প্যারিসের অপেরায় পিএসজিকে কাঁদিয়ে কোয়ার্টারে ইউনাইটেড
কিলিয়ান এমবাপ্পে, ডি মারিয়ারা কোথায় মুখ লুকাবেন? নিজেরাও যেন জানেন না। পুরো ম্যাচে একই তালে কোরাস গেয়ে যাওয়া পিএসজি সমর্থকদের তখন নড়ে বসার শক্তিও নেই। প্যারিসের বৃষ্টিতে আরেকবার ভেসে গেছে তাদের স্বপ্ন। চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজির হাহাকারের গল্পে যোগ হয়েছে নতুন অধ্যায়। এবার সেই গল্পের ভিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ফুটবল তখন পিএসজির জন্য যত নিষ্ঠুর, ইউনাইটেডের জন্য ততোটা মধুর। অপেরাও এতো রোমাঞ্চ ছড়ায় না, যতখানি ছড়াল পিএসজি-ম্যান ইউনাইটেডের ম্যাচ। প্রথম লেগে ঘরের মাঠে ২-০ গোলে হারের পর পিএসজিকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড উঠে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। তাতে রেকর্ডও হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের, প্রথম লেগে ঘরের মাঠে দুই বা তার বেশি গোলের ব্যবধানে হারের পর পরের রাউন্ডে ওঠা প্রথম দল ইউনাইটেড।
আর বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হারের পর ইউনাইটেডের কাছে হেরে টানা তৃতীয়বারের মতো পিএসজি বাদ পড়েছে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই। পিএসজির গেরো না কাটলেও কেটেছে ইউনাইটেডের খরা। ২০১৩-১৪ মৌসুমের পর প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে ওলে গানার সোলশায়ারের রেড ডেভিলরা।
প্যারিসের রঙ্গমঞ্চে ম্যাচের রঙ বদলেছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, মুহূর্তে মুহূর্তে। নাটকের শেষ অঙ্কে নির্ধারণ হয়েছে টাইয়ের ফল, ২১ বছর বয়সী মার্কাস র্যাশফোর্ড আর ৪০ বছর বয়সী জিয়ানলুইজি বুফনের এক মুহূর্তের লড়াইয়ে। ভিএআরের মনিটর দেখে শেষ দৃশ্যটার স্ক্রিনপ্লে লিখেছেন রেফারি।
৯০ মিনিটে ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল ইউনাইটেড। দুই লেগ মিলিয়ে পিএসজি তখনও ৩-২ গোলের লিডে। ডিয়েগো দালোর ডিবক্সের বাইরে থেকে করা শট প্রেসনেল কিমপেম্বে ব্লক করেছিলেন লাফিয়ে উঠে। কর্নারই দিয়েছিলেন রেফারি। কিন্তু ভিএআর বাগড়া বাঁধিয়ে বসল। পরে রেফারি ডামির স্কোমিনা নিজেই রিপ্লে দেখে দিলেন পেনাল্টির সিদ্ধান্ত। স্লোভেনিয়ান রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে পেনাল্টি পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে স্পটকিক নিতে গিয়েছিলেন র্যাশফোর্ড। অভিজ্ঞ বুফন হার মেনেছেন, ওই গোলেই আরও একবার শিরোপা স্বপ্ন বিসর্জন গেছে তার। আর যে কিমপেম্বে টাইয়ের প্রথম গোলের পর উদযাপনে মেতেছিলেন, তিনিই শেষে গিয়ে হয়েছেন ভিএআরের বলি।
ম্যাচ শেষে সবকিছু ছাপিয়ে রেফারির ওই সিদ্ধান্তকেই দুষতে পারে পিএসজি। আরও একবার নিজেদের কপালকেও গালমন্দ করতে পারে। কিন্তু তাতে ইউনাইটেডের আরেকটি মিরাকল ছোট হচ্ছে না এতোটুকুও। ওলে গানার সোলশায়ার যখন ডাগ আউটে, তখন যা হওয়ার কথা নয়, সেটাও যেন হয়ে যায়।
চোট জর্জর ইউনাইটেডের একাদশ নামানোই কঠিন ছিল সোলশায়ারের জন্য। পল পগবা ছিলেন না নিষেধাজ্ঞার কারণে। প্রথমবারের মতো ৩-৫-২ ফর্মেশনে দল সাজিয়েছিলেন তিনি, আক্রমণে রোমেলু লুকাকু আর র্যাশফোর্ড।
