চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল : শ্রমের মূল্য শিরোপায় পাবেন ক্লপ?
২০১৫ সালে যখন লিভারপুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপের প্রথম ম্যাচ ছিল টটেনহাম হটস্পারের বিপক্ষে। চার বছরে সেই লিভারপুল দলটার চেহারা পালটে দিয়েছেন জার্মান কোচ। টানা দ্বিতীয়বারের মতো লিভারপুল উঠেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। এবার ফাইনালের ফেবারিটও লিভারপুল, তাই চাপটা বেশি তাদের ওপরই।
গতবার কিয়েভে গোলরক্ষকের ভুলে শিরোপা স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়েছিল। সেবার অবশ্য ফাইনালে চমকের নাম ছিল লিভারপুল। তাই চ্যাম্পিয়নস লিগের হারটা লিভারপুল সমর্থকদের হৃদয় ভাঙলেও বিশ্বাসের পালে হাওয়া জুগিয়েছিল। এবার আরও বদলে গেছে লিভারপুল। পুরো মৌসুম দুর্দান্ত ম্যানচেস্টার সিটিকে তাড়া করেছে তারা লিগে। শেষ পর্যন্ত ক্লপের দল শিরোপা হারিয়েছে ১ পয়েন্টে। শিরোপা যেদিন হাতছাড়া হয়েছে তার পাঁচদিন আগে অ্যানফিল্ডে ছিল জাদুকরী রাত। বার্সেলোনাকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে আরও একবার ফাইনালে যাওয়ার রাত। তাই তিন সপ্তাহ আগে লিগের শেষ ম্যাচে উলভসকে হারিয়ে শিরোপা জেতা না হলেও, অ্যানফিল্ডে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না। সেটাকে পুঁজি করেই ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানোতে মাউরিসিও পচেত্তিনোর দলের মুখোমুখি হচ্ছে লিভারপুল
কিন্তু তার আগে চাপ বাড়াচ্ছে আগের ক্লপের ফাইনালের রেকর্ড। নিজের অষ্টম ফাইনাল ম্যাচে দল নিয়ে যাচ্ছেন ক্লপ। এখনও একবারও জয়ের দেখা পাননি তিনি। লিভারপুলে পূর্ণ তিন মৌসুমে এটি ক্লপের চতুর্থ ফাইনাল। ফাইনালে বারবার তার দলের ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার গল্পটা আরও দীর্ঘায়িত হলে এবার আসলেই প্রশ্ন উঠে যাবে, সংশয় জাগবে ক্লপের ফাইনাল ম্যাচ জেতার সামর্থ্য নিয়েও।
তবে জিতে গেলে ক্লপ পাবেন তার চার বছরের শ্রমের যোগ্য উপহার। ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ইউরোপেও লিভারপুল যে আবার সোনালী সময় ফিরে পেয়েছে সেটা ক্লপের জন্যই। জার্মান ম্যানেজার তাই এক ম্যাচ জিতেই ঢুকে যেতে পারেন ইতিহাসে। টটেনহামকে ফাইনালে হারিয়ে দিলে চ্যাম্পিয়নস লিগে সবচেয়ে বেশি শিরোপার তালিকায় তৃতীয় স্থানে উঠে যাবে লিভারপুল। ছয় শিরোপা নিয়ে তাদের সামনে থাকবে কেবল এসি মিলান ও রিয়াল মাদ্রিদ।
রোড টু ফাইনাল
নাপোলি, পিএসজির সঙ্গে এক গ্রুপে পড়ে কঠিন লড়াই করে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে হয়েছিল লিভারপুলকে। গ্রুপপর্বে কোনো অ্যাওয়ে ম্যাচেই জয় পায়নি তারা। রেডস্টার বেলগ্রেডও ভুগিয়েছে তাদের। নাপোলির সমান ৯ পয়েন্ট নিয়ে অ্যাওয়ে গোলে এগিয়ে থেকে কোনো মতে গ্রুপ পর্ব পার করেছিল লিভারপুল। এরপর বায়ার্নকে দুই লেগ মিলিয়ে পাত্তা না দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় ক্লপের দল। সেখানে পোর্তো বাধা হতে পারেনি। দুই লেগ মিলিয়ে ৬ গোল করে সেমিফাইনালে ওঠে লিভারপুল। ন্যু ক্যাম্পে প্রথম লেগে ৩-০ গোলে হারের পর ক্লপ নিজেও হার মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু মোহামেদ সালাহ, রবার্তো ফিরমিনো বিহীন লিভারপুল অ্যানফিল্ডে বার্সাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রত্যাবর্তনের গল্প রচনা করে ফেলল। তাতেই ফাইনালে লিভারপুল।
কেন লিভারপুল জিতবে শিরোপা?
