• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    স্টোকসের 'পারফেক্ট ডে-আউট'

    স্টোকসের 'পারফেক্ট ডে-আউট'    

    জফরা আর্চার বিশ্বকাপ অভিষেকে এর চেয়ে রঙিন কোন দিনই বা আশা করতে পারতেন। ইংলিশ এক পেসার কেমন ভাবলেশহীন এক অ্যাকশনে এসে ১৪০-১৫০ গতিতে বল করে যাচ্ছেন, পেসের বৈচিত্র আর শর্ট বলে নাজেহাল করছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের, আপনার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকতে পারে। তবে মরগান তাকে ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’ বলতে নারাজ। তার মতে, ‘সারপ্রাইজ প্যাক’ হলে শ্রীলঙ্কা স্কোয়াডের সেইসব ক্রিকেটার হবেন, যারা অনেক দিন ওয়ানডে না খেলেও বিশ্বকাপ দলে আছেন। 

    হয়তো মাইকেল ভন এসব কারণেই বলেছিলেন, আর্চারকে বিশ্বকাপ দলে নেওয়া না হলে তিনি গিয়ে নির্বাচকদের বাসায় উপস্থিত হবেন। ভন ইংলিশ ক্রিকেটের ম্যানেজমেন্টের কেউ নন, তবে ইংলিশ ক্রিকেটের রূপকথার কারিগর। আর ওভালের দিনটা আর্চারের স্বপ্নালু বিশ্বকাপ অভিষেকের। 

    দিনটা জস বাটলারের নয়। ব্যাটিংয়ে স্লোয়ার ধরতে না পেরে স্টাম্পে ডেকে আনলেন বল, উইকেটকিপিংয়ে সহজ ক্যাচ ছাড়লেন। জো রুট, অইন মরগান বা জেসন রয় শুরুটা দারুণ করেও মাঝপথেই থেমেছেন। মইনের ব্যাটিংয়ে দিনটা সুবিধার যায়নি, বোলিংয়ে শুরুটা হয়েছে বাজে। পরে কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছেন। লিয়াম প্লাঙ্কেট করেছেন তার মাঝের ওভারগুলির কাজটা, কুইন্টন ডি ককের উইকেটটা ম্যাচের টার্নিং পয়েন্টগুলির একটি। 


    মালগাড়ির মতও ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন-আপে পাঁচ নম্বর বগিটা ছিল স্টোকসের/আইসিসি


    আর তারপর, বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রিউ স্টোকস। দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ দুই উইকেটের কথা ভুলে যান, পদার্থবিদ্যার কেউ থাকলে বলবেন, ও দুটি তিনি পেয়েছেন তার সেই ফিল্ডিংয়ের মোমেন্টামের কারণেই। রান-আউটের ব্যাপারও অবশ্য আছে। ব্যাটিংয়ে তার ৮৯ রানের ইনিংস হয়তো এদিন ইংল্যান্ডের চার ফিফটির একটি, শেষের একটু ঝড় বাদ দিলে শুরুতে ছিলেন স্থিরই। 

    যে বিশ্বকাপটা ইংল্যান্ডের চার বছরের সাধনার, যে বিশ্বকাপটা ইংল্যান্ডের অনেক আশার, সে বিশ্বকাপের শুরুটা ‘পারফেক্ট’ করতে বোধহয় প্রয়োজন ছিল স্টোকসের মতো এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্সেরই। আর্চারের মতো গতিতারকা হয়তো হরহামেশাই দেখে না ইংল্যান্ড, রয়-মরগান-রুটদের এমন সাবলীল ওয়ানডে ব্যাটিং হয়তো একসময় তাদের কাছে ছিল রূপকথার গল্প, তবে ইংল্যান্ড পেয়েছে এর আগে অলরাউন্ডার। ইয়ান বোথাম, বা অ্যান্ড্রিউ ফ্লিনটফের কথা মনে করলেই তার প্রমাণ মিলবে। 

