বিদায়, 'রোবারি!'
আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে তখন সূর্য ঝলমল বিকেল। সবুজ টার্ফ, আধ ফাঁকা গ্যালারি- এমন কতোশত বিকেল এই মাঠে কাটানো হয়েছে। সমর্থকেরা এখনও ভীড় জমানো শুরু করেননি। ম্যাচের প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাকি। ডাগআউট থেকে চিরপরিচিত সবুজ গালিচায় একা হাঁটতে বেরোলেন ফ্রাঙ্ক রিবেরি, শেষবারের মত। কিছুক্ষণ বাদেই যোগ দিলেন আরিয়েন রোবেন। এই মাঠে আর খেলা হবে না তাদের। দুই বন্ধু মিলে হেঁটে বেড়ালেন কিছুক্ষণ, স্মৃতি রোমন্থন করে হাসলেন। মাঠ ছাড়ার আগে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন রোবেন, রিবেরি; বায়ার্ন সমর্থকদের প্রিয় ‘রোবারি’। দুজনের চোখেই অশ্রু, এক দশকের বাঁধন ছিন্ন তো করা সহজ না।
৬১ মিনিটে বদলি হয়ে নামলেন। ৭১ মিনিটে বাঁ-প্রান্তে বল পেয়েই ছুটলেন ডিবক্সের দিকে। এগিয়ে আসলেন আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের দুই ডিফেন্ডার। দুর্দান্ত ড্রিবলে দুজনের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। এবার এগিয়ে আসলেন গোলরক্ষক সহ আরও দুজন, কিন্তু আজ কোনও কিছুই যেন তাকে ফেরাতে পারত না। চিপ করে বল পাঠালেন জালে। জয় নিশ্চিত ছিল আগেই, ঐ গোলে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনা মাতল বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে। জার্সি খুলে দৌড় দিলেন তিনি, ছুটে আসলেন সবাই। জার্সি খুলে ফেলায় হলুদ কার্ড দেখাতে এগিয়ে এলেন রেফারি, তার মুখেও হাসি। রেফারিকেও আলিঙ্গন করলেন তিনি। আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে তখন ‘ডাঙ্কে কিং!’ (ধন্যবাদ মহারাজ) চিতকারে কান পাতা দায়।
তবে দিনটা কিন্তু শুধুই রিবেরির নয়, ছিল রোবেনেরও। রিবেরির মতই গত দশকের বায়ার্নের হাসি-কান্নার সাক্ষী আরিয়েন রোবেন। বিদায়বেলায়ও কত মিল, রিবেরির মত তিনিও গোল করলেন নামার ১০ মিনিটের মাথায়। ডেভিড আলাবার পাস থেকে এবার জাল খুঁজে পেলেন তিনি। বুন্দেসলিগায় করলেন নিজের ৯৯তম গোল। ‘সেঞ্চুরি’ পূরণের দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল ফ্রাঙ্কফুর্ট গোলরক্ষক কেভিন ট্র্যাপের পা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন রোবেন, এক মুহূর্তের জন্য হয়তো মনে পড়ে গেল ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইকার ক্যাসিয়াসের সেই সেভ, যেটা না হলে হয়তো নামের পাশে ‘বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ ট্যাগটাও থাকত তার।
বায়ার্নে আগে পরে এসেছিলেন রিবেরি-রোবেন, শেষ ম্যাচে গোলটাও পেলেন সে হিসেবেই। বিদায়টা হতে পারত গত মৌসুম শেষেই। দীর্ঘদিনের দুই অতন্দ্র প্রহরীর প্রতি সম্মান জানিয়ে এক বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করেছিল বায়ার্ন। ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন, হাসি-কান্নার একটা বড় অংশ একসাথে দেখেছেন দুজন। শেষটা একসাথে হলেও রোবেন, রিবেরির শুরুটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। ২৫ বছর বয়সী রোবেন প্রথমে নজর কেড়েছিলেন স্বদেশী ক্লাব পিএসভি আইন্দহোভেনের হয়ে। ইউরো '০৪-এ প্রথমবার ফুটবলবিশ্ব প্রমাণ পেয়েছিল তার সামর্থ্যের। পাকা জহুরির মত সোনা চিনতে ভুল করেননি হোসে মরিনহো, নিজের প্রথম মৌসুমেই রোবেনকে নিয়ে আসলেন চেলসিতে।
