ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ
প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে চতুর্থ স্থান অধিকারী মো : নাহিন মাহমুদ-এর লেখা 'ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ'।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস হয়তোবা তেমন ঐতিহ্যমণ্ডিত নয়, হয়তো নেই তেমন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি এদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা এটিকে খেলার চেয়েও অনেক উপরের স্থানে বসিয়েছে। তাইতো বাংলাদেশের খেলার দিনটি এদেশের মানুষের কাছে এখন অঘোষিত উৎসবের দিন। আর এ উৎসবের উপলক্ষ আমাদের এই ক্রিকেটাররা। ৩১ মার্চ ,১৯৮৬ থেকে, ২০১৪ সালের এই লগ্ন, মাত্র ২৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাস এই বদ্বীপের। অন্যান্য দেশের তুলনায় হয়তো তেমন সমৃদ্ধ নয় তা, কিন্তু চার দশকের এই পথচলায় বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশ পেয়েছে এমন কিছু ক্রিকেটার যারা শ্রেষ্ঠ ছিলেন নিজ নিজ সময়ে, নিজ নিজ জায়গায়। নিজেদের প্রতিভা আর দক্ষতার জোরে যারা সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষেরও। যাদের সম্মিলিত অবদানেই আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ‘বাঘের বাচ্চা’ থেকে সত্যিকারের ‘বাঘ’ হওয়ার পথে। সেইসকল জাতীয় বীর ক্রিকেট তারকাদের মধ্য থেকে অনেক যুক্তি, আবেগ, আর দক্ষতার বিচারে বেছে নেয়া এই আমার সর্বকালের সেরা বাংলাদেশ ওয়ানডে একাদশ......
যেকোনো ফরম্যাটের ক্রিকেটেই দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের উপরই খেলার গতিপথ নির্ধারিত হয়ে যায় অনেকসময়। আর উদ্বোধনী জুটির শুভসূচনা মানেই বড় স্কোরের ভিত্তি তৈরি। তাই আমার এই একাদশে ইনিংসের শুরু করবেন আমার দৃষ্টিতে এ যাবতকালের সেরা ওপেনার তামিম ইকবাল। কেনো তামিম এই প্রশ্ন অবান্তর নাহলেও অবাক করাই হবে আমার কাছে। আক্রমণাত্মক এই ব্যাটসম্যান তার সময়ের অন্যতম সেরা। প্রতিভা, পারফরম্যান্স, সবকিছুতেই তিনি অনন্য। ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেয়ার মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে তাকেই। আর তার সঙ্গী হবেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান। কেন আতাহারকে বেছে নিলাম, তার জন্য শুধু একটা বাক্যই যথেষ্ট, টেস্টপূর্বযুগে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন এই আতাহার। মেহরাব হোসেনের শতরানের আগে ভারতের বিপক্ষে ৭৮ আর পাকিস্তানের বিপক্ষে করা ৮২ ছিল বাংলাদেশের সেরা দুটি ইনিংস। লম্বা গড়নের এই খেলোয়াড় ডানহাতি মিডিয়াম বোলিংটাও বেশ ভালই করতেন। তিনি দলে থাকা মানে দলে একজন অলরাউন্ডার বেড়ে যাওয়া। ডানহাতি- বাঁহাতি এই দারুণ জুটিটিকেই আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে।
