যাচের গল্প নিয়ে কম লেখা লেখি হয়নি। মাঝে দিয়ে একটা প্রজন্ম চলে গেছে, যারা কেবল বইয়ের পাতাতেই সেসব ম্যাচের গল্প পড়েছেন। দুইদল মুখোমুখি হলে লড়াইটা কেমন হয় সেটা অবশেষে দেখা গেল বহুদিন পর। প্রথম লেগের দুর্দান্ত আয়াক্স যে পরের লেগেও ভয়ডরহীন ফুটবল খেলবে সেটা জানাই ছিল। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ যে তাসের ঘরের মতো ঘরের মাঠে এভাবে ভেঙে পড়বে তা কে জানত! সবশেষ ১৯৯৫ সালে শেষবার বার্নাব্যুতে জয়ের মুখ দেখেছিল আয়াক্স, বর্তমান দলের অনেকেরই জন্ম হয়নি তখনও। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় প্রত্যাবর্তনের দিনে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে আয়াক্স। আর নকআউট পর্বে প্রথম লেগে অ্যাওয়ে ম্যাচ জিতেও এই প্রথমবারের মতো বিদায় নিল রিয়াল। গত তিন বছর ধরে ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের আধিপত্যের সমাপ্তিটা এর চেয়ে আর করুণভাবে হতে পারত না। ১০১২ দিন ধরে ইউরোপের রাজা ছিল তারা। আর মাত্র কয়েকদিন পর যখন মাদ্রিদের আরেক মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল বসবে, তখন দর্শক হয়েই থাকতে হচ্ছে তাদের। রিয়াল মাদ্রিদকে দ্বিতীয় লেগে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর মৃত্যুপুরীতে উৎসব করেছে আয়াক্স।  

    প্রথম লেগে ২-১ গোলে আয়াক্সকে হারালেও রিয়াল মাদ্রিদের জয় ছাপিয়ে উঠে এসেছিল ‘ভিএআর’ বিতর্ক। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে দ্বিতীয় লেগে সেই ভিডিও রেফারিই যেন শাপমোচন করল প্রথম লেগের। এবার সিদ্ধান্ত গেল আয়াক্সের পক্ষে, কপাল পুড়ল রিয়ালের। তবে কেবল ‘ভিএআর’-এর জন্য নয়, রিয়ালকে রীতিমত ‘টোটাল ফুটবল’-এর শিক্ষা দিয়েই পরের রাউন্ডে গেছে আয়াক্স।  

     

     

    ঘরের মাঠে টানা চতুর্থ হার এড়াতে শুরু থেকেই মরিয়া হয়ে উঠেছিল রিয়াল। ৬ মিনিটেই লিডটা নিলে হয়ত এমন রাত দেখতেই হয় না বার্নাব্যুর! কিন্তু লুকাস ভাজকেজের ক্রস থেকে রাফায়েল ভারানের হেড প্রতিহত হয় আয়াক্সের ক্রসবারে। নকআউট পর্বে সুযোগ হাতছাড়ার মাশুল কতটা চড়া হতে পারে, মিনিটখানেক পর যেন রিয়ালকে ঠিক তা-ই জানান দিল আয়াক্স। ৭ মিনিটে মাঝমাঠে টনি ক্রুসের পা থেকে বল কেড়ে রিয়ালের ডিবক্সে ঢুকে পড়েন দুসান তাদিচ। সুযোগ বুঝে ডিবক্সে ফাঁকায় দাঁড়ান হাকিম জিয়েচকে পাস বাড়ান। প্রথম লেগের মত বাঁ-পায়ের টোকায় আয়াক্সকে লিড এনে দেন মরক্কোর ফরোয়ার্ড। 

    পিছিয়ে পড়ার পর আবারও গোলের সুযোগ পেয়েছিলেন ভারান, কিন্তু ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডারের শট তালুবন্দি করতে সমস্যা হয়নি আয়াক্স গোলরক্ষক ওনানার। এর মিনিটখানেক পর যেন ফিরে আসে ম্যাচের ৭ মিনিটের ঘটনার 'কার্বন কপি'। আয়াক্সের প্রথম গোল জিয়েচ করলেও তার অবদান কম ছিল না। ১৮ মিনিটে প্রতি-আক্রমণে রিয়ালের চারজনকে দারুণভাবে কাটিয়ে আরেক ফরোয়ার্ড ডেভিড নেরেসকে পাস বাড়ান তাদিচ। ওই গোলে তাদিচের ওই মুভটা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসে ঢুকে গেছে। আর রিয়াল গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়াকে চিপ করে ব্যবধান দ্বিগুণ করে নেরেসও তাতে অবদান রেখেছেন। বার্নাব্যুতে ২০ মিনিটের মধ্যে দুই গোল হজম করে ফেলেছে রিয়াল!

