২০২২ বিশ্বকাপ, নতুন আর্জেন্টিনা- মেসির যত কথা
সপ্তাহ দুয়েক পর পর্দা উঠছে ৪৬তম কোপা আমেরিকার। সেই ১৯৯৩ সালে শেষবার লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের শেষ হাসি হেসেছিল আর্জেন্টিনা, গত দুই আসরে ফাইনাল খেললেও হেরেছে দুটিই। শেষ কোপা আমেরিকা ফাইনালের পর অবসরেই চলে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসি, যদিও ফিরে এসেছিলেন বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের আগে। আসন্ন কোপা আমেরিকার প্রস্তুতিতে আপাতত আর্জেন্টিনাতেই অনুশীলন করছেন মেসি। ফক্স স্পোর্টস আর্জেন্টিনাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেসি কথা বলেছেন আর্জেন্টিনা দল নিয়ে, ক্যারিয়ারের আক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও।
আর্জেন্টিনায় মেসির পছন্দের কোচ কে?
আর্জেন্টিনার কোচদের মধ্যে আমি সাবেয়ার অধীনে খেলতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। এটা সত্যি যে তার অধীনে আমাদের শুরুটা তেমন ভাল ছিল না, কিন্তু বাছাইপর্বের শেষদিক থেকে বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলেছি আমরা। অবশ্যই ফাইনাল জিততে না পারার একটা আক্ষেপ এখনও পোড়ায় আমাদের, কিন্তু তার অধীনে সেরা ফুটবলটা খেলেছি জাতীয় দলে। শুধু সাবেয়া নন, তার পুরো কোচিং স্টাফও অসাধারণ ছিল।
ম্যারাডোনার কেমন ছিলেন?
সত্যি বলতে, ডিয়েগোর অধীনে আমরা তেমন ভাল ফুটবল খেলতে পারেনি। তার দর্শনে জেতার অনুপ্রেরণা, আবেগটা থাকলেও দল হিসেবে তার দর্শনে খেলাটা বেশ কষ্টসাধ্যই ছিল আমাদের জন্য। সাবেলার সাথে জাতীয় দলে সময়টা যেরকম উপভোগ করেছি, ডিয়েগোর সাথে এমনটা ছিল না।
বর্তমান আর্জেন্টিনা দল প্রসঙ্গে
দলে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগে ক্লাব পর্যায়ে অনেক ম্যাচ খেলেও জাতীয় দলে ফুটবলাররা সুযোগ পেত না। কিন্তু এখন অনেক তরুণরাই স্কোয়াডে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। দারুণ একটা সময় কাটানোর পর নতুনদের জায়গা করে দিতে হয়- যেটা খুবই স্বাভাবিক। শিরোপা না জিতলেও আমরা তিনটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলেছি, যেটা অবশ্যই একটি অর্জন। এখনকার স্কোয়াডে আমি এক ঝাঁক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণদের দেখতে পাই, যারা দেশের হয়ে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলতে মুখিয়ে আছে।
জাতীয় দলে শিরোপাখরা নিয়ে
অবশ্যই আমি জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা জিতে বিদায় নিতে চাই। অনেকেই চায় না যে আর্জেন্টিনা কোনও শিরোপা জিতুক, কিন্তু নিন্দুকদের কথায় দমে যাওয়া যাবে না। এবারের কোপা আমেরিকায় আগের তিন টুর্নামেন্টের মতই আবারও শিরোপার জন্যই লড়ব আমরা। শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে কী হবে, সেটা সৃষ্টিকর্তাই সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি চাইলেন আমরা শিরোপা জিতব, না চাইলে কখনোই জিতব না।
পরাজয় যেভাবে নেন
আগে ম্যাচ হারলে অনেক বেশি কষ্ট পেতাম। কখনও রুমে তালাবদ্ধ হয়ে থাকতাম কয়েকদিন, ঠিকমত খাওয়া-দাওয়াও করতাম না। কিন্তু থিয়াগো জন্মের পর আমি বুঝতে পারলাম, জীবনে ফুটবলে হার-জিতের চেয়েও পরিবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখন হারলেও আমার দায়বদ্ধতা আছে আমার সন্তান এবং স্ত্রীর প্রতি। ম্যাচ হারলেও সেদিন খাবার টেবিলে পরিবারের সাথে থাকতেই হবে আমার। এখনও হারলে কষ্ট পাই, কিন্তু এখন সেগুলো অন্যভাবে সামাল দেই।
২০১৫ কোপা আমেরিকা হারের পর
চিলির বিপক্ষে পেনাল্টিতে সেই ফাইনাল হারের পর সবাই আমাদের সবদিক দিয়ে আক্রমণ করেছিল। আমরা বড় ম্যাচ জিততে পারি না, দল হিসেবে আমরা ব্যর্থ। এত চেষ্টার পরেও জিততে না পারায় আমরা হতাশ ছিলাম, কিন্তু মানুষের সমালোচনা একটা সময় অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
নিজের খেলা দেখেন কী না
আমি আগেও বলেছি, টেলিভিশনে বা ইউটিউবে নিজের খেলা দেখতে পছন্দ করি না কখনও। ম্যাচে যা হয়েছিল, যেভাবে খেলেছিলাম; ঠিক সেভাবেই আমি নিজের এবং দলের পারফরম্যান্স মনে রাখতে চাই। আমি টিভিতে আরেকবার নিজের খেলা দেখতে পছন্দ করি না। কিন্তু থিয়াগো, মাতেওদের জন্মের পর এখন খেলা দেখতেই হয় আমাকে।
পারিবারিক জীবন
থিয়াগো রীতিমত ফুটবল পাগল। সে প্রত্যেক ম্যাচে মাঠে আসে, খেলা দেখে, বাড়িতেও ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকে। বার্সা বা আর্জেন্টিনা হারলে আমাদের মতই কষ্ট পায় সে। বিশেষ করে এবার লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচ এবং কোপা ডেল রে ফাইনালের পর সে অনেক কান্না করেছিল। মাতেও একেবারেই ছোট, সে খেলা দেখে ঠিকই; কিন্তু থিয়াগোর মত আবেগী নয়। আমরা হারি বা জিতি, তার তাতে তেমন কিছু যায় আসে না।
ফুটবলের বাইরে আমি বেশ স্বাভাবিক জীবনযাপন করি। থিয়াগো, মাতেওদের স্কুলে নিয়ে যাই। বাড়িতে খেলাধূলা করি তাদের সাথে। ওদের স্কুলে অনেক বন্ধু আছে, তাদের পরিবারের সাথে আমরা বেশ ঘনিষ্ঠ। প্রায়ই আমরা একসাথে খাওয়াদাওয়া বা ঘুরাফেরা করি। আমরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সবার সাথে যোগাযোগ রাখি।
ছেলেবেলার মেসি যেমন ছিলেন
ছোটবেলা থেকেই আমি পেশাদার ফুটবলার হতে চাইতাম। লা লিগায় বার্সেলোনার হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু আমার হাতেখড়ি হয়েছিল নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে আমাকে আর্জেন্টিনা ছেড়ে বার্সেলোনায় যোগ দিতে হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে আসতে আমার তেমন সমস্যা হয়নি, কারণ বার্সা দারুণভাবে সবকিছু আয়োজন করে রেখেছিল। অবশ্য আমার চেয়ে আমার ভাইদের কষ্ট বেশি হয়েছিল। তাদের আর্জেন্টিনায় রেখে আসতে বেশ কষ্ট হয়েছিল বাবা-মা'র। ১৫ বছর বয়সে বার্সার 'বি' দলে থাকার সময় আমরা সব ছেড়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে আসার চিন্তাও করেছিলাম। তবে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নের কাছে কোনও কিছুই ছিল না, সেজন্যই থেকে যাই।
২০২২ বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলবেন আর্জেন্টিনায়?
অবশ্যই কাতার বিশ্বকাপে খেলতে চাই। আশা করি এই সময়টায় গুরুতর ইনজুরি হবে না আমার, যাতে আমি খেলা এখনকার মতই চালিয়ে যেতে পারি। তবে বিশ্বকাপের এখনও অনেক সময় বাকি, আমি এখনও নিশ্চিত নই খেলা নিয়ে। তবে অবশ্যই আমি সর্বোচ্চ চেষ্টাই করব। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর কী হবে, এ ব্যাপারে কোনও চিন্তা করিনি। ছেলেবেলা থেকেই শুধু ফুটবল নিয়েই থাকতে চেয়েছি। অবসরের পর ফুটবল নিয়ে ব্যস্ততা আর থাকবে না। তখনকার জীবনটা চিন্তা করাই বেশ কঠিন আমার জন্য।
মেসি কথা বলেছেন ক্রিশ্চিয়ান রোনালদোকে নিয়েও, আরও পড়ুন: রোনালদো আমাকে ভালো ফুটবলার হতে সাহায্য করেছে: মেসি
কোচিংয়ে ক্যারিয়ার
সত্যি বলতে, আমি নিজেকে কোচ হিসেবে ভাবতে পারি না। কোচিং করানোর ব্যাপারে কোনও পরিকল্পনা নেই আমার।
আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়া
একদম ছোটবেলায় আমি নিউওয়েলসের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখতাম। আমি আগেও বলেছি, বার্সার হয়ে ক্যারিয়ার শেষে আমি আর্জেন্টিনায় ফিরে যেতে চাই। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হবে কি না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই আমি। অনেক কিছুর উপর নির্ভর করছে আমার সিদ্ধান্ত। থিয়াগো, মাতেও স্পেনেই পড়াশোনা করছে, তাদের বন্ধু-বান্ধবরাও এখানেই। তাদের এই সার্কেল ভাঙ্গতে চাই না। আমি মাঝে মধ্যে ওকে মজা করে বলি যে আমরা আর্জেন্টিনা বা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাব, সে প্রতিবারই জোর প্রতিবাদ করে। ব্যাপারটা অবশ্যই ভাল লাগে। তিন বছর বয়স থেকে তার বন্ধু-বান্ধবরা একসাথে ছিল, এখন তাদের বয়স আট বা নয়। একসাথে থাকায় তাদের বন্ধনটাও দারুণ।
সুয়ারেজ এবং নেইমারের সাথে বন্ধুত্ব
নেইমার অসাধারণ এক মানুষ। সেই ফ্রান্সে চলে গেলেও আমার আর লুইসের সাথে বন্ধুত্বটা এখনও অটুট। আমাদের তিনজনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও আছে, যেখানে আমরা আড্ডা দেই। গ্রুপের নামটা লাতিন আমেরিকান ভাষায়। 'দ্য থ্রি সুদাকাস' বা এরকম কোনও একটা নাম হবে আমাদের গ্রুপটির।