• বুন্দেসলিগা
  • " />

     

    'ফাইনালের' আগে 'ডের ক্লাসিকোর' ডামাডোলে...

    'ফাইনালের' আগে 'ডের ক্লাসিকোর' ডামাডোলে...    

    ১১ এপ্রিল, ২০১২। সিগনাল ইদুনা পার্কে অভিজ্ঞ বায়ার্ন মিউনিখের মুখোমুখি ইয়ুর্গেন ক্লপের তরুণ বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। ২৯ ম্যাচে ডর্টমুন্ডের পয়েন্ট ৬৬, বায়ার্নের ৬৩। আক্ষরিক অর্থেই মৌসুম নির্ধারণী ম্যাচ। ৭৭ মিনিটে গোল করে দলকে শিরোপার সুবাস এনে দিলেন রবার্ট লেভানডফস্কি। কিন্তু নাটকের বাকি ছিল তখনও। ৮৬ মিনিটে ডিবক্সে পড়ে গিয়ে পেনাল্টি আদায় করলেন বায়ার্নের আরিয়েন রোবেন। ডর্টমুন্ড সমর্থকদের হৃৎস্পন্দন যেন ঠিক শোনা যাচ্ছিল সিগনাল ইদুনা পার্কে।

    বুন্দেসলিগা ক্যারিয়ারে রোবেনের তখন পর্যন্ত পেনাল্টি পরিসংখ্যান ৭/৭, শতভাগ কার্যকর। কিন্তু সেদিনটা, সে মৌসুমটা যেন ডর্টমুন্ডের কুঁড়িদের ফুল হয়ে ওঠার সময়। আগের টানা ৩ ম্যাচে ডর্টমুন্ডের কাছে হারের রেকর্ডটা ভেঙ্গে দেওয়ার সুযোগ হারালেন রোবেন, ১২ গজ থেকে বুন্দেসলিগা ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম পেনাল্টি মিস করলেন। ছুটে এলেন ডর্টমুন্ড ডিফেন্ডার নেভেন সুবোটিচ, রোবেনকে যেন ভেংচি কেটে করলেন বুনো উদযাপন। বুন্দেসলিগা যেন ফিরে গেল ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে, যেবার ডর্টমুন্ডের আন্দ্রেয়াস মোলারকে ব্যঙ্গ করে ক্রন্দনরত শিশুর অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন বায়ার্নের লোথার ম্যাথাউস। সুবোটিচ যেন নিলেন মোলারের প্রতিশোধই। ৯৫-৯৬, ১১-১২- দুই মৌসুমেই ডর্টমুন্ডের মাথায়ই উঠল জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।

     

     

    বায়ার্ন-বরুশিয়ার এমন শত্রুতা বেশ আগের। তবে জার্মানিতে বাভারিয়ানদের একচেটিয়া আধিপত্যে সেই 'রাইভালরি' যেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরিই হয়ে ছিল দীর্ঘদিন। হঠাৎই সেখানে লাভার দেখা মিলতে লাগল নব্বইয়ের দশক থেকে। একাডেমী থেকে একঝাঁক তরুণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত কিছু সাইনিং দিয়ে বায়ার্নকে সমানে সমান টেক্কা দিতে লাগল ডর্টমুন্ড। ৯৫-৯৬ মৌসুমে জার্মান শিরোপা, আর পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ- ডর্টমুন্ডের আগমনী বার্তা ঠিকই শুনেছিল ফুটবলবিশ্ব। কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। দুই মৌসুম পরই আবারও হারিয়ে গেল হলুদ কালোরা। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার মতই ক্ষণিকের প্রতিরোধের পরই হার মানতে হল বায়ার্নের আধিপত্যের সামনে।

     

     

    তবে শত্রুতা ভুলে ডর্টমুন্ডকে সাহায্য করা ক্লাবটির নামও বায়ার্ন। ২০০৩-০৪ মৌসুমে দেউলিয়া হতে বসেছিল ডর্টমুন্ড। এমনই দৈন্য দশা, নিজেদের ফুটবলারদেরই বেতন দিতে পারছিল না তারা। ক্লাবকে বাঁচাতে শেয়ার বাজারে বিক্রির জন্য তুলে দিয়েছিল হর্তাকর্তা। আর তখনই এগিয়ে এল বায়ার্ন, ডর্টমুন্ডকে ২ মিলিয়ন ইউরো অনুদান দিল বাভারিয়ানরা। যাতে অন্তত ফুটবলারদের বেতন দিতে পারে ডর্টমুন্ড। প্রচার-প্রসার বাড়াতে যে কাজটা করেনি বায়ার্ন, তার প্রমাণ মেলে যখন এই অনুদানের খবর প্রথমবারের মত মিডিয়ায় ২০১২ সালে, মূল ঘটনার প্রায় ৮ বছর পর। এতদিন জনসম্মুখে এ নিয়ে কখনও কথাই বলেনি বায়ার্ন।  

     

     

    ডর্টমুন্ডের পুরো ইতিহাস বলতে গেলে এমনই। হ্যালির ধূমকেতুর মত হুটহাট দেখা মেলে তার, আবার সেই উত্থান মিলিয়ে যেতেও সময় নেয়না। আর পতনটাও হয় এমনই হতাশাজনক। মার্কো রয়েস, লেভান্ডফস্কি, শিনজি কাগাওয়ার মত তরুণ, আর ডাগআউটে ক্লপের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক- ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা রোবেন, রিবেরিতে গড়া বায়ার্নও হার মানে তাদের কাছে। ইউরোপেও নিজেদের চেনাতে থাকে ডর্টমুন্ড। ২০১২-১৩ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেও চলে যায় তারা, প্রতিপক্ষ সেই চিরশত্রু বায়ার্ন। হার মানে ডর্টমুন্ড, শেষদিকে জয়সূচক গোল করে ১১-১২ মৌসুমের প্রতিশোধ নেন রোবেন। আবারও ডর্টমুন্ডের উত্থানের গল্পটা হয়ে যায় ক্ষণিকেরই।

     

     

    বায়ার্ন-ডর্টমুন্ডের রাইভালরি বেশ পুরনো হলেও দুই দলের মধ্যে পার্থক্য রীতিমত আকাশ পাতাল। ডর্টমুন্ডের বার্ষিক বাজেটের বায়ার্নের থেকে যোজন যোজন কম। তার ওপর প্রায় প্রতি মৌসুমেই ডর্টমুন্ডের কাউকে না কাউকে দলে নেয় বাভারিয়ানরা। শুরুটা হয়েছিল জার্মানদের বিশ্বকাপ নায়ক মারিও গোটজেকে দিয়েই; এরপর এসেছেন লেভানডফস্কি, ম্যাটস হামেলসরা। কিন্তু তারপরও ডর্টমুন্ড টেক্কা দিয়ে যায়। প্রতিপক্ষ যখন বায়ার্নের মত পরাক্রমশালী কেউ, তখন দ্বিতীয় হওয়াটাও হয়ত খুব একটা খারাপ দেখায় না।

    গত কয়েক বছর হয়েছেও তা-ই। ওয়েম্বলিতে সেই চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের পর বায়ার্নের সামনে আর দাঁড়াতেই পারেনি ডর্টমুন্ড। সিগনাল ইদুনা বা আলিয়াঞ্জ অ্যারেনা- 'ডের ক্লাসিকার'-এ জয়জয়কার বায়ার্নেরই। আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে শেষ ৩ ম্যাচে ডর্টমুন্ড হেরেছে ৬-০, ৪-১, ৫-১ গোলে। কিন্তু ২০১৮-১৯ মৌসুম যেন জানিয়ে দিয়ে গেল নতুন আগমনী বার্তার।

    এই মৌসুমেই হটসিটে এসেছেন লুচিয়ান ফাভ্রে। রীতিমত খোলনলচে বদলে দিয়েছেন দলকে। নতুন কোচ, দলে একাধিক নতুন মুখ। কিন্তু ডর্টমুন্ডের এই মৌসুমের পারফরম্যান্সের ভিত সেই আগেরটাই। বুদ্ধিদীপ্ত সাইনিং এবং প্রতিভাধর একাডেমীর ফুটবলারদের সুযোগ দেওয়া। বার্সেলোনায় রীতিমত 'মেয়াদোত্তীর্ণ' হয়ে যাওয়া পাকো আলকাসেরকে আনলেন, স্প্যানিশ স্ট্রাইকার হয়ে গেলেন গোলমেশিন। এই মৌসুমে ডর্টমুন্ডকে একাধিকবার বাঁচিয়েছেন পাকো, গত সপ্তাহেও উলভসবুর্গের সাথে দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে জোড়া গোল করে জয় এনে দিয়েছেন।

     

     

    ম্যান সিটির যুবদল থেকে নিয়ে আসলেন জেডন সানচো নামের এক তরুণকে, ইউরোপ প্রায় সব বড় ক্লাবই যার পেছনে ছুটছে এখন। পুরনো দিনের সৈন্য সেই রয়েস, ওয়াইগেলরা তো আছেনই। এই তরুণদের নিয়েই সিগনাল ইদুনায় মৌসুমের প্রথম 'ডের ক্লাসিকার'-এ ৩-২ গোলে বায়ার্নকে হারিয়ে দেন ফাভ্রে। ১১-১২ মৌসুমের মত সেদিনও ম্যাচের শেষদিকে বল জালে পাঠিয়েছিলেন লেভানডফস্কি। তবে গোলটি বাতিল হয়েছিল অফসাইডের জন্য। ডর্টমুন্ড ছেড়ে বায়ার্নে যোগ দেওয়ায় এমনিতেই ডর্টমুন্ড সমর্থকদের চোখের বালি হয়ে গেছেন লেভা। গোল বাতিল হওয়ার তার দিকে ডর্টমুন্ড সমর্থকদের দুয়ো, বিদ্রূপ, ভর্ৎসনা হয়ত চিরদিনই মনে রাখবেন পোলিশ স্ট্রাইকার।

    মৌসুমের শুরুতে একের পর এক জয়ে টেবিলের শীর্ষস্থান সুসংহত করছিল ডর্টমুন্ড, আর নিকো কোভাচের অধীনে বায়ার্নকে চেনাই দায়। একটা সময় তো শীর্ষ চারের বাইরেই চলে গিয়েছিল বাভারিয়ানরা, চাকরি যায়যায় অবস্থা কোভাচের। কিন্তু প্রতি বছর যা হয়, এবারও হল তা-ই। বায়ার্ন ফিরল তাদের মতই, ডর্টমুন্ড পা হড়কালেও হাল ছাড়ল না, হারাল না শীর্ষস্থান। ২৭ ম্যাচ শেষে ডর্টমুন্ডের সংগ্রহ ৬৩, আর বায়ার্নের ৬১। কেন এই মৌসুমে ম্যাচটিকে 'অঘোষিত ফাইনাল' বলা হচ্ছে, মিলিয়ে নিন নিজেই। 'গেম অফ থ্রোনস'-এর আদলে বানানো ছবি আপলোড দিয়ে কালকের ম্যাচের উত্তাপে ঘি ঢেলে দিয়েছে বায়ার্ন।

     

     

    বুন্দেসলিগাকে রীতিমত নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা বায়ার্ন হয়ত এই মৌসুমে কিছুটা আত্মতুষ্টিতেই ভুগেছে জার্মান শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার মিশনে, মানেন ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের মত কিংবদন্তীরা। সুযোগটা ঠিকমতই কাজে লাগিয়েছে ফাভ্রের ডর্টমুন্ড। আরও ভাল করে বললে, কাজে লাগাতে হয়েছে। কারণ এমন সুযোগ তারা শেষবার পেয়েছিল ৭ বছর আগে। ডর্টমুন্ডের মত বায়ার্নেরও প্রমাণ করার আছে অনেক কিছুই। চ্যাম্পিয়নস লিগের ভরাডুবির পর লিগ হারানোর জোর আশঙ্কা চেপে ধরেছে কোভাচকে। জার্মান কাপ, বুন্দেসলিগা কোনোটিই ঘরে তুলতে না পারলে প্রায় এক দশক পর ট্রফিশূন্য মৌসুম কাটাবে বায়ার্ন। সেটা হলে প্রথম মৌসুমেই যে বায়ার্নকে বিদায় জানাতে হবে, ভালমতই জানেন কোভাচ।

    বিদায়ের ব্যাপারটাই আসলে আগামীকাল বায়ার্নের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এই মৌসুম শেষে বাভারিয়ানদের বিদায় বলবেন রিবেরি-রোবেন। ২০১৩-১৪ মৌসুমে 'ট্রেবল' জয়ের মূল দুই কাণ্ডারির বিদায়বেলায় ইউরোপে কিছুই করতে পারল না বায়ার্ন, অন্তত জার্মানিতে শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে আরেকবার 'বিয়ার সিক্ত' উদযাপনেই দুই কিংবদন্তীকে বিদায় জানাতে চাইবে তারা। ফরওয়ার্ডদের বিচারে বায়ার্নের যেখানে এক সাম্রাজ্যের প্রস্থান ঘটছে, সে সময়েই উত্থান হচ্ছে ডর্টমুন্ডের আরেক প্রজন্মের।

    সানচো-রয়েস-আলকাসের ত্রয়ী এবার যে সুবাস ছড়াচ্ছে, আগামী মৌসুমে সেটা থাকে কি না সেটাও প্রশ্ন। অনেকেই তো পুরোপুরি ডানামেলার আগেই চলে গেছেন ডর্টমুন্ড থেকে। পুলিসিচ এর মধ্যে নাম লিখিয়েছেন চেলসিতে, সানচোর পেছনেও ছুটছে বড় ক্লাবগুলো। এরকম আরেকটি প্রজন্ম পেতে ডর্টমুন্ডকে কতদিন অপেক্ষা করতে হয় কে জানে। বায়ার্নকে আরেক বার বাগে পাওয়ার প্রতীক্ষাও হয়তো বাড়বে। কালকের ম্যাচটা তাই ডর্টমুন্ডের জন্য একটা ডের ক্লাসিকো শুধ নয়, এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি কিছু।