রোনালদোর হ্যাটট্রিকে তুরিনে জুভেন্টাসের স্বপ্নের রাত
জুভেন্টাসের কাছ থেকে আগের দুইবার স্বপ্ন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। সেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো জুভেন্টাসকে এবার স্বপ্নটা ফিরিয়ে দিলেন। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠে ২-০ গোলে হেরে আসার পর চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বপ্নটা আরও একবার ফিকে হতে বসেছিল জুভেন্টাসের। কিন্তু আপনার দলে যদি একজন রোনালদো থাকে তাহলে তো সব সম্ভব! গ্রুপপর্বে মাত্র একবার গোল করেছিলেন। ব্যাপারটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর নামের পাশে বেশ বেমানান। কিন্তু নক আউট পর্বের রোনালদো অন্য ধাতুতে গড়া। চ্যাম্পিয়নস লিগ আর রোনালদোর প্রেম কাহিনি তাই শেষ হলো না, জুভেন্টাসকেও বাদ পড়তে হলো না। অবিশ্বাস্য এক হ্যাটট্রিকে তুরিনে জুভেন্টাসকে রোনালদো জিতিয়েছেন ৩-০ গোলে। দুই লেগ মিলিয়ে অ্যাটলেটিকোকে ৩-২ গোলে হারিয়ে তাই চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেছে জুভেন্টাস।
নক আউটপর্বে ৭৭ ম্যাচ খেলে এই নিয়ে রোনালদোর গোল দাঁড়াল ৬৩টি, সঙ্গে অ্যাসিস্ট আছে আরও ১৪টি। অর্থাৎ সবমিলিয়ে গোলে রোনালদোর অবদান ৭৭ ম্যাচে ৭৭ বার! আর আরও একটি হ্যাটট্রিক করে এখন চ্যাম্পয়িনস লিগে সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের মালিকও তিনি। সঙ্গে অবশ্য লিওনেল মেসিকেও পাচ্ছেন, দুইজনই করেছেন সমান ৮টি করে হ্যাটট্রিক।
পাহাড় অতিক্রম করতে হতো জুভেন্টাসকে। মঞ্চটাও প্রস্তুত ছিল রোনালদোর দানব হয়ে ওঠার। তুরিনে সমর্থকদের বিশ্বাসটাও ছিল তাই শতভাগ। অ্যাটলেটিকো অ্যালিয়াঞ্জ স্টেডিয়ামে সেটা টের পেল ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই। চাপে পড়ে ইউরোপের সবচেয়ে গোছানো দলটাই খেই হারিয়ে ফেলল। শুরু থেকে গডিন, হিমেনেজেদের চাপে ফেলার কাজটা করেছিলেন রোনালদোই। ৫ মিনিটের মধ্যেই অ্যাটলেটিকোকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, প্রথম লেগের গোলগুলো কেবল সংখ্যামাত্র। ব্লেইস মাতুদির শটের নাগাল অল্পের জন্য একবার মিস করলেন, আরেকবার ইয়ান অবলাককে চাপে ফেলে কিয়েলিনিকে গোলও করতে সাহায্য করলেন রোনালদো। অবশ্য সেই গোল পরে বাতিল হয়েছে অবলাককে করা রোনালদোর ফাউলেই। তাতে রোনালদো বা জুভে সমর্থকদের কারও মনোবলে চিড় ধরেনি। উল্টো দ্বিগুণ উদ্দ্যমে অ্যাটলেটিকোকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার কাজটা করে গেছে জুভেন্টাস।
ম্যাক্সিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি একাদশে চমক রেখেছিলেন। পাউলো দিবালার জায়গায় নামা ফ্রেডেরিকো বের্নাদেস্কি খেলেছেন জুভেন্টাসের জার্সিতে নিজের সেরা ম্যাচ। ২৭ মিনিটে বাম প্রান্ত থেকে তিনিই ক্রস করলেন, রোনালদো লাফিয়ে উঠে কঠিন অ্যাঙ্গেল থেকেও করলেন দুর্দান্ত এক হেড। জুভেন্টাসের এক গোল শোধ হয়ে গেল তাতেই, স্বপ্নটাও তখন থেকেই দেখতে শুরু করলো তুরিনের বুড়িরা। কিছুক্ষণ পর বের্নাদেস্কি নিজেও একটা ওভারহেড কিক করেছিলেন, কিন্তু লক্ষ্যে রাখতে পারেননি শট। বিরতির আগে রোনালদো প্রায় আরেকটু হলেই দ্বিতীয় গোলটাও করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু সে দফায় আর হেডে বল রাখতে পারেননি লক্ষ্যে।
প্রথমার্ধে অ্যাটলেটিকোকে কোনঠাসা করে রেখেছিল জুভেন্টাস। ডিয়েগো কস্তা ছিলেন না নিষেধাজ্ঞার কারণে। তার জায়গায় নামা আলভারো মোরাতাই দলের হয়ে সেরা সুযোগটা পেয়েছিলেন। কিন্তু রোনালদোর রাতে ভাগ বসাতে পারেননি। প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ে হেডই করেছিলেন, কিন্তু সেটা গেছে সেজনির বারপোস্টের বেশ খানিকটা ওপর দিয়ে। ম্যাচে সেটাই হয়ে থেকেছে অ্যাটলেটিকোর সেরা সুযোগ।
