ওভালে যেভাবে স্বপ্নের শুরু বাংলাদেশের...
স্কোর
বাংলাদেশ ৫০ ওভারে ৩৩০/৬ (মুশফিক ৭৮, সাকিব ৭৫, মাহমুদউল্লাহ ৪৬*, সৌম্য ৪২; ফেহলেকায়ো ২/৫২, তাহির ২/৫৭, মরিস ২/৭৩)
দক্ষিণ আফ্রিকা ৫০ ওভারে ৩০৯/৮ (ডু প্লেসি ৬২, মার্করাম ৪৫, ডুমিনি ৪৫; মোস্তাফিজ ৩/৬৭, সাইফ উদ্দিন ২/৫৭)
ফলঃ বাংলাদেশ ২১ রানে জয়ী
লাইভ রিপোর্ট- ওভালে 'ওয়ান্ডারফুল' বাংলাদেশ
অলৌকিকের গন্ধটা কখন পেল ওভালের ২৪ হাজার দর্শক? ডু প্লেসিকে আউট করে মিরাজ যখন শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছিলেন? সাইফ উদ্দিন যখন ফন ডার ডুসেনকে বোল্ড করে দাঁড়িয়ে গেলেন আলিঙ্গনের জন্য? নাকি আরও আগে সাকিব-মুশফিকের ‘চেস্টবাম্প’ যখন ওভালে তুলল আনন্দের হিল্লোল? সেটা যখনই হোক, জয়টা যে পাচ্ছে সেই বার্তা তো শুরু থেকেই দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শুরু, তাও আবার এশিয়ার প্রথম দল হিসেবে জয়। মিশন সেমিফাইনালের শুরু এর চেয়ে স্বপ্নের মতো হতে পারত না। একপেশে, ম্যাড়ম্যাড়ে টুর্নামেন্টটা জাগিয়ে তোলার কাজটা শুরু করল তো বাংলাদেশই!
হুট করে কেউ খেলা দেখলে মনে হতে পারে, বুঝি মিরপুরেই খেলা হচ্ছে। গ্যালারিতে শুধু লাল সবুজ, আর ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাংলাদেশ ৩৩০ রান করার পরেই ওভাল বার্তা পেল, আজ কিছু একটা হতে চলেছে।
বাংলাদেশ যেরকম চেয়েছিল, শুরুটা অবশ্য ঠিক সেরকম হলো না। ফাফ ডু প্লেসি জিতলেন টসে, বোলিং নিলেন চোখ বন্ধ করে। আগের ম্যাচে হয়নি বটে, তবে সকালের কন্ডিশনে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের পেসারদের বিপক্ষে লেলিয়ে ধরার সুযোগ তো হাতছাড়া করা যায় না! তবে যেভাবে চেয়েছিলেন, তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার তা হতে দিলেন না।
বাংলাদেশের পরিকল্পনাই ছিল এটা। তামিম একদিক দিয়ে ধরে খেলবেন, আর সৌম্যর লাইসেন্স ছিল আক্রমণের। এনগিডির পর পর দুই শর্ট বলে দুর্দান্ত দুই পুলে সৌম্য যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের সেই ইনিংস। ভাগ্যও একটু সহায়তা করেছে, একবার এলবিডব্লু থেকে বেঁচে গেছেন, আরেকবার ক্যাচ দিয়েও তা ফাঁক গলে গেছে দুই স্লিপের।
তবে সৌম্য ছিলেন দারুণ ছন্দে। স্ট্রেট ড্রাইভ আর পুলে খুব দ্রুত বাংলাদেশকে ৫০ রানে নিয়ে গেলেন। তামিম অবশ্য ঠিক স্বছন্দে ছিলেন না, কে জানে ব্যথাটা হয়তো ভোগাচ্ছিল। অ্যান্ডাইল ফেহলেকোয়ো বল হাতে নিয়ে প্রথম ওভারেই ফেরালেন তামিমকে। অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন বাংলাদেশ ওপেনার, ফিরলেন ১৬ রানে।
সৌম্য অবশ্য ফিফটির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শর্ট বলটাই হলো কাল। এবারও বোলিং বদলের ফায়দা পেলেন ডু প্লেসি, মরিসের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে সৌম্যের গ্লাভসে লেগে উঠে গেল । ৩০ বলে ৪২ রানের ইনিংসটা শেষ হলো ডি ককের দারুণ একটা ক্যাচে। ৭৫ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারাল বাংলাদেশ।
সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম একসঙ্গে অনেক ঝড় সামাল দিয়েছেন। আজ তাদের স্পেশাল কিছুই করতে হতো। পাল্টা আক্রমণকেই মোক্ষ মানলেন দুজন, ওভারপ্রতি রান রাখলেন ছয়ের ওপর। ঠিক ১৬ ওভারে ১০০ রান এলো বাংলাদেশের, ২৪ ওভারে এলো ১৫০ রান। সাকিব-মুশফিকের ব্যাট তখন কথা বলতে শুরু করেছে, তাহির-মার্করাম-ডুমিনির স্পিনকে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। এর মধ্যে খবর এলো, হ্যামস্ট্রিংয়ের টানে এই ম্যাচে আর বল করতে পারবেন না এনগিডি। ডু প্লেসির কপালে তখন অনেক বড় ভাঁজ। সাকিব-মুশফিক কে আগে ফিফটি পাবেন সেটি নিয়ে ছিল অপেক্ষা। ৫৪ বলে পেলেন সাকিব, খানিক পর ৫২ বলে মুশফিক। দুজন চেস্ট আপে গ্যালারিতে তুলে দিলেন উৎসবের রেণু। কে বলবে ওভাল তখন মিরপুর নয়?
কিন্তু গর্জনও স্তিমিত হয় একসময়। দুজনের জুটিতে পঞ্চমবারের মতো শতরান হয়ে গেছে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রানের জুটিও হয়ে গেছে। কিন্তু ১৪২ রান ওঠার পর হঠাৎ ছন্দপতন। যে তাহিরকে খেলছিলেন স্বচ্ছন্দে, তাঁকে সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেলেন সাকিব। নিয়তির পরিহাস, নিজের জার্সি নাম্বার ৭৫-ই।
ম্যাচের তখন আর ১৪ ওভার ৫ বল বাকি। মিঠুনই এলেন পাঁচে, মার্করামকে চার মেরে শুরুটা ভালোই করলেন। মুশফিককে দর্শক বানিয়ে দ্রুত তুলে ফেললেন ২১ রান। কিন্তু তাহিরের দ্বিতীয় শিকারে আউট হয়ে গেলেন, এবারও বোