চিরায়ত রোমাঞ্চের নাম 'ভারত বনাম পাকিস্তান'
‘৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের হয়তো আলাদা করে কোন বিশেষত্ব ছিল না। কিন্তু উপমহাদেশের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ম্যাচ মানেই যেখানে রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চে হৃৎপিণ্ড বের হয়ে আসার জোগাড়, কথার লড়াইয়ে আর মুখের অভিব্যক্তিতে প্রতিপক্ষকে ঝলসে দেয়ার চেষ্টা, প্রিয় দলের জয় কামনায় অগুনিত ভক্ত-অনুরাগীর নিরবিছিন্ন প্রার্থনা...সেখানে বাড়তি বিশেষত্ব খোঁজাটাই তো বাহুল্য!
ব্যাঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের ওই ম্যাচটি দিয়ে দীর্ঘ সাত বছর পর ‘আজন্মশত্রু’দের মাঠে নেমেছিল টিম পাকিস্তান। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন। প্রথম উইকেট জুটিতে নভোজোৎ সিং সিধু আর শচীন টেন্ডুলকার যোগ করেন ৯০ রান। ব্যক্তিগত ৩১ রান করে আতাউর রহমানের বলে শচীন বোল্ড হয়ে গেলেও একপ্রান্ত আগলে রেখে রানের চাকা সচল রাখেন সিধু। দলীয় ১৬৮ রানের মাথায় সিধু ফিরে যান ১১৫ বলে ৯৩ রান তুলে, মুশতাক আহমেদের ‘বোল্ড’ শিকার হয়ে। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়তে থাকলে এক পর্যায়ে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬ উইকেটে ২৩৬। তবে লোয়ার মিডল অর্ডার থেকে দাঁড়িয়ে যান আরেকজন, অজয় জাদেজা। মারমুখী ব্যাটিংয়ে মাত্র ২৫ বল মোকাবেলায় জাদেজা করেন ৪৫। ওয়াকার ইউনুসের বলে এই ডানহাতি যখন আমীর সোহেলের তালুবন্দী হলেন তখন ভারতের স্কোরবোর্ডে ২৭৯ রান। অষ্টম-নবম উইকেট জুটিতে শ্রীনাথের ৪ বল থেকে ১২ রান সেটিকে নিয়ে যায় ২৮৭-তে। শেষ চার ওভারে ভারত তোলে ৫৭ রান, যার মধ্যে ২২-ই ছিল ওয়াকার ইউনুসের এক ওভার থেকে।
২৮৮ রানের জয়ের লক্ষ্যে পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের শুরুটা বেশ দুর্দান্তই ছিল। দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান সাঈদ আনোয়ার ও ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক আমির সোহেল প্রথম দশ ওভারে তোলেন ৮৪ রান। এর পরপরই সাঈদ আনোয়ার মাত্র ৩২ বল থেকে ৪৮ রান তুলে শ্রীনাথের বলে কুম্বলের হাতে ক্যাচ তুলে ফিরে যান। কিন্তু ইজাজ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে আমির সোহেল যেভাবে এগোচ্ছিলেন তাতে বাদবাকি শ’ দুয়েক রান খুব দূরের পথ মনে হচ্ছিল না। ভারতের ব্যাটিংয়ের সময় গ্যালারীর উত্তাপে প্রতিপক্ষকে ঝলসে দিতে প্রস্তুত ৩৫ হাজার দর্শকের মাঝে তখন শ্মশানের নিরবতা। উইকেটে দাঁড়িয়ে যাওয়া আমির সোহেল বোধহয় একটু বেশীই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন। এক্সট্রা কাভার দিয়ে ভেঙ্কটেশ প্রসাদের বল সীমানাছাড়া করে আত্মপ্রসাদটুকু চেপে রাখতে পারলেন না। ব্যাটটা সীমানার দিকে তাক করে প্রসাদকে যেন ইশারা করলেন, “বলটা তুলে আনো”। অপমানটা নীরবেই হজম করে নিলেন ডানহাতি পেসার। কিন্তু জবাবটা যে এতো দ্রুত মধুর প্রতিশোধে ফিরিয়ে দিতে পারবেন সেটা বোধহয় প্রসাদ নিজেও ভাবতে পারেন নি। পরের বলটাও সজোরে মারলেন আমির। কিন্তু এ যাত্রায় বল তাঁর ব্যাটফাঁকি দিয়ে সোজা অফস্ট্যাম্পে। উল্লসিত প্রসাদ চিৎকার করে আমিরকে কি বলেছিলেন সেটা বোধহয় নিজ বুদ্ধিতে অনুমান করে নেয়াই শ্রেয়!
যা হোক, এরপর পাকিস্তানের আর কেউই সেভাবে দাঁড়াতে পারেন নি। মাঝে সেলিম মালিক কিছুটা প্রতিরোধ গড়েছিলেন। ক্যারিয়ারের শেষ একদিনের আন্তর্জাতিকে জাভেদ মিয়াঁদাদ শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৩৮ রানে। ধীরগতির বোলিংয়ের দায়ে এক ওভার কম ব্যাট করার সুযোগ পায় পাকিস্তান। সেটা না হলেও যে ম্যাচের ফল খুব একটা উল্টেপাল্টে যেতো তা অবশ্য নয়। নির্ধারিত ৪৯ ওভার শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ ছিল ৯ উইকেটে ২৪৮। তিনটি করে উইকেট দখলে নেন প্রসাদ ও কুম্বলে। ৯৩ রানের অনবদ্য ইনিংসটির জন্য ম্যাচসেরা হন সিধু।
খেলার পরবর্তী দর্শক প্রতিক্রিয়াটা একটু মাত্রাতিরিক্তই ছিল বৈকি! ভারতের অলিতেগলিতে আনন্দ মিছিলের বিপরীতে পাকিস্তানে এক যুবক রাগেক্ষোভে প্রথমে তাঁর টিভি পর্দায় গুলি করে নিজের গায়েও গুলি চালায়। খেলার আগে আগে চোটের ‘অজুহাতে’ পাকি অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম ম্যাচ থেকে সরে দাঁড়ানোয় বিভিন্ন জায়গায় পোড়ানো হয় তার কুশপুতুল।