দ্বিতীয়ার্ধেও একই ধারায় প্রথম মিনিট থেকেই অ্যাটলেটিকোর ওপর চড়াও হয় জুভেন্টাস। বের্নাদেস্কিই শুরু করেছিলেন। অবশ্য হিমেনেজের সময়মতো ট্যাকেল সে দফায় বাঁচিয়ে দেয় অ্যাটলেটিকোকে। কিন্তু সেটাও অল্প সময়ের জন্যই। ৪৯ মিনিটে আর রোনালদো আটকাতে পারলেন না কেউই। ডিয়েগো গডিন আর হোসে মারিয়া হিমেনেজ রোনালদোকে এর আগেও পাঁচবার গোলশূন্য রেখেছিলেন। পর্তুগালের বিপক্ষে উরুগুয়ের বিশ্বকাপ ম্যাচেও এই দুইজনই ছিলেন নায়ক। কিন্তু রোনালদো এবার শোধ তুললেন কড়ায়-গন্ডায়। পর্তুগিজ সতীর্থ হুয়ান ক্যান্সেলোর ক্রস থেকে আরও একবার হেড করে করলেন, অবলাক ঠেকিয়েও দিলেন। কিন্তু অ্যাটলেটিকো স্বস্তি টিকল কয়েক সেকেন্ড মাত্র, গোললাইন টেকনোলজি জানিয়ে দিল অবলাক বল ধরার আগেই সেটা পার গেছে গোললাইন। রোনালদো ছুটলেন উদযাপনে, তার পেছনে ছুটলো দল। তুরিনে ততোক্ষণে দুই লেগ মিলিয়ে খেলার স্কোরলাইন দাঁড়িয়েছে ২-২।
আলেগ্রির নেওয়া সবগুলো সিদ্ধান্তই তুরিনে কাজে দিয়েছে শতভাগ। বের্নাদেস্কি তো ছিলেনই, সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা স্পিনাজোলাও ছিলেন দুর্দান্ত। ডিয়েগো সিমিওনের কৌশল শুরু থেকেই ভুল প্রমাণিত হচ্ছিল। হুয়ানফ্রান লেফটব্যাক পজিশনে ধুঁকেছেন, রোনালদোর সামনে তাকে মনে হয়েছে পাড়ার ডিফেন্ডার। সান্তিয়াগো আরিয়াসও স্পিনাজোলা, মাতুইদিদের আটকে রাখতে পারেননি। ফলাফল, একের পর আক্রমণ ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে অ্যাটলেটিকোর ডিবক্সে। আর দুই গোল হজম করার পর স্নায়ুর চাপে আরও খেই হারিয়ে ফেলে অ্যাটলেটিকো।
দিবালাকে ৬৭ মিনিটে নামিয়েছিলেন আলেগ্রি। মাঞ্জুকিচ, রোনালদো, বের্নাদেস্কি, দিবালা অবশ্য একসঙ্গে মাঠে থেকেছেন অল্প সময়ের জন্য। মাঠ ছাড়ার আগে মাঞ্জুকিচও হেডেই প্রায় তৃতীয় গোলটি করে ফেলেছিলেন। তার জায়গায় নামা ১৯ বছর বয়সী স্ট্রাইকার মুসা কিনও প্রথম শটেই গোল পাননি অল্পের জন্য।
নাটকের শেষ অঙ্কে সেই আরও একবার তাই রোনালদোর আবির্ভাব। বের্নাদেস্কি আরও একবার পার্শ্বনায়ক। অ্যানহেল কোরেয়া মাঠে নেমেছিলেন ৫৭ মিনিটে। এরপর কিছুটা চাঙা হয়েছিল অ্যাটলেটিকোর আক্রমণ। সেই কোরেয়াই ডিবক্সের ভেতর ফাউল করে বসেন বের্নাদেস্কিকে। রেফারিও বাজান পেনাল্টির বাঁশি। স্পটকিক থেকে অবলাককে ভুল দিকে পাঠিয়ে গোল করে রোনালদো ছুটলেন কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে। গতবার রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে এই মাঠ থেকেই প্রতিপক্ষ হয়েও করতালি পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। আরও একবার ওই কোণাটাই বেছে নিলেন উদযাপনের জন্য, পার্থক্য কেবল এবার গায়ের জার্সিটা সাদা-কালো স্ট্রাইপড। ৩৪ বছর বয়সেও যে রোনালদোর ঝুলিতে এমন কিছু জমা ছিল, সেটা অন্ধবিশ্বাস করেছিলেন জুভেন্টাসের হর্তাকর্তারা। রোনালদো এবার শুধু দিলেন ভরসার প্রতিদান। আরও একবার নতুন কীর্তি গড়লেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে সেটাই যেন হয়ে গেছে অমোঘ সত্যি।
প্রথম লেগে জিতেও তাই সিমিওনে মুখ কালো করেই বাড়ি ফিরেছেন। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ এর পর ২০১৯-এ এসেও এক রোনালদোর কাছেই হেরে গেলেন তিনি। ঘরের মাঠের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালটা তাই দর্শক হয়েই কাটাতে হচ্ছে তাকে। আর আরও একবার মাদ্রিদে ফেরার দিন-ক্ষণ গোণা শুরু দিয়েছেন রোনালদো। এবার জুভেন্টাসকে সঙ্গে করে নিয়ে।