ওয়ানডাউন পজিশনে আমার সবসময়ই পছন্দ দলের সবচেয়ে খারাপ সময়ের বড় তারকা হাবিবুল বাশার। কয়েকবছর আগেও যখন বাংলাদেশ মাঠে নামা মানে ছিল অসহায় আত্মসমর্পণ, তখনো নিয়মিতই তার ব্যাট হাসতো। নিয়মিতই ৫০ এর কোঠা পেরোনোর কারণে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘মিস্টার ফিফটি’ । বাংলাদেশের এযাবতকালের সবচেয়ে সফল ২০০৭ বিশ্বকাপের নেতৃত্ব ছিল এই ব্যাটসম্যানের হাতে। আমার দলেও এর ব্যতিক্রম নেই। দলে তিনি খেলবেন অধিনায়ক হিসেবেই। একপ্রান্ত ধরে রেখে খেলে যাওয়ার জন্য তার জুড়ি মেলা ভার।
চারে আমার পছন্দ মোহাম্মদ আশরাফুল, এই পছন্দটা করতে যেয়ে অনেক বেশি ভাবতে হয়েছে। আবেগ, যুক্তি, নীতি সবকিছুর সাথে অনেক যুদ্ধ করেই তাকে রাখা। ম্যাচফিক্সিং কলঙ্ক বাদ দিলে, এ বদ্বীপে জন্ম নেয়া সময়ের অন্যতম সেরা তারকা এই আশরাফুল। তার কীর্তির কথা বলতে গেলে হাজার শব্দও যথেষ্ট নয়। ফর্ম নিয়ে যতো কানাঘুষাই হোক ক্লাস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন আশরাফুল রান পাওয়া মানেই ছিল বাংলাদেশের জয় অবধারিত।
পাঁচ নম্বরে আমি জায়গা দিতে চাই, টেস্ট পূর্বযুগের অন্যতম স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান মিনহাজুল আবেদিনকে। দায়িত্ব নিয়ে খেলার জন্য যথেষ্ট শুনাম ছিল তার। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্বকাপে দুটি অর্ধশতকের দেখা পান, ১৯৯৯ বিশ্বকাপে। যারমধ্যে ছিল, সেবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫৩ রানের ইনিংস। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত সফল এই ব্যাটসম্যান এখন নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করছেন। মিডেলঅর্ডারে তারমতো আস্থাভাজন একজনকে রাখার কারণ একইসাথে রানের চাকা সচল রাখা এবং বিপদের সময় অভিজ্ঞতার সবটুকু দিয়ে দলের হাল ধরা।
ছয় নম্বরে সাকিব আল হাসান ছাড়া আমার মতে কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার হচ্ছেন আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে জন্মানো এখন পর্যন্ত সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ। যেকোনো দলেই শুধু বোলার বা শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার যোগ্যতা রাখেন তিনি। তার বাঁহাতি স্পিন যে কতটা বিষাক্ত হতে পারে তা সকলেরই জানা। সেইসাথে দুর্দান্ত ফিল্ডিং তো আছেই।
সাতে উইকেটরক্ষক হিসেবে আমার পছন্দ মুশফিকুর রহিম, যিনি একইসাথে দলের সহ-অধিনায়ক। ব্যাটিং দক্ষতার কারণেই অন্য যে কারো থেকে তাকে এগিয়ে রাখা। আর নেতৃত্বের গুন সম্পর্কে তো বর্তমান ক্রিকেট অনুরাগী সবাইই জানেন। স্লগওভারে তারমতো একজন ব্যাটসম্যান থাকা মানে রানের চাকা দুরন্ত গতিতে চলা। প্রয়োজনের সময় যেমন মারমুখী হতে পারেন তেমনি দরকারের সময় ঠাণ্ডা মাথায় খেলে জেতে পারেন উইকেট ধরে রেখে।
আট নম্বরে আমার পছন্দ ছিল একজন অফস্পিন বোলিং অলরাউন্ডার। কিন্তু তেমন নির্ভরযোগ্য কাউকে পাইনি যিনি অফস্পিন ভালো করতেন। বাঁহাতি স্পিনারদের স্বর্গভুমি এই দেশে ভরসার জায়গায় তাই মোহাম্মাদ রফিক। যিনি অনেক দুর্যোগের সময়ও প্রতিপক্ষকে নিয়মিতই ভোগাতেন। আর শেষ ওভারগুলোয় তার পাওয়ার হিটিং ছিল দারুণ সময়োপযোগী।
নয়ে আর কেউ নয়, দলের পেস আক্রমণের নেতা মাশরাফি। বল হাতে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নাম কুড়ানো এই পেসার ব্যাট হাতেও খেলতে পারেন বড় শট, যা শেষের দিকের ওভারগুলোতে ভীষণ কার্যকর।
দশ নম্বরে থাকবেন এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বাধিক উইকেটশিকারি আব্দুর রাজ্জাক। আর এগারোতে থাকবেন নতুন বলে মাশরাফির সঙ্গী হিসেবে দলে থাকা সৈয়দ রাসেল। বোলিং আক্রমণে বৈচিত্র্য আনার জন্যই এ বাঁহাতিকে দলে নেয়া। আর সীমিত ওভারের খেলায় দারুণ হিসেবী এই বোলারের কার্যকারিতা সবসময়ই প্রশ্নাতীত।
ব্যাটিং অর্ডার সাজাতে যেয়ে যে ব্যাপারটার অভাব অনুভব করেছি তা হলো একজন অফস্পিন বোলিং অলরাউন্ডারের শুন্যতা । সেই অফস্পিনারের শুন্যতা পূরণ করার জন্য মিনহাজুল আর আশরাফুলের উপর নিঃসন্দেহে আস্থা রাখব আমি। পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে আতাহারের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ নেই। তারসময়ে দলে তিনি একজন মূল বোলারেরই দায়িত্ব পালন করতেন। অনেক বড় ম্যাচে ভালো বল করারও নজির আছে তার।
দলের বোলিং আক্রমণ শুরুই হবে মাশরাফিকে দিয়ে, অন্যপ্রান্ত থেকে তাকে সঙ্গ দিবেন সৈয়দ রাসেল। পেস আক্রমণে তাদের সঙ্গী হিসেবে থাকবেন আতাহার। আর সাকিব, রাজ্জাক, রফিককে নিয়ে গড়া বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণকে তো আমার কাছে মনে হয় বিশ্বসেরা স্পিন আক্রমণ।
আর ফিল্ডিং দক্ষতায়ও এ দলকে সেরার কাতারে ফেলা যায় অনায়াসে। দলের দ্বাদশ ব্যাক্তি হিসেবে দুর্দান্ত ফিল্ডার হিসেবে নাসিরকেই পছন্দ করবো। যদিও সাম্প্রতিক সিরিজে তার ফিল্ডিঙে বেশকিছু খুত দেখা গেছে, কিন্তু মাঠে তারমতো একজন উদ্যমী ফিল্ডার থাকলে দলের মনোবলও চাঙা থাকবে।
এক সাথে সাজাতে গেলে আমার পছন্দের দলটি দাড়ায় অনেকটা এমন –
১. তামিম ইকবাল
২. আতাহার আলী খান
৩. হাবিবুল বাশার ( অধিনায়ক )
৪. মোহাম্মাদ আশরাফুল
৫. মিনহাজুল আবেদীন
৬. সাকিব আল হাসান
৭. মুশফিকুর রহিম ( সহ-অধিনায়ক এবং উইকেটরক্ষক )
৮. মোহাম্মাদ রফিক
৯. মাশরাফি বিন মরতুজা
১০. আব্দুর রাজ্জাক
১১. সৈয়দ রাসেল
১২. নাসির হোসেন ( দ্বাদশ ব্যাক্তি)
এই স্বপ্নের দলের সবার হয়তো কখনোই একসাথে খেলা হয়নি, হবেওনা কোনোদিন। এই দলের কারো ক্রিকেট ক্যারিয়ার হয়তো শেষ হয়ে গেছে কারো কারো খেলা শুরু হওয়ার আগেই। কিন্তু তাও এরা সকলেই আমাদের এই বাংলার গর্বিত ক্রিকেটবীর। এদের প্রত্যেকের একেকটা পারফরম্যান্সের তুলির আঁচড়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট নামক এক অনন্যসাধারণ তৈলচিত্র। যেখানে তুলির প্রতিটা আঁচড় আমাদের দেশের প্রতিটা ক্রিকেটপাগল মানুষের কাছে স্বপ্নের অপর নাম।