আর্সেনাল-চেলসি ফাইনালের আগে...
রাতে ইউরোপা লিগের ফাইনালে আজারবাইজানের মাঠ বাকুতে খেলতে নামছে চেলসি ও আর্সেনাল। ইতিহাসের প্রথমবারের মতো ইউরোপা লিগের ফাইনালে খেলছে একই দেশের দুইদল। চ্যাম্পিয়নস লিগে ভিএআর সংযোজন হলেও, এতোদিন ইউরোপা লিগে ছিল না ফুটবলের নতুন এই প্রযুক্তি। ফাইনালে প্রথমবারের মতো থাকছে ভিএআরও।
শঙ্কা দূর করতে পারবে বাকু?
এবারের ইউরোপা লিগের ফাইনালের আগে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ইউয়েফার নেওয়া এই সিদ্ধান্তটি। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ফাইনাল ঠিক হয়ে ছিল অবশ্য মৌসুম শুরুর আগেই। কিন্তু কাসপিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত দেশটির রাজনৈতিক দুরবস্থা অনেকগুলো সংশয়ের মাঝে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ফাইনাল ম্যাচটিকে। তাই ফাইনাল ছাপিয়েও বড় হয়ে উঠেছে ফাইনালের ভেন্যু।
ইউয়েফার নীতি মেনে পুরো ইউরোপে খেলা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই বাকুতে ফাইনাল ম্যাচ রাখা হয়েছে এবার। ২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়শিপের জন্য বানানো বাকু অলিম্পিক স্টেডিয়ামে হবে ম্যাচ। গত কয়েক বছর ধরে আজারবাইজান শিরোনাম হয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে। সে কারণে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে আজারবাইজানের। বাকুর অলম্পিক স্টেডিয়ামের ঝা চকচকে আড়ম্বরের পেছনে আছে সেখানে আগে বাস করা প্রায় আড়াইশ পরিবারের দুঃসহ স্মৃতিও। স্টেডিয়াম ও অলিম্পিক ভিলেজ তৈরির সময় সেখান থেকে বিতাড়িত করা পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়নি তেমন ক্ষতিপূরণও। আর ধর্মীয় থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অ্যাটকিভিস্টদের বন্দী করে সরকারের নিপীড়ন দমন নীতিও বরাবরই সমালোচিত হয়েছে ইউরোপে।
আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার ঐতিহাসিক আর রাজনৈতিক কলহের জের ধরে এই ম্যাচটাই খেলা হচ্ছে না আর্সেনাল মিডফিল্ডার হেনরিখ মিখিতারিনের। দর্শকদেরও পোহাতে হচ্ছে নানান সমস্যা। ৬৮,০০০ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্টেডিয়ামে দুই দলের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১২,০০০ টিকেট। টিকেট সোনার হরিণ, কিন্তু সেটা পেয়েও অনেক সমর্থককে খেলা দেখতে হচ্ছে ঘরে বসে টিভিতে। ম্যাচের জন্য ভিসা পাননি ব্রিটিশ-আর্মেনিয়ানরা। আর্সেনাল ও চেলসিও বরাদ্দকৃত টিকেটের প্রায় অর্ধেকটাই ফেরত দিয়ে দিয়েছে ইউয়েফাকে। আজারবাইজানের দুরত্ব ও নিরাপত্তার শঙ্কার তো আছেই। সঙ্গে হোটেল ও যাতায়াতের চড়ামূল্যের কারনে টিকেট ফেরত দিতে হয়েছে স্পন্সরদেরও। এতো সব কিছুর ভিড়ে শেষ পর্যন্ত ফুটবল ম্যাচটা জমবে তো?
মিখিতারিয়ান নেই, কিন্তু কেন?
