বিহবল রাতের পর...
খানিকটা কি অবসন্ন লাগছে আপনার? মনে হচ্ছে জমজমাট একটা থ্রিলারের পর কোথাও যেন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে ? অ্যাভেঞ্জারস এন্ড গেমের তুরীয় তিন ঘণ্টা শেষেও হয়তো আপনার মনে হয়নি এমন। বা গেম অফ থ্রোন্সের সেই রুদ্ধশ্বাস ব্যাটল অব উইন্টারফেলের পরও হয়তো এমন প্রবল শূন্যতা গ্রাস করেনি । ইউরোপিয়ান ফুটবলে অমন অলৌকিক দুই রাতের পর যদি বলা হয়, ফুটবলের চেয়ে বড় রিয়েলিটি শো আর কিছু নেই; আপনি হয়তো দ্বিমত করবেন না।
আপনি হয়তো মনে করেন, লিওনেল মেসির মতো ফুটবলার আর দেখেননি। বা আপনি মনে করতে পারেন, মেসি যত বড় ফুটবলারই হন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো ‘বিগ ম্যাচ’ প্লেয়ার আর আসেননি। সেটা আপনি মনে করতেই পারেন, যৌক্তিক কারণও নিশ্চয় আছে তার। ছয় বছর পর যে ফাইনালে মেসি-রোনালদো নেই, সেটার প্রতি আপনার আগ্রহ কমে যেতেই পারে। তবে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে যা হয়েছে, ফাইনাল না দেখার ঝুঁকি নিশ্চয় আপনি নিতে চাইবেন না। গত ফুটবল বিশ্বকাপেও তো একই দিনে মেসি-রোনালদো বিদায় নিয়েছিলেন। এরপর যদি বিশ্বকাপ আর না-ই দেখেন, পরে আপনার আফসোস হওয়ারই কথা।
শুধু কালকের দুই রাত কেন, এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ মানেই তো মাঝরাতে (বিদেশী পাঠকেরা নিজগুণে সময় বসিয়ে নেবেন) নখ কামড়ানো মুহূর্ত, ঘুমন্ত পড়শীদের কথা চিন্তা করে চিৎকার চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা। শুরুটা হয়েছিল আয়াক্সের বার্নাব্যুকে স্তব্ধ করে দেওয়া থেকে। সেই রাতের রেশ না কাটতেই পরের রাতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফিরিয়ে আনল ২০ বছর আগের বায়ার্নকে হতভম্ব করে দেওয়ার স্মৃতি। ওলে গানার সোলশারের বুটে ক্যাম্প ন্যু দেখেছিল অসম্ভব সম্ভব হয়ে যাওয়া আর ডাগআউটে বসে সেটার পুনরাবৃত্তি দেখলেন রাশফোর্ডদের পায়ে।
ওই দুই রাতের পর যদি ভেবে থাকেন চ্যাম্পিয়নস লিগের পাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী দান করা হয়ে গেছে, তাহলে ভুল ভেবেছেন। এরপরের মঞ্চটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর, চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজার। অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগে পরিবারকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি হ্যাটট্রিক করবেন। তুরিনের সেই রাতের আকাশে ছিল মেঘের ঘনঘটা, আর থেকে থেকে বজ্রের চমক। তবে সব শব্দ ম্লান হয়ে গেছে রোনালদোর নিনাদে, দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক করে কথা রেখেছেন। মনে হচ্ছিল, জুভেন্টাসকে শূন্য হাতে অনেকবার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রায়শ্চিত্তটা এবার বোধ হয় বড় কিছু দিয়েই করবেন।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। আয়াক্সের তরুণ তুর্কিরা ঠিক করে রেখেছিল, তারা এবার হবে ‘জায়ান্টস্লেয়ার’। বার্নাব্যুর পর তাদের এবার কুর্নিশ করল তুরিন, রোনালদোর নতুন ইতিহাস আর লেখা হলো না। ওদিকে নয়্যারকে ভূপাতিত করে মানে তখন আলিয়াঞ্জ আরেনা রাঙিয়ে দিয়েছেন রক্তলাল উৎসবে। দ্বিতীয় রাউন্ডের পর এবার কোয়ার্টার ফাইনালের অপেক্ষা। তবে রোমাঞ্চ আর নাটকের তখন অনেক বাকি, সিনেমার তো অর্ধেকও হয়নি।
ম্যান সিটি আর টটেনহামের দ্বিতীয় লেগে যা হলো, অমন শুরু আপনি হয়তো কল্পনাও করেননি। একটু দেরি করে যারা টিভি ছেড়েছেন, তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখলেন ১১ মিনিটের ভেতর ম্যাচের স্কোরলাইন ২-২। খানিক পর সেটা হয়ে গেল ৩-২। পেন্ডুলাম একবার এদিকে দুলছে তো আরেকবার ওদিকে। শেষ হাসিটা যখন সিটি হেসে প্রায় ফেলেছেই, তখন রঙ্গমঞ্চে ভিআর। ইঞ্চির ব্যবধানে সিটির জন্য ম্যাচটা হয়ে গেল ‘এত কাছে তবু এত দূরের’ গল্প। তবে ফুটবল বিধাতা তখনও মুচকি হেসে বলছেন, ‘রোসো, খেলা তো আরও বাকি!’
