হিগুয়াইনের শেষটা এমন নাও হতে পারত
ঘটনা ১:
মারাকানার ফাইনাল শেষে পরদিন সকালেই দেশে ফিরেছিল আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা শুরু করেছিল যে মাঠে, শেষও করেছে সেখানে। কিন্তু শেষ ম্যাচটাই হেরেছে তারা। নূন্যতম ব্যবধানে। কিন্তু ওই ব্যবধানের দূরত্ব জীবন-মরণের মতো। সাদা আর কালো।
বিমানবন্দর থেকে আর্জেন্টিনা দল সোজা রওয়ানা হয়েছিল প্রেসিডেন্টের বাসভবনে। তখনকার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজের সঙ্গে পুরো দলের সেদিনের কিছু ছবি গুগল ঘাটলেই পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্টের কোনো এক কথায় লিওনেল মেসি মুচকি হাসছেন, কোচ আলেহান্দ্রো সাবেয়ার মুখেও হাসি। ফটোফ্রেমে যতজন ধরে সবার চেহারা দেখে মনে হতে পারে আগের রাতের স্বপ্নভঙ্গের দুঃসহ স্মৃতি বোধ হয় ভুলেই গেছে দলটা। যদিও সে ধারণা ভুল। কিন্তু একটি জিনিস একেবারে হলফ করে দাবি করা যায়। গঞ্জালো হিগুয়াইন শূন্য দৃষ্টিতে দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন গোমড়া মুখে। হিগুয়াইনের মাথায় কি ঘুরছিল সেটা আগের রাতে খেলা দেখা প্রতিটি মানুষ বুঝতে পারে ওই এক মুখচ্ছবি দেখলেই।
হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকা হিগুয়াইনের স্বভাববিরুদ্ধ। সাধারণত দুই হাত মেলে, তেজ দেখিয়ে গোল উদযাপন করেন তিনি। আগের রাতেও একবার করেছিলেন। সুখ অবশ্য বেশিক্ষণ টেকেনি। উদযাপন থামাতে হয়েছিল রেফারির অফসাইড ফ্ল্যাগে। রেফারির বাঁশির শব্দও কানে পৌঁছেনি মারাকানার দামামার ভেতর।
ম্যাচশেষে হিগুয়াইন হয়ে গেলেন হাসির পাত্র। ওই উদযাপনের কিছুক্ষণ আগে একটা সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন হিগুয়াইন। টনি ক্রসের ব্যাক পাসটা জায়গামতো পেয়ে গিয়েছিলেন, কেবল ফিনিশটাই করতে পারেননি। ম্যানুয়েল নয়্যারের সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ানে মেরেছিলেন বাইরে দিয়ে। এরপর ওই বাতিল হওয়া গোলের উদযাপনের সঙ্গে মিলিয়ে হিগুয়াইন হয়ে গেলেন হালের নতুন চাল, ‘ট্রল’ পাত্র।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলের জন্ম আরও আগে। ফুটবলও শুরুরদিকেই রপ্ত করে নিয়ে ট্রলের জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ট্রলের নতুন যুগে সত্যিকার অর্থে একেবারে বড় মাপের প্রথম ইভেন্ট ছিল ব্রাজিলের ওই বিশ্বকাপই। হিগুয়াইন ক্লাবের হয়ে নিয়মিত গোল করেন, বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো ওরকম জায়গায় গিয়ে ভড়কে গিয়েছেন, ভুল তো করেছেনই, আবার করেছেন ব্যর্থ উদযাপনও! ফুটবলের ট্রল জগতে তাই হিগুয়াইনকে প্রথমদিককার বলিও বলা যায় তাই।
ঘটনা ২:
“অ্যান্ড হি মিসেস, দ্যা গেম, দ্যা গোল, দ্যা কাপ... অ্যাজ আর্জেন্টিনা কলাপসেস, উই আর গোয়িং টু দা এক্সট্রা টাইম"...