     

     

    খুনের নেশায় মত্ত ডাচরা ২২ মিনিটেই হয়ত রিয়ালের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিতে পারত। আবারও সেই তাদিচের থ্রু পাসে কর্তোয়াকে একা পেয়ে যান নেরেস। এবারও চিপ করলেন, কিন্তু অল্পের জন্য বল চলে গেল গোলের বাইরে। আয়াক্স একের পর এক দারুণ সুযোগ নষ্ট  করার পর অবশেষে টনক নড়ে রিয়ালের। ২৪ মিনিটে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের পাস থেকে ভাজকেজের শট ফিরিয়ে দেন ওনানা। কিন্তু আয়াক্সও থেমে থাকেনি। কর্তোয়ার কারণেই আরও বড় ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েনি রিয়াল।

    প্রথমার্ধে গোলের মত রিয়াল ইনজুরির দুঃসংবাদও পেয়েছে জোড়ায় জোড়ায়। ২৭ মিনিটে ভাজকেজ মাঠ ছেড়েছেন। মিনিট দশেক পর গোল করতে গিয়ে সাইডনেটে মেরেছিলেন ভিনিসিয়াস। কিন্তু এরপর ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন বেকায়দায়। শেষে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছেন ইনজুরি নিয়ে। রিয়ালকে বাঁচানোর দায়িত্বটা এরপর পড়েছিল বেল এবং আসেন্সিওর কাঁধে। পুরো মৌসুম একেবারেই জ্বলে উঠতে পারেননি। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষদিকে রিয়ালকে ম্যাচে ফেরানোর দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন বেল। কিন্তু ৪৩ মিনিটে আয়াক্স রাইটব্যাক মাজারুইকে কাটিয়ে বেলের নেওয়া শট ফিরে আসে বারপোস্টে প্রতিহত হয়ে। প্রথমার্ধে ভারান এবং ওয়েলশ ফরোয়ার্ডের প্রচেষ্টা দুটি জাল খুঁজে পেলে আয়াক্স নয়, হাফটাইমে মুখে বিস্তৃত হাসি থাকত সোলারি এবং রিয়ালেরই। কিন্তু সুযোগ হাতছাড়া করার চড়ামূল্যই দিতে হয়েছে দ্বিতীয়ার্ধে।

     

     

    দ্বিতীয়ার্ধে গোলশোধের জন্য মরিয়া রিয়াল রীতিমত আক্রমণজোয়ারেই ভাসিয়েছিল আয়াক্সকে। প্রথম ৫ মিনিটেই গোলের দুটি সুযোগ পেয়েছিলেন বেনজেমা এবং আসেন্সিও, কিন্তু বল জালে পাঠাতে পারেননি। বল দখলে রিয়াল এগিয়ে থাকলেও গোলের বেশি সুযোগ পেয়েছে পুরো দ্বিতীয়ার্ধ প্রতি-আক্রমণে খেলা আয়াক্সই। ৫৪ মিনিটে দারুণ এক প্রতি-আক্রমণে রাইটব্যাক মাজারুইইয়ের শট চলে যায় কর্তোয়ার গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে। কিন্তু ৬২ মিনিটে ঠিকই তৃতীয় গোলের দেখা পায় আয়াক্স। প্রথম দুই গোলের পার্শ্বনায়ক তাদিচ এবার চলে আসেন মূল দৃশ্যে। বাঁ-প্রান্ত থেকে নিকোলাস টালিয়াফিকো পাস বাড়ান ভ্যান ডি বিককে। তার পাস থেকে বাঁ-পায়ের দুর্দান্ত বাঁকানো শটে জাল খুঁজে পান তাদিচ। তবে আয়াক্সের তৃতীয় গোলে বিতর্কের রেশ ছিল বেশ। রিপ্লেতে দেখা যায়, ওই গোলের বিল্ডআপে মাজারুইয়ের গায়ে লেগে বল বাইরে চলে গিয়েছিল। হিসেবে রিয়ালের থ্রো পাওয়ার কথা ছিল। প্রায় আড়াই মিনিট খরচ করে এরপর সিদ্ধান্ত দেন রেফারি। ক্রিকেটের মতো বল বাউন্ডারি পার করেছে, নাকি করেনি- সেটা নিয়েই সংশয় ছিল। রেফারি শেষে রায় দিয়েছেন আয়াক্সের পক্ষেই। 