রোবেন-মরিনহোতে প্রিমিয়ার লিগ দেখল চেলসির উত্থান। টানা ২ মৌসুম প্রিমিয়ার লিগ জিতলেন। ইউরোপে আলো ছড়ানো মানে যেন রিয়াল মাদ্রিদের 'রাডার'-এ চলে আসা, হলও তাই। ২০০৭ সালে স্পেনে পাড়ি জমালেন ডাচ উইঙ্গার। আবারও প্রথম মৌসুমেই জিতলেন লিগশিরোপা। কিন্তু ২০০৯ সালে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের 'গ্যালাক্টিকোস' প্রজেক্টের জন্য বিদায় নিতে হল রিয়ালের ডাচ ত্রয়ী রোবেন-স্নাইডার-হান্টেলারকে। বিদায়টা অপ্রত্যাশিত হলেও এই রিয়ালেই ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরেছিল তার। রিয়ালে তার শেষ মৌসুমে কোচ ছিলেন হুয়ানদে রামোস। রোবেনের গতি, ড্রিবলিং ক্ষমতা দেখে বাঁ-প্রান্ত থেকে তাকে সরিয়ে আনলেন ডানপ্রান্তে। ছোট্ট একটা পরিবর্তন, কিন্তু তাতেই নিজেকে কিংবদন্তী বানিয়ে ফেললেন রোবেন। ডানপ্রান্তে থেকে ভেতরে ঢুকে বাঁপায়ের জোরাল শটে কত যে গোল করেছেন, সে হিসেব হয়তো নেই রোবেনের নিজেরও। বায়ার্নে কাটানো ১০ বছর এই বাঁকানো শটে গোল করাকে বানিয়ে ফেলেছিলেন নিজের 'ট্রেডমার্ক'।
রোবেনের জন্য বায়ার্নে যোগ দেওয়াটা সময়োপযোগী ছিল না তেমন। লিগে বায়ার্নের দোর্দণ্ড প্রতাপ অনেক আগে থেকেই, কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে সেসময় বায়ার্ন ফেভারিট ছিল না। রোবেনের জন্য না হলেও ২০০৭ সালে রিবেরির বায়ার্নে যোগ দেওয়াটা ছিল তার ক্যারিয়ারের সেরা সিদ্ধান্ত। যোগ দেওয়ার পরই বলেছিলেন, 'বায়ার্নের প্রস্তাব পেয়ে আর দ্বিতীয় কিছু চিন্তা করিনি।' গালাতাসারায় হয়ে মার্শেইয়ে জাত চিনিয়েছিলেন। বিশাল এক চমক হয়ে ডাক পেয়েছিলেন ফ্রান্সের '০৬ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে, পেনাল্টিতে হেরে একটুর জন্য জেতা হয়নি বিশ্বকাপ। জার্মানি বিশ্বকাপের সেরা তরুণের শর্টলিস্টেও ছিলেন তিনি। এরপর ২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রিবেরিকে দলে নিয়ে সাড়া ফেলে দিল বায়ার্ন। মাত্র ২৩ বছর বয়সী এক ফরোয়ার্ডের জন্য নিজেদের ট্রান্সফার রেকর্ড ভেঙ্গে দিল জার্মান জায়ান্টরা। কিন্তু সাহসী সেই সিদ্ধান্তে যে ভুল করেনি বায়ার্ন, সেটা প্রমাণ করেছেন রিবেরি নিজেই।
জার্মানিতে প্রথম মৌসুমেই জিতেছেন 'ডাবল', হয়েছিলেন জার্মান লিগের বর্ষসেরা ফুটবলারও। রোবেন যতদিনে খ্যাতি নিয়ে বায়ার্নে এসেছেন, রিবেরি অবশ্য তার আগেই বায়ার্নে প্রতিষ্ঠিত। ২৫ আগস্ট, ২০০৯। প্রথমবারের মত মাঠে একসাথে রিবেরি এবং রোবেন, এখানেও মিল। দুজনই নামলেন বদলি হয়ে। সময় নিলেন মাত্র মিনিট পাঁচেক, রিবেরির পাস থেকেই বল জালে পাঠিয়ে অভিষেকেই গোল করলেন রোবেন। বায়ার্নের তখনকার কোচ অটমার হিটজফেল্ড বুঝে গেলেন, দুর্ধর্ষ এক ফরোয়ার্ড লাইন পেয়েছেন তিনি। হিটজফেল্ড গেলেন, আসলেন ইয়ুপ হেইঙ্কেস, কার্লো আনচেলত্তি, পেপ গার্দিওলা। রোবেন, রিবেরি থেকে গেলেন ‘ধ্রুবক’। বায়ার্নকে আনন্দে ভাসিয়েছেন অনেকবার, কিন্তু হতাশা, দুঃখ-কষ্টের সময়ও ছিলেন একসাথেই।
জার্মান লিগ, কাপ জিতলেও চ্যাম্পিয়নস লিগে এসে বারবার ফিরতে হচ্ছিল খালি হাতে। রিয়াল ছাড়ার বছরখানেক পরই সেই বার্নাব্যুতেই বায়ার্নের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে এসেছিলেন রোবেন, কিন্তু হার মেনেছিলেন সাবেক রিয়াল সতীর্থ স্নাইডারের ইন্টার মিলানের কাছে। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে বায়ার্নের সবচেয়ে হতাশার মৌসুম খুব সম্ভবত ২০১১-১২। সেমিফাইনালে রিয়ালকে পেনাল্টিতে বিদায় করে ফাইনালে আসল হেইঙ্কেসের বায়ার্ন। সেমিতে দুই লেগে গোল করেছিলেন রোবেন, রিবেরি। ফাইনাল নিজেদের মাঠ আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে, প্রতিপক্ষ চেলসি; মাস ছয়েক আগে যারা নিয়োগ দিয়েছে নতুন কোচ। রবার্তো ডি মাত্তেওর অধীনে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ফাইনালে চেলসি। লিড নিল বায়ার্নই, কিন্তু শেষদিকে গোল করে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে গেলেন দিদিয়ের দ্রগবা। কিন্তু তখনও বল বায়ার্নের কোর্টেই। অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি পেল বায়ার্ন, এগিয়ে আসলেন রোবেন। নিজ সমর্থকদের সামনে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা আর রোবেনের মাঝে তখন পার্থক্য একটি শটের।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, রোবেনকে ফিরিয়ে দিলেন চেক। এরপর পেনাল্টিতে হেরে শিরোপা হারাল বায়ার্ন। এতদিনের ভালবাসার রোবেন মুহূর্তেই পরিণত হলেন বায়ার্ন সমর্থকের চক্ষূশূলে। সমস্যা শেষ হয়নি সেখানেই। রিয়ালের বিপক্ষে বন্ধু রিবেরির সাথে ফ্রিকিক নেওয়া নিয়ে বাগবিতণ্ডায় জড়ালেন রোবেন, কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ দুজনের মাঝে। চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা হাতছাড়া হওয়ায় এমনিই ক্লাবের অবস্থা তথৈবচ, হেইঙ্কেস বুঝলেন; বড় বিপদের আগেই সমঝোতা করা দরকার। ডেকে পাঠালেন দুজনকে। বোঝালেন ক্লাবের অবস্থা। দলের সিনিয়র ফুটবলার হিসেবে তাদের দায়িত্ব। ‘কাউন্সিলর’ হেইঙ্কেসে সমস্যা মিটমাট করলেন দুজন। প্রতিজ্ঞা করলেন সমর্থকদের মুখে হাসি ফেরানোর। কথাও রাখলেন ‘রোবারি’।
২০১২-১৩ মৌসুমে আক্ষরিক অর্থেই দুর্ধর্ষ ছিল বায়ার্ন। বুন্দেসলিগা, জার্মান কাপ ঘরে তোলা হয়েছে আগেই। জুভেন্টাস, বার্সেলোনা বাঁধা টপকে আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে বাভারিয়ানরা। এবার প্রতিপক্ষ বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, বায়ার্নকে আটকে দেওয়াটা ইয়ুর্গেন ক্লপের দলের চেয়ে ভাল খুব সম্ভবত পারত না কেউই। লিড নিয়েছিল বায়ার্নই, রোবেনের পাসে মানজুকিচের গোল। দ্বিতীয়ার্ধে সমতায়ও ফিরেছিল ডর্টমুন্ড। কিন্তু রাতটা যে বায়ার্নেরই। ৮৯ মিনিটের খেলা চলছে, লম্বা পাস নিয়ন্ত্রণে আনলেন রিবেরি। চমৎকার ব্যাকহিলে পাস বাড়ালেন রোবেনকে। ছুটে এলেন নেভেন সুবোতিচ, কিছুক্ষণ আগে যার কারণে গোল পাওয়া হয়নি বায়ার্নের। কিন্তু এবার আর কোনোকিছুই ফেরাতে পারত না রোবেনকে। প্রথম টাচেই হামেলস-সুবোতিচকে ছিটকে ফেলে ঢুকে পড়লেন ডিবক্সে। হয়ত গত বছরের ফাইনালের কথাই ভাবছিলেন। এগিয়ে আসা গোলরক্ষক রোমান ওয়াইডেলফেলারের পায়ের ফাঁক গোলে বল জালে পাঠালেন তিনি।
এক মুহূর্তের নীরবতা, এরপরই চিৎকারে ফেটে পড়ল ওয়েম্বলি। দু’হাত প্রসারিত করে কর্নারের দিকে ছুটে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন রোবেন, সবার আগে তাকে জড়িয়ে ধরলেন রিবেরিই। ইংল্যান্ডে খেলার সুবাদে ইংরেজিটা ভালোই রপ্ত করেছিলেন রোবেন, রিবেরিকে জড়িয়ে বারবার বলতে লাগলেন,’ উই ডিড ইট’। এক বছর আগে একজন আরেকজনের ছায়াও মাড়াতেন না একটা সময়, সেই তারাই এখন প্রথমবারের মত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন, প্রথমবারের মত জিতলেন ট্রেবল। ২৯ আগস্ট, ২০০৯ থেকে একটা স্বপ্নই দেখতেন দুজন, ইউরোপসেরা হওয়ার। অনেক হতাশা, কান্নার পর সেই ‘রোবারি’র হাত ধরেই প্রায় এক যুগ পর চ্যাম্পিয়নস লিগ ঘরে তুলল বায়ার্ন। সে বছর ব্যালন ডি’অরের শীর্ষ তিন-এ ছিলেন রিবেরি, জিতেছিলেন ইউয়েফার বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাবও।
বয়সটা ততদিনে ত্রিশের কোঠায় পৌঁছে গেছে দুজনেরই। ইনজুরির কারণে টানা খেলে যাওয়া সম্ভব হয়নি দুজনের কারোই। ডগলাস কস্তা, কিংসলে কোমানরা ততদিনে আক্রমণের ‘ব্যাটন’টা নিজেদের করে নিতে চলেছিলেন। কিন্তু দুজনের কাউকেই বিক্রি করার কথা চিন্তা করেনি বায়ার্ন, ক্লাব ছাড়ার কথাও ভাবেননি রোবেন, রিবেরি কেউই। কিন্তু দলের প্রয়োজনে বেশ কয়েকবারই জ্বলে উঠেছিলেন তারা। প্রস্তাব ছিল অনেক দল থেকেই। রিবেরিকে দলে নিতে চেয়েছিল পিএসজি, কিন্তু ক্যারিয়ারের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানো বায়ার্নকে ছাড়তে চাননি তিনি।
২০১০-এ যৌন কেলেঙ্কারিতে পড়ার পরও তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল বায়ার্ন। গত বছর সাংবাদিকদের সাথেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন রিবেরি, কিন্তু তখনও তার পাশেই ছিলেন বায়ার্নের সমর্থকেরা। বিদায়বেলায় সেজন্যই আবেগটা বেশি ছিল রিবেরির। রোবেন, রাফিনহারা যেখানে হাসিমুখে বিদায় নিচ্ছিলেন, রিবেরি চোখজুড়ে ছিল অশ্রু। কোমানকে জড়িয়ে কথা বললেন কিছুক্ষণ, হয়তো উত্তরসূরিকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন ক্লাবের দায়িত্ব। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিলেন ডেভিড আলাবাকেও, বাঁ-প্রান্তে একসাথে দুজন মিলেন কত গোল করেছেন, করিয়েছেন- হিসেব নেই।
ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি প্রাপ্তি, হতাশা সবই এই বায়ার্নেই। আবেগের দিক দিয়ে বায়ার্ন রোবেন-রিবেরির কাছে অবশ্যই অমূল্য। রিয়াল ছাড়তে রীতিমত বাধ্যই করা হয়েছিল রোবেনকে, ইনজুরি প্রবণতার কারণে কথা শুনতে হয়েছিল চেলসিতেও। কিন্তু বায়ার্নে কখনোই এতটুকু ‘পর’ অনুভব করেননি, জানিয়েছেন নিজেই। রিবেরির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও আবেগী। মাথা গরম করা, গড়নে খর্বকায় হওয়ার কারণে গালাতাসারায় ছাড়তে হয়েছিলেন তাকে। কিন্তু বায়ার্ন সমর্থকেরা তাকে আপন করে নিয়েছিলেন সেই ২০০৭ থেকেই। আজ বিদায় বললেও ভালবাসাটা থাকবে অবিরাম, চিরকাল- জানেন রিবেরি নিজেও। অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় সূর্য একপাশে হেলে পড়েছে। খেলা শেষ বহু আগে, কিন্তু মাঠ ছাড়েনি কেউ। মৌসুমের শেষ ম্যাচ, আর লিগ জয়ের উদযাপন- উৎসব লেগেছে বাভারিয়ানদের। এর মধ্যে আরিয়েন রোবেন, ফ্রাঙ্ক রিবেরি- বায়ার্ন সমর্থকদের আদুরে জুটি 'রোবারি' আলিয়াঞ্জ অ্যারেনা থেকে বিদায় নিলেন শেষবারের মত। আবেগ, ভালবাসা, কান্না- বিদায়বেলায় ঠিকরে পড়ল পুরোটাই।
বুন্দেসলিগা, আলিয়াঞ্জ অ্যারেনা থেকে বিদায় নেওয়া হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাকি ছিল কেবল বায়ার্নের জার্সিতে শেষ বিদায়, শনিবার রাতে হয়ে গেল সেটাও। আরবি লাইপজিগের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে ৪ বছর পর জার্মান কাপ ঘরে তুলল বায়ার্ন, জিতল 'ডাবল'। রিবেরি-রোবেন ছিলেন বেঞ্চেই, দুজন নামলেন বদলি হয়ে। শেষবারের মত 'রোবারি' জুটির নৈপুণ্য আরেকটু হলেই দেখতে পেত ফুটবলবিশ্ব। রিবেরির পাসে লাইপজিগ গোলরক্ষক গুলাশিকে একা পেয়ে গিয়েছিলেন রোবেন, কিন্তু শট না নিয়ে লেভানডফস্কিকে বাড়ালেন পাস। গোল করতে পারলেন না পোলিশ স্ট্রাইকার, হয়তো কিছুটা হতভম্বই হয়ে পড়েছিলেন। 'স্বার্থপর' হওয়ার জন্য কম সমালোচনা হইতে হয়নি রোবেনকে, সেই রোবেন কিনা গোলরক্ষককে একা পেয়েও বাড়ালেন পাস! তাতে অবশ্য ফলাফলে প্রভাব পড়েনি। শেষ দুই ম্যাচে দুই শিরোপা উৎসবে মেতেই বিদায় নিল 'রোবারি'।
'পার্ট অফ দ্য জার্নি ইজ দ্য এন্ড’ (বিদায় প্রত্যেক যাত্রারই একটি অংশ')। হালের সেনসেশন মার্ভেলের অ্যাভেঞ্জার্স এন্ডগেমে আয়রন ম্যান টনি স্টার্কের উক্তিটি চলে গেছে প্রায় কিংবদন্তী পর্যায়ে। জন্মিলে মরিতে হইবে, তেমনি যাত্রা যত বড়ই হোক, যতটা ভালবাসারই হোক; শুরু করলে বিদায়ও নিতে হবে একটা সময়। একজনের যাত্রাটা এক দশকের, আরেকজন এক যুগের। কিন্তু বায়ার্ন মিউনিখের ইতিহাসে তাদের নামটা লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরেই, উচ্চারিতও হয়তো হবে একই সাথে।
আলিয়াঞ্জ অ্যারেনা থেকে অলিম্পিকস্তাদিওন। বায়ার্নের সাথে প্রায় ১০ বছরের পথচলার ইতি টানলেন রোবেন-রিবেরি। বিদায়বেলায় আনন্দটাই ছিল বেশি। কিন্তু শিরোপা উদযাপনের মাঝেও যে একটা চাপা বিষাদ বিরাজ করছিল, সবার মাঝে; তা রিবেরিকে জড়িয়ে ধরে কোমানের কান্না বা মুলারের আড়ালে চোখ মোছাই জানান দেয়। সতীর্থ তো বটেই, তরুণদের অনেকের কাছেই তারা ছিলেন 'রোল মডেল' বা 'গার্জিয়ান'। এমন মহীরূহের বিদায়ে অশ্রু ঝড়বে না, তা কী করে হয়!