সোলশায়ারের দেখানো স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে ভিতটা গড়েছিলেন লুকাকুই। প্রথম আধঘন্টায় জোড়া গোল করেছেন তিনি। পিএসজি ম্যাচে ওই দুইবারই ভুল করেছে, দুইবারই লুকাকু শাস্তি দিয়েছেন। ২ মিনিটেই থিলো কেহরের ভুলে বল পেয়ে এক গোল শোধ করেন লুকাকু। কিন্তু সময়ের সাথে ইউনাইটেডের দারুণ শুরুও মিলিয়ে যেতে শুরু করেছিল। ১২ মিনিটে এমবাপ্পের পাস থেকে হুয়ান বের্নাট গোল করার পর পিএসজির জয়টাই সময়ের ব্যাপারে মনে হচ্ছিল। কিন্তু বুফনের একটি ভুল আবারও সুযোগ করে ইউনাইটেডকে। র্যাশফোর্ডের দূরপাল্লার শট ঠিকমতো ধরতে পারেননি বুফন, রিবাউন্ডে বল পেয়ে ইউনাইটেডকে তখন আরেকবার এগিয়ে নিয়েছিলেন লুকাকু।
অথচ কে ভেবেছিল রেড ডেভিলদের হাতে এভাবে খুন হবে প্যারিসিয়ান সেন্টরা? প্রথম লেগের মতো দ্বিতীয় লেগেও ছিল পিএসজির দাপট। ডি মারিয়া, এমবাপ্পে, ড্রাক্সলাররা পুরো ম্যাচে নাচিয়ে ছেড়েছেন ইউনাইটেডের রক্ষণকে। কিন্তু এবার রক্ষণের ভুলগুলোই কাল হয়ে দাঁড়াল। প্রথমার্ধে তাই পিছিয়ে থেকেই শেষ করতে হয় থমাস টুখলের দলকে। কিন্তু তবুও অস্বস্তি ভর করেনি প্রাক ডি প্রিন্সে। যেভাবে পিএসজি খেলছিল তাতে আর একটা গোল না পাওয়ার কোনো কারণই ছিল না! বিরতির পর একই ধারায় চলা ম্যাচে, ইউনাইটেডকে বেগ পেতে হয়েছে আরও বেশি। এডিনসন কাভানি ছিলেন না একাদশে। টুখল তাকে খেলাতেও চাননি। র্যাশফোর্ডের গোলের পরে নেমেও আনফিট কাভানি আরেক প্রস্থ রোমাঞ্চ ছড়াতে পারেননি ম্যাচে। নেইমার ছিলেন, ভিআইপি বক্সে। শেষদিকে নেমে এসেছিলেন মাঠের টেকনিক্যাল সাইডে। এই দলকে আর উজ্জীবিত করতে পারেননি তিনিও।
সবকিছুর পর তাই আফসোসটা পিএসজির জন্যই তোলা থাকল। ৭২ মিনিটে এমবাপ্পে আরেকবার ক্রস করেছিলেন, কিন্তু প্রথম গোলের মতো এবার আর ডি মারিয়া নাগাল পাননি বলের। আরও পরে ডেভিড ডি গিয়ার সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ানে চলে গিয়েও পিছলে পড়েছেন এমবাপ্পে। পরে বের্নার্ট শট করেছেন, বারপোস্টে লেগে ফেরত এসেছে বল। সহজ সব সুযোগ আরও একবার হাতছাড়া করে চাপ নিজেদের ওপর বাড়িয়ে রেখেছিল প্যারিসিয়ানরা। এরপর আরও একবার দরকারের সময় ভেঙে পড়েছে তারা, খেলোয়াড়েরা তাই ফিরেছেন দুঃস্বপ্ন সঙ্গী করে। আরও একবার দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেওয়ার পর তো পিএসজির ভবিষ্যতই সংশয়ে পড়ে গেল।
আর এখান থেকে বোধহয় ইউনাইটেডে শুরু হয়ে গেল নতুন এক যুগের। পিএসজির আলোঝলমলে একাদশ আর সাইডবেঞ্চের সঙ্গে সোলশায়ার পাল্লা দিয়েছেন তরুণ এক দল নিয়ে। ম্যাচে করা সোলশায়ারের তিন বদলির গড় বয়স ২০ এরও নিচে। ১৯৯৯ তে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ফাইনালে মিরাকল দেখিয়েছিলেন ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে। এবার ডাগ আউটে বিব গায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, নামার তো আর সুযোগ নেই! তাই ডাগ আউটে থেকে রূপকথা লিখলেন। এই ম্যাচে নতুন সব কৌশল অনুসরণ করেছেন, সবগুলোই প্রায় কাজে দিয়েছে। ১৭ বছর বয়সী গ্রিনউডকে অভিষেক করিয়েছেন, নামিয়েছিলেন চংকেও। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনও ছিলেন মাঠে, সোলশায়ারের 'ফার্গি টাইমের' সাক্ষী হয়েছেন তিনিও। এমন রাতের পর চাকরিটা স্থায়ীভাবে না পাওয়ার আর কী কারণ থাকতে পারে সোলশায়ারের?