    আক্ষরিক অর্থেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর কিছুটা ঝলক দেখায় রিয়ালের আক্রমণভাগ। ৬৮ মিনিটে বেলের শট দারুণভাবে ফিরিয়ে দেন ওনানা।
    কিন্তু ৭০ মিনিটে সার্জিও রেগুলিয়নের মাইনাস থেকে ঠিকই ব্যবধান কমান আসেন্সিও। তখন আবার জেগেও উঠেছিল বার্নাব্যু। কিন্তু অবিশ্বাস্য কিছুর স্বপ্নে বিভোর রিয়ালকে কিছুক্ষণ বাদেই আবারও মাটিতে ফিরিয়ে আনে আয়াক্স। ৭২ মিনিটে অবিশ্বাস্য এক ফ্রিকিকে রিয়ালের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন লাস শোনে।

    ম্যাচের বাকিটা সময় আয়াক্স সমর্থকদের ‘ওলে! ওলে!!’ চিৎকারে মুখরিত ছিল বার্নাব্যু। ৮৪ মিনিটে আবারও ব্যবধান কমানোর সুযোগ পেয়েছিল রিয়াল, কিন্তু বেলকে আবারও ফিরিয়ে দেন ওনানা। ইউরোপের চ্যাম্পিয়নদের মাঠে ‘ফাইভ স্টার’ পারফরম্যান্সের ইতিটা পাঁচ গোল দিয়েই করতে পারত আয়াক্স। কিন্তু ৮৬ মিনিটে গোলের একেবারে সামনে থেকে বল বাইরে মারেন জিয়েচ। দ্বিতীয়ার্ধে এই একবারই শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি জিয়েচ। পুরো ম্যাচে রিয়ালের গোলে আয়াক্সের নেওয়া ৮ শটের ৪টিই খুঁজে পেয়েছে কর্তোয়ার গোল। গোলমুখে সক্ষমতার দারুণ এক নিদর্শনই রেখে গেল আয়াক্স।রিয়ালের বিদায় অবশ্য নিশ্চিত হয়ে গেছে ততক্ষণে। শেষদিকে মেজাজ হারিয়ে লাল কার্ড দেখেন নাচো ফার্নান্দেজ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা যেন একেই বলে। রেফারির শেষ বাঁশির পর বার্নাব্যুর দিকে তাকিয়ে অবশ্য বোঝার অবকাশ নেই, কিছুক্ষণ আগেই নকআউট পর্বে খেলেছে রিয়াল। সার্জিও রামোসকে ম্যাচ চলার সময় ভিআইপি বক্সে দেখা গিয়েছিল বেশ কয়েকবার, ম্যাচ শেষেও অনেকের মতো হারিয়ে গেছেন তিনিও। আগের তিনবার শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছেন রিয়ালের কিংবদন্তীতুল্য অধিনায়ক। সেই রামোসই হয়ত আফসোস করেছেন, ইচ্ছা করে হলুদ কার্ডটা না দেখলেও পারতেন! তাকে ছাড়া খেলতে নেমে চ্যাম্পিয়ন লিগের এই নিয়ে টানা তিন ম্যাচই হারল মাদ্রিদ। 

    দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৩ গোলে হেরেছে গত তিনবারের চ্যাম্পিয়নরা। ঘরের মাঠে এই নিয়ে হারল টানা চার ম্যাচ। আয়াক্স খেলোয়াড়দের অমন উদযাপন দেখতে কেই বা বসে থাকবেন! কিন্তু আয়াক্স সমর্থকেরা যে বিশ্বাস নিয়ে এসেছিলেন, তারা ফিরে গেছেন নতুন স্বপ্ন নিয়ে। এমন একটা রাতের অপেক্ষা তো তাদের কম দিনের নয়!