     

     

    স্টোকসের প্রজাতি তাই ইংল্যান্ডের জন্য নতুন নয়। এই দলেও ইংল্যান্ডের অন্যতম শক্তি তার অলরাউন্ডাররা, ম্যাচশেষে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি। স্টোকসের পারফরম্যান্সটাও নতুন নয়। তবে সব মিলিয়ে স্টোকস আর ইংল্যান্ডের জন্য দিনটা যে এর চেয়ে ভাল হতে পারতো না। 

    এমনিতে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন-আপ প্রায় মালগাড়ির সমান লম্বা, যার সব বগিতেই কিছু না কিছু আছে দেওয়া বা নেওয়ার মতো। স্টোকসের ভাগে পাঁচ নম্বর বগিটা। তার আগের তিনটি বগি বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে ১১১ রান উঠলো, স্টোকস এলেন। 


    জফরা আর্চার, বিশ্বকাপ অভিষেকে এর চেয়ে রঙিন কোন দিনই বা আশা করতে পারতেন/আইসিসি


    মরগানের সঙ্গে ১০৬ রানের জুটি জস বাটলারের জন্য দারুণ ভিতটা করে দিল। বাটলার আসবেন, খেলবেন, ইংল্যান্ডের রান বেড়ে যাবে- ব্যাপারটা নিয়ম হয়ে গেছে প্রায়। বাটলার স্লোয়ারে বোকা বনলেন, পিচের কন্ডিশন বুঝে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলাররা ক্রস সিম আর এই স্লোয়ারের ব্যবহার করেছে অনেক। এরপর মইন, তবে তিনিও করতে পারলেন না তেমন কিছু। 

    দায়িত্বটা নিতে হলো স্টোকসকে। এর আগেই রিভার্স স্কুপে চার মেরে ফিফটি করেছেন, রিভার্স-পুলে ইনফিল্ড ক্লিয়ার করতে গিয়ে ধরা পড়লেন, তখনও ইংল্যান্ড ইনিংসে বাকি এক ওভার। ৩১১ রান, মরগানরা তাদের ব্যাটিংয়ে ‘প্ল্যান এ’-তে থেকে যেতে পারলেন এতদূর। 

    এরপর আর্চার-প্লাঙ্কেটের গল্প পেরিয়ে, একটা রান-আউটের অংশ থেকে স্টোকস হাজির হলেন সেই মুহুর্তে। এরপর যা হলো, সেটা বারবার দেখতে পারেন আপনি। রশিদের বলে ফেহলুকওয়ায়োর সুইপ থেকে শুরু করে সেই ক্যাচটা নেওয়ার পর স্টোকস কিংবা দর্শকদের প্রতিক্রিয়া- সবই! 

    তবে ব্যাপারটা শুধুই হাত বাড়িয়েছেন আর আটকে গেছে, এতোটা কাকতালীয় নয়। ফাফ ডু প্লেসিও বলছেন, তিনি স্টোকসকে দেখেছেন ফিল্ডিংয়ে কঠোর অনুশীলন করতে। “এ ক্যাচটা মোটেও ফ্লুক নয়”, রীতিমতো রায় দিয়েই গেলেন তিনি। 

    আর ভাষা হারিয়ে ফেললেন মরগান, “আমি শুরুতে তার অবস্থানটা ভুল বুঝেছিলাম। সে দৌড়াল। থামলো। আমি ভাবলাম, বোধহয় মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে। এরপরই সেই লাফটা। আসলে এটা কেমন, তা ভাষায় প্রকাশ করার সামর্থ্য নেই আমার।” 

    দিনশেষে ব্যাটসম্যান বা বোলার স্টোকসকে হয়তো ছাপিয়ে গেলেন ফিল্ডার স্টোকস। সব ছাপিয়ে গেল সেই ক্যাচটা। 

    তবে স্টোকসের জন্য এ দিনটা ছিল ‘পারফেক্ট’।