দুই বছর আগে ইউরোপা লিগের ফাইনালে গোল করেছিলেন হেনরিখ মিখিতারিয়ান। সেই ম্যাচ জিতেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, মিখিতারিয়ানও জিতেছিলেন শিরোপা। কিন্তু এবারের ফাইনালে তাকেও ম্যাচটা দেখতে হচ্ছে ঘরে বসে। আজারবাইজান অবশ্য তাকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু তাতে ভরসা করতে পারেননি মিখিতারিয়ান। আর্মেনিয়ান ফুটবলার এর আগেও ইউরোপা লিগের গ্রুপপর্বের একটি ম্যাচে আজারবাইজানে খেলতে যাননি। সেসময় অবশ্য তাকে যেতেই দেওয়া হয়নি। আর্সেনালও মিখিতারয়ানকে রেখেই বাকু যাত্রার পক্ষে ছিল। এই মৌসুমে আর্সেনালের মিডফিল্ডে ইউরোপা লিগে বাকি সবার চেয়ে বেশি মিনিট খেলেও তাই ফাইনাল ম্যাচে দর্শক মিখিতারিয়ান। ইনজুরিতে পড়া অ্যারন রামসে, ড্যানি ওয়েলবেকরা সফরসঙ্গী হচ্ছেন, জিতে গেলে শিরোপা উৎসবেও থাকবেন তারা, কিন্তু সেখানে থাকা হচ্ছে না মিখিতারিয়ানের, তিনি আর্মেনিয়ান বলে।
এমেরি নাকি সারি, শিরোপা জেতা দরকার কার বেশি?
কারাবাও কাপের ফাইনাল, প্রিমিয়ার লিগে তৃতীয় স্থান, ইউরোপা লিগের ফাইনাল- মৌসুমের শুরুতে মাউরিসিও সারির চেলসির ওপর এতোখানি প্রত্যাশা হয়ত রাখেননি কেউ। কিন্তু এরপরও মৌসুম শেষে চেলসির অতৃপ্তিটাই বেশি। ‘সারিবল’ নামে যে নতুন টোটকা নিয়ে ইংল্যান্ডে হাজির হয়েছিলেন তিনি- সেটা প্রথম মৌসুমে সফলতা দেখেনি।
হাই পেস ফুটবল, কম্বাইনি প্রেসিং, কুইস পাসিং সারির মূল দর্শন। কিন্তু চেলসির এই অ্যাপ্রোচ ধোপে টেকেনি বড় দলগুলোর বিপক্ষে। মৌসুম শেষে তাই চেলসির সমর্থকদের হতাশাই বেশি। তরুণ খেলোয়াড় হজসন ওদয় ও রুবেন লফটাস চিকদের সময়মতো ব্যবহার না করা, হোল্ডিং মিডফিল্ড থেকে এনগোলো কান্তেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় খেলানো, গোলের সামনে স্ট্রাইকারদের হাপিত্যেশ- এই সবকিছু কেবল হতাশাই ছড়িয়েছে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে। আর সারির সঙ্গে খেলোয়াড়দের মনোমালিন্য, দলের সারির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকাটা ভালভাবেই টের পাওয়া গেছে। কারাবাও কাপের ফাইনালে কেপা কাহিনি তো আছেই। ইউরোপা ফাইনালে ম্যাচের আগেরদিনও খেলোয়াড়দের ওপর রেগে মেগে ট্রেনিং ছেড়ে আগে বেরিয়ে গেছেন সারি। অনুশীলনের সময় গঞ্জালো হিগুয়াইন ও ডেভিড লুইস, দুই সতীর্থের মধ্যে লেগে গিয়েছিল বাকুর মাঠে। সেই রাগ সারি ঝেড়েছেন মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে। ফাইনালের আগের দিন ট্রেনিংয়ের শেষ ২০ মিনিট তাই এলোমেলো শট করে সময় পার করে দিয়েছেন চেলসির খেলোয়াড়েরা।
ফাইনালের আগে সারি বলেছিলেন, চ্যাম্পিয়নস লিগে বাছাই করে ফেলায় তার দলের ফাইনাল জেতায় আগ্রহ কম থাকতে পারে। সারির কথাই সত্যি হচ্ছে না তো? পুরো মৌসুম জুড়েই সারির ছাটাইয়ের গুঞ্জন ভেসেছে। শেষে গিয়ে গুজব রটেছে ইতালিতে ফিরছেন সারি, জুভেন্টাসের ম্যানেজার হয়ে। ফাইনালটা যদি চেলসিতে সারির শেষ ম্যাচই হয় তাহলে সেটা জিততেই চাইবেন তিনি। ১২ মাসে চেলসি সমর্থকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকার এই একটাই উপায় আছে তার!