৯০ মিনিটের খেলা শেষের বাঁশি বাঁজার আগে আর্জেন্টিনার শেষ আক্রমণটি এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন ধারাভাষ্যকার। এজেকুয়েল লাভেজ্জির ক্রসটা শুধু পায়ে লাগানোই বাকি ছিল! ফাঁকা বারেও গোল দিতে ব্যর্থ হিগুয়াইন। মারলেন সাইডনেটে। সেই এক্সট্রাটাইমও গোলশূন্য থাকলে পরে টাইব্রেকারে চিলির কাছে হেরে কোপা আমেরিকার ঘরে তোলার স্বপ্নটাও বিসর্জন দিয়ে আসতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। ঠিক তার পরের বছর।
যেটাকে দুঃখ ভোলার মিশন হিসেবে দেখতে পারতেন, সেটা আরও দুঃস্বপ্নের যোগান দিয়ে গেল আর্জেন্টিনা আর হিগুয়াইনকে। ২০১৬ তেও একই গল্প, একই পরিণতি। ফাইনালে হারাটা অভ্যাসই বানিয়ে ফেলল আর্জেন্টিনা। আর হিগুয়াইন ফাইনালের খলনায়ক।
ঘটনা ৩:
২৮ মার্চ, ২০১৯। ৩১ বছর বয়সে আর্জেন্টিনাকে বিদায় বলেছেন স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়াইন।
পেশাদার ফুটবলার, পেশাদার অ্যাথলেট। বারবার একই ভুল করলে সমালোচনা সহ্য করতে হবে- সব খেলার জন্য সেটা তো সত্যিই, ফুটবলের জন্য অমোঘ বাণী। হিগুয়াইন সমালোচনা সহ্য করতে পেরে বা না পেরে অবসরে যান সেটা একান্তই তার ব্যাপার। কিন্তু বিপত্তিটা অন্য জায়গায়। যখন যাওয়ার সময় হিগুয়াইন বলে যান "আমি দলে আছি কি নেই, সেটা নিয়ে এখন আর আপনাদের চিন্তা না করলেও চলবে" - সেটা একদিক দিয়ে আমাদের সবাইকে দোষী করে দিয়ে যায়। কারও হাল ছেড়ে দেওয়ার পেছনেও ভূমিকা রাখছি না তো আমরা?
****
আধুনিক ফুটবল লাগামছাড়া হয়ে গেছে বহু আগেই। স্টেডিয়ামে যাওয়া বিরাট একদল মানুষও এখন খেলা দেখেন নিজের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড ধরে নিয়মিত পোস্ট করা মাঝারি মানের খেলোয়াড়েরাও হয়ে যান দ্বিগুণ সমর্থক প্রিয়। ফুটবলের বিশুদ্ধতম তর্কযুদ্ধে তাই পায়ের কারিকুরির সঙ্গেও ঝিম লাগানো সামাজিক দুনিয়াও তাই ঢুকে পড়ে মোহের মতো।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সোশ্যাল মিডিয়াকে এখন আর জীবনের বাইরে রাখার উপায় নেই বললেই চলে। স্বাভাবিকভাবেই খেলোয়াড়েরাও সেখানে থাকবেন। সমালোচনার একটা ধাঁচ থাকে, আর ভালো সমালোচনার একটা আঁচও থাকে। সেই আঁচে পাপ পুড়ে পূন্যও হয়। সেটা না হয়ই বাদই দেওয়া গেল, কিন্তু সমালোচনার ধাঁচ তো অন্তত থাকবে? সৌম্য সরকারকে তাই নেতিবাচকতার হাত থেকে রেহাই পেতে ফেসবুক থেকে দূরে থাকতে হয়। সাকিব আল হাসান আরও বড় মাপের খেলোয়াড়। চাইলেই যেটা ইচ্ছা করতে পারেন না। অনিচ্ছা নিয়েই নাকি তাই চালিয়ে যাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম।
আর্জেন্টিনার এই টানা তিন ফাইনাল হারের দলটাকে সে দেশের সোনালী প্রজন্মও বলা যায়। সেখানকার সমস্যা এতোটাই প্রকট যে খেলোয়াড়দের জনসম্মুখে ‘ট্রল’ নিয়ে অভিযোগ করতে হয়। অ্যানহেল ডি মারিয়া নিজ দেশে বিদ্রুপ সহ্য না করতে পেরে আওয়াজ তুলেছিলেন, তাতে আরেক মাত্রা বেশি বিদ্রুপ জুটেছে তার কপালে। মেসি তো একবার অবসরেই গিয়েছিলেন চাপে পড়ে। এখানে খেলোয়াড়দের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই একদমই। এই খেলোয়াড়রা প্রতি সপ্তাহে প্রতিপক্ষের মাঠে খেলতে যান, বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করেন, সমর্থকদের দুয়ো শোনেন। অথচ তারাই একটা বিদ্রুপাত্মক ছবিতে মনোবল হারাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার এই শক্তি কি অপশক্তি নয়?
মেসি-হিগুয়াইন-আগুয়েরোর আক্রমণভাগের কথাই ভাবুন। জাতীয় দলে এমন ত্রয়ী শেষ কবে এসেছিল আর কবে আসবে দুইটিই অজানাই। কিন্তু জাতীয় দলকে বিদায় বলার সময় হিগুয়াইন যা বলে গেলেন সেটা নতুন আরেক অধ্যায়ের সূচনা করে গিয়ে গেল বোধ হয় খেলার জগতে। খেলার শব্দের সূচনালগ্ন থেকে এই বস্তু গণমানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে। নতুন এই অধ্যায়টা আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যাব, নাকি সেটার সমাপ্তি টানব সেই শক্তিও আপনার-আমার হাতেই ন্যস্ত।
হিগুয়াইনের অবশ্য জাতীয় দলে সময়টাও ভালো যাচ্ছিল না। যাওয়া আসার ভেতর ছিলেন মাঝের অনেকটা সময়। ৭৫ ম্যাচে ৩১ গোল করেছেন। ক্লাবের হিগুয়াইন অবশ্য অন্য ধাতুতে গড়া। ইউরোপের সর্বোচ্চ গোলদাতার ছোট তালিকাতেও আছেন তিনি। গড়ে প্রতি দুই ম্যাচে একটি করে গোল আছে তার। স্পেন, ইতালি- যেখানেই গেছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড গড়েছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে সেই ফর্ম টেনে আনতে না পারার ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবেন না তিনি কোনোভাবেই। হয়ত তিন ফাইনালের একটি কাজে লাগাতে পারলে নিজের দেশের শিরোপা খরা কাটাতে পারতেন, মেসিকে চোখবুজে বিশ্বসেরা খেতাব দেওয়া লোকের সংখ্যাটাও বাড়াতে পারতেন। পারতেন নিজের ভাগ্যটাও বদলাতে। সেসব পারেননি। কিন্তু চেষ্টা করার সময় তো ফুরিয়ে যায়নি। আর্জেন্টিনাকে ভালো স্ট্রাইকারের জন্য ভুগতে হয়নি কখনই। কিন্তু হিগুয়াইন এমন সময়ে বিদায় বললেন যখন তরুণরা সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারছে না। আনকোরা দলে মরক্কো, ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে গোল করার মতো লোকই খুঁজে পাচ্ছে আর্জেন্টিনা- এমন একটা সময়ে। ভাগ্য আর সময় এতোটা নির্দয় না হলে হয়ত আরেকটা চেষ্টা করতেই পারতেন তিনি। কিন্তু সেটা না করে অস্থির সময়ে স্বস্তি খুঁজতে সহজ পথটাই বেছে নিলেন বাধ্য হয়ে।
হিগুয়াইনের অবসরের এমন ব্যবচ্ছেদে সবাই হয়ত একমত হবেন না। কাড়ি কাড়ি টাকার আধুনিক ফুটবলের সোপ অপেরা চায় খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের কন্টিনিউয়াস কার্ভ। চায় নায়ক আর ভিলেন। সে নাটকে সবকিছু বিচার হয় সাদা আর কালোর জাদুমন্ত্রে। জয়ীরা জেতে, ব্যর্থরা ফিরে যায়। আর ধাপে ধাপে সবকিছু জয় করে শেষ অঙ্কে গিয়ে যে হেরে যায়, সেটা হচ্ছে ব্যর্থতারও ব্যর্থতা। ক্লাবের হয়ে যত গোল থাক, যত সাফল্য থাক- হিগুয়াইনের গল্পটা লেখা হয়ে ছিল আগে থেকেই।