লিওনেল মেসির কিছু না করলে তো গল্পটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ন্যু ক্যাম্পে যেন ঠিক করলেন, তাঁর জন্য অভিধানে নতুন একটা বিশেষণ যোগ করাতে হবে। যে কোনো ফুটবলারের জন্য স্বপ্নের একটা বাঁক খাওয়ানো ফ্রিকিকে যেন একসাথে হাজির রংধনুর সাত রং, লিভারপুলের জন্য তা যেন শুধুই কালো। প্রথম লেগে ৩-০ গোলে পিছিয়ে লিভারপুল, ইয়ুর্গেন ক্লপ পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন ‘পরের ম্যাচে না পারলেও যেন তাতে হেরে যাওয়ার গ্লানি না থাকে’। সালাহ নেই, অ্যানফিল্ডে ম্যাচ শুরুর আগে দেখা গেল ‘নেভার গিভ আপ’ লেখা জার্সি পরে একরাশ কষ্ট নিয়ে বসে আছেন গ্যালারিতে। ফিরমিনো নেই, নেই কেইটাও। লিভারপুলের সামনে দুর্গম গিরি আর কান্তার মরুর রক্তচক্ষু। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের বিধাতা ভাবছিলেন অন্য কিছু। অ্যানফিল্ডে বাঁশি গড়াতেই অলৌকিকের গন্ধ, ১১ জন লাল জার্সির সঙ্গে ৫৪ হাজার দর্শক যেন পারলে নেমে যান মাঠে। ‘গড অব দ্য গেমের’ মেসিও যেন সেই লোহিতসাগরে পথহারা নাবিক, কল্পনাকে হার মানানো এক ফেরায় লিভারপুল জিতল ৪-০ গোলে।
ততক্ষণে হয়তো আপনি বলে ফেলেছেন, ‘নাহ, এর চেয়ে জম্পেশ চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল আর হতেই পারে না।’ এর চেয়ে ভালোভাবে ফিরে আসা সম্ভব নয়, সেটাও লিখে ফেলেছেন ফেসবুকে। টটেনহাম যখন পরের দিন প্রথমার্ধ শেষে ২-০ গোলে পিছিয়ে, এরপরও তা ভাবেননি। আয়াক্সের ফ্রাঙ্কি ডি ইয়ং, ডি লিটদের খেলাটা কল্পলোক থেকে মুচকি হাসিতে দেখছেন ক্রুইফ, আমস্টারডাম কেবল উৎসবের অপেক্ষায়। কিন্তু লুকাস মৌরার মনে ছিল অন্য কিছু।
২-০ গোলে পিছিয়ে থাকা দলটি দ্বিতীয়ার্ধে তাই জেগে উঠল ফিনিক্স পাখির মতো। দুই গোলই শোধ করে দিল আমস্টারডামকে স্তব্ধ করে, তারপরও মনে হচ্ছিল রূপকথাটা আর হলো না। কিন্তু রেফারির বাঁশি ইথারে ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে মৌরা স্তব্ধ করে দিলেন ঘড়ির কাঁটা। স্তম্ভিত আমস্টারডামে এরপর পচেত্তিনো কাঁদছেন, কাঁদছেন মৌরা, কাঁদছে পুরো টটেনহামই। আর আপনি ভাবছেন, একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ এর চেয়ে আর বেশি কী দিতে পারে?
এখন আপনি বুঝে গেছেন, ফেরার কোনো শেষ নেই। ফুটবলের ভাষা বোঝার আশাও আপনি জলাঞ্জলি দিয়েছেন; এমন কিছু তো গল্পেও হয় না। আপনি যে দলেরই সমর্থক হোন না কেন, এই কদিনে মাঝরাতে অস্ফুট একটা চিৎকার অন্তত না দিয়ে আপনি পারেননি। লিভারপুল-টটেনহামের যেই জিতুক, তার আগে আপনি জিতে গেছেন।
আর আপনার সঙ্গে জিতেছে ফুটবলও, দ্য গ্রেটেস্ট গেম অন আর্থ।