গতবার লিভারপুলের সমস্যা ছিল রক্ষণ আর গোলকিপিং। এবার সে সমস্যার সমাধান হয়েছে। এবার যেমন অজুহাতের রাস্তা খোলা নেই লিভারপুলের সামনে, তেমন আত্মবিশ্বাসের কমতিও নেই। ম্যাচ নির্ধারনী হতে পারে মিডফিল্ডের নিয়ন্ত্রণের ওপর। এখানে দুই দল সমানে সমান কাগজে কলমে, তাই দুই উইংব্যাক অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড আর অ্যান্ড্রু রবার্টসন এগিয়ে রাখছেন লিভারপুলকে। দুইজনের ওয়ার্করেট দারুণ, লিভারপুলের আক্রমণের বিরাট একটা অংশ আসে এই দুইজনের কাছ থেকেই। তাদের সঙ্গে আক্রমণে সালাহ,-মানে-ফিরনিমোর জুটিকে ম্যাচে গোলবঞ্চিত রাখা কঠিন কাজ যে কোনো দলের জন্য। আর লিভারপুলের ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা ও টটেনহামের অনভিজ্ঞতাও ব্যবধান গড়ে দিতে পারে ম্যাচে।
কেন শিরোপা হারাবে লিভারপুল?
লিভারপুলের দুই ফুলব্যাককে নিজেদের অর্ধে ব্যস্ত রেখে টটেনহাম খেলা চালিয়ে গেলে তাদের সামনে গোল করার সুযোগ আসবে আরও বেশি। আর রক্ষণেও চাপ কমবে টটেনহামের। এমন স্নায়ুর লড়াইয়ে খেলার নিয়ন্ত্রণ হারালে ভড়কে যেতে পারে লিভারপুল। আরও একবার তাই খালি হাতে ফিরতে হতে পারে তাদের।
এক্স ফ্যাক্টর
রবার্তো ফিরমিনো
সালাহ-মানে-ফিরমিনোর যে জুটির কথা বলা হয় সেখানে ব্রাজিলিয়ানের ভূমিকা বাকিদের চেয়ে একটু আলাদা। বিটউইন দ্যা লাইনে গিয়ে খালি জায়গা এক্সপ্লয়েট করে দুই দিকে বল ডিস্ট্রিবিউশন করেন ফিরমিনো। তাতে সালাহ মানেরা আরেকটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে যান গোলের সামনে। লিভারপুলের এই 'টেক্সটবুক' আক্রমণের চাল এতোটাই দারুণ যে সেটা প্রতিপক্ষের জানা সত্ত্বেও তাদেরকে আটকাতে হিমিশিম খেতে হয়। সমস্যাটা ফিরমিনোর ফিটনেস নিয়ে। তিনি শুরু থেকে একাদশে খেলবেন কী না সেটা নিশ্চিত করতে চাননি ক্লপ। তিনি খেললে একরকম হবে লিভারপুলের অ্যাপ্রোচ, না খেললে আরেকরকম। আবার নামলেও পুরোটা সময় খেলার মতো ফিটনেস থাকবে কী না সেই প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। কিন্তু যাই থাকুক, ম্যাচের কোনো না কোনো সময় মাঠেই থাকবেন ফিরমিনো। লিভারপুলের এক্স ফ্যাক্টরও তিনি।
যাদের ওপর চোখ
সাদিও মানে
টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে গোল করতে পারেন। তাহলে দুই ফাইনালে গোল করা অষ্টম ফুটবলার হয়ে যাবেন মানে। এই মৌসুমে সালাহর মতো মানেও ছিলেন দুর্দান্ত। তবে বেশিরভাগ সময় মানেই টেনেছেন দলকে। টটেনহাম তিন জনের ব্যাকলাইন খেলাক আর চারজনের ব্যাকলাইনে ভরসা রাখুক, মানের গতির সঙ্গে ফিনিশিং যে কোনো ফর্মেশনের বিপক্ষেই ম্যাচ জেতানোর মতো ক্ষমতা রাখে।
ফাবিনহো
লিওনেল মেসিকে প্রায় একাই আটকে রেখেছিলেন অ্যানফিল্ডে। লিভারপুলের মিডফিল্ড দখল নেওয়ার নেতৃত্ব দিতে হবে তাকেই। ফাবিনহো নিজের সেরাটা দিতে পারলে টটেনহামকে খেলতে হবে কাউন্টার অ্যাটাকে।
জের্দান শাকিরি
একাদশে হয়ত থাকবেন না। একাদশে নিয়মিত ছিলেন না পুরো মৌসুমেই। কিন্তু বেঞ্চে থেকে উঠে গিয়ে খেলা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তার। ফাইনালের নায়কও হয়ে যেতে পারেন সুইস ফরোয়ার্ড।