ক্যারিয়ারে কখনই বড় শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি সারির। কিন্তু ফাইনালে তার প্রতিপক্ষ যিনি, সেই উনাই এমেরি এই ইউরোপা লিগের ইতিহাসেরই সফলতম ম্যানেজার। সেভিয়াকে নিয়ে টানা তিনবার ইউরোপা লিগ জিতছিলেন তিনি। এরপর এবারই প্রথম আবার খেলছেন ইউরোপা লিগ। টানা চতুর্থ শিরোপার হাতছানি তাই এমেরির সামনে। এই টুর্নামেন্টে তিনি কেমন, সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন আগের রাউন্ডগুলোতে। লিগে আর্সেনাল যেমন তেমন, ইউরোপা লিগে এবার দুর্দান্ত তারা। কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে নাপোলি ও ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে সবগুলো ম্যাচই জিতেছে আর্সেনাল। অতীত সাফল্যের কারণেই তাই কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে এমেরির দল। ১৯৯৪ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ইউনার্স কাপ জেতার পর ইউরোপে প্রতিবার খালি হাতে ফিরেছে আর্সেনাল। ২০০৬ সালে সবশেষ তারা খেলেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। গানারদের একটি ইউরোপিয়ান শিরোপা এনে দিতে পারলে এমেরি তাই প্রথম মৌসুমেই ঢুকে যাবেন ইতিহাসে। আর পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে তো এর কোনো বিকল্পও খোলা নেই আর্সেনালের সামনে। শিরোপাটা তাই আর্সেনালেরই দরকার বেশি।
উৎসবে নাকি হতাশায় বিদায় বলবেন চেক?
ইউরোপা লিগের ফাইনাল ম্যাচটা এতোখানি আবেগি হবে না আর কারও জন্যই। এই ম্যাচ দিয়েই ফুটবলের ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন আর্সেনাল গোলরক্ষক পিটার চেক। যাদের বিপক্ষে খেলছেন, সেই চেলসিতে তিনি কিংবদন্তী। এখানেই চেক নিজেকে পরিণত করেছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলরক্ষকে। ১১ বছরে চেলসির হয়ে খেলেছেন ৩৩৩ ম্যাচ। চ্যাম্পিয়নস লিগ, প্রিমিয়ার লিগ, ইউরোপা লিগ এফএকাপ- জিতেছেন সবকিছুই। এরপর ২০১৫ সালে নর্থ লন্ডনের ক্লাব আর্সেনালে যোগ দেন চেক। গানারদের হয়ে এটাই তার সবচেয়ে বড় ম্যাচ, শেষ ম্যাচও। বিদায়টা এর চেয়ে আবেগঘন হতে পারত না চেকের জন্য। ফলাফল যাই হোক, দুই দলের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে প্রাপ্য বিদায়টাই পাচ্ছেন চেক গোলরক্ষক।
ফাইনাল জয়ী দল কি পাচ্ছে?
ইউয়েফার সবচেয়ে ভারী শিরোপা! ১৫ কেজি ওজনের আংটাবিহীন একমাত্র ইউয়েফা শিরোপা। শিরোপার মুল্য অবশ্য দুই ক্লাবের জন্য হতে যাচ্ছে দুইরকম। চেলসি চ্যাম্পিয়নস লিগে বাছাই নিশ্চিত করে ফেলেছে লিগেই। কিন্তু আর্সেনালের জন্য এই শিরোপা খুলে দেবে চ্যাম্পিয়নস লিগের দুয়ার। চেলসি বা আর্সেনাল যে দলই শিরোপা জিতুক তাতে প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ চার দলের চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলায় কোনো ব্যঘাত ঘটাচ্ছে না। আর্সেনাল জিতে গেলে ইংল্যান্ডের পঞ্চম দল হিসেবে তারা খেলবে চ্যাম্পিয়নস লিগে।