রোনালদোর জুভেন্টাসকে ফিরিয়ে দেওয়ার রাত
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে তখন কান পাতলে হয়তো শোনা যেত রিয়াল মাদ্রিদ এবং জুভেন্টাস সমর্থকদের হৃৎস্পন্দন। জুভেন্টাসের বিপক্ষে যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে পাওয়া পেনাল্টির ওপর নির্ভর করছে রিয়ালের পরের রাউন্ডে যাওয়া। বুফন লাল কার্ড পাওয়ায় মিনিট পাঁচেকের অপেক্ষা, দুই দলের ফুটবলারদের হাতাহাতি- কোনও কিছুই মনযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না তার। ঠিকই পেনাল্টি থেকে গোল করে রিয়ালের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। জার্সি খোলা উদযাপনে বার্নাব্যু সমর্থকদের থেকে শুনলেন 'ঈশ্বর', 'ঈশ্বর!!' হর্ষধ্বনি। ওই গোলের আগে তুরিনে প্রথম লেগে করেছিলেন জোড়া গোল, এর মধ্যে দুর্দান্ত সেই বাইসাইকেল কিকে করা গোল মনে থাকবে দীর্ঘদিন।
অবশ্য সেবারই প্রথম জুভেন্টাসের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করে দেননি রোনালদো। ২০১৬-১৭ মৌসুমের ফাইনালে করেছিলেন জোড়া গোল। এর আগে ২০১৩-১৪ মৌসুমেও গ্রুপপর্বের দুই ম্যাচেই করেছিলেন গোল। বাইসাইকেল গোলের পর জুভেন্টাস সমর্থকেরাই দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল তাকে। মাস চারেক পর সেই 'প্রতিপক্ষ'ই হয়ে গেল 'আপন'। রিয়ালের শ্বেতশুভ্র জার্সির বদলে রোনালদোর গায়ে উঠেছে জুভেন্টাসের ডোরাকাটা সাদাকালো জার্সি। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে প্রথম লেগ হেরে যাওয়ায় আজ রোনালদোর দিকেই তাকিয়ে থাকবে জুভেন্টাস। গত কয়েক বছর তুরিনের বুড়িদের কম স্বপ্ন তো ছিনিয়ে নেননি রোনালদো। আজকের ম্যাচে রোনালদোর থেকে কিছু 'প্রায়শ্চিত্ত'-এর আশায় তো বুক বাঁধতেই পারে তারা।
দলের মূল ভরসার 'ট্যাগ'টা কিন্তু আদায় করে নিয়েছেন রোনালদো নিজেই। চ্যাম্পিয়নস লিগে তো বটেই, ইউরোপসেরাদের এই টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে তার চেয়ে বেশি গোল নেই কারোই। এজন্যই তো গত বছর ৩৩ বছর বয়সী রোনালদোকে দলে ভেড়াতে নিজেদের ট্রান্সফার রেকর্ড ভাঙ্গতেও পিছপা হয়নি জুভেন্টাস। এই মৌসুমে ইতালিয়ান সুপার কাপে জুভেন্টাসের একমাত্র শিরোপা এসেছে তার গোলেই। সিরি আ-তেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল তারই।
আজকের প্রতিপক্ষ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ; জুভেন্টাসের মতোই রোনালদোর 'প্রিয়' প্রতিপক্ষের তালিকায় যারা থাকবে শুরুর দিকেই। অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে রিয়ালের হয়ে সর্বোচ্চ গোল তারই। শেষ দুই মৌসুমে ডিয়েগো সিমিওনের দলের বিপক্ষে তার হ্যাটট্রিক আছে দুটি। কিন্তু জুভেন্টাসে নেই লুকা মদ্রিচ, টনি ক্রুস, মার্সেলোরা। স্কোয়াডের শক্তিমত্তার বিচারে রোনালদোকে একপাশে রাখলে জুভেন্টাসের চেয়ে কিছুটা হলেও হয়ত এগিয়ে থাকবে রিয়াল। প্রতিপক্ষ সেই পরিচিত ডিয়েগো গোডিন, হিমেনেজ, হুয়ানফ্রানরাই। প্রতিপক্ষ পরিচিত, কিন্তু মাস ছয়েক পেরিয়ে গেলেও এখনও কারও সাথেই তেমন 'টেলিপ্যাথিক' বোঝাপড়া গড়তে পারেননি তিনি, যেমনটা ছিল রিয়ালে মার্সেলো, মদ্রিচদের সাথে। জুভেন্টাসে যোগ দিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে বোধহয় এমন কোনও প্রতিকূলতার কথাই বুঝিয়েছিলেন রোনালদো। অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে গোল করা ঠিক কতটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তা তো রোনালদোর থেকে কেউ ভাল বলতে পারবে না।
চ্যালেঞ্জটা যে শুধু রোনালদোর, তা অবশ্যই নয়। লিগে ২৭ ম্যাচ শেষে জুভেন্টাসের সংগ্রহ ৭৫, দুইয়ে থাকা নাপোলির চেয়ে ১৮ পয়েন্ট বেশি। সিরি আ-এর সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোর অবস্থা উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনের মতোই। তবে 'ঘরে বাঘ, বাইরে বিড়াল' কথাটা যেন জুভেন্টাসের চেয়ে ভালভাবে খাটে না অন্য কারও ক্ষেত্রে। সিরি আ-কে নিজেদের 'পৈতৃক সম্পত্তি' বানিয়ে ফেলা জুভেন্টাস ইউরোপসেরা হয়েছিল সেই ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে। মাঝে প্রায় ২৫ বছরে ফাইনাল খেলেছে ৮বার, হেরেছে প্রতিটিই। জুভেন্টাস তো আসলে ফুটবলের 'দক্ষিণ আফ্রিকাই'!
রোনালদো, জুভেন্টাসের মত আজকের ম্যাচের ওপর নির্ভর করছে কোচ মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির ভবিষ্যতও। ৪ বছরে সিরি আ জিতেছেন প্রত্যেকবার, জুভেন্টাসকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে নিয়ে গেছেন দু'বার। কিন্তু হার মানতে হয়েছে অ্যাটলেটিকোরই দুই স্বদেশী বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদের কাছে। স্প্যানিশ দলগুলোর সামনে প্রায় প্রতিবারই খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তার দলকে। আজ শেষ ষোল থেকেই বিদায় নিলে হয়ত জুভেন্টাসের কোচ হিসেবে আর দেখা যাবে না তাকে। সে প্রস্তুতিও হয়ত নিয়ে রেখেছে জুভেন্টাস। গাজেত্তো দেল্লো স্পোর্তের মতে, পেপ গার্দিওলার সাথে গোপনে চার বছরের মৌখিক চুক্তি সম্পন্ন করে রেখেছে ইতালির চ্যাম্পিয়নরা।
অথচ এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের অন্যতম দাবিদার ধরা হচ্ছিল তাদেরই। ইতালিতে আধিপত্য ধরে রাখলেও ইউরোপ থেকে আবারও খালি হাতে ফেরার আশঙ্কা জুভেন্টাসের সামনে। প্রতিপক্ষ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, দুর্ভেদ্য রক্ষণের বিচারে যাদের নামটা থাকবে একেবারে শুরুর দিকেই। জুভেন্টাসের মতই গত দশকে দু'বার ফাইনাল হেরেছে তারা। আজকের ম্যাচে সিমিওনের দলেরও প্রমাণ করার আছে অনেক কিছু।
তবে রোনালদোর চ্যালেঞ্জের কাছে এসব কিছুই নয়। ইউরোপে সাফল্যবুভুক্ষু একটা ক্লাবের বন্ধ দরজার চাবি তাঁর হাতে। তার আগে অ্যাটলেটিকোর বিরুদ্ধে আজ সাধন করতে হবে একরকম অসাধ্যই। তবে রোনালদো যখন আছেন, যে কোনো কিছুই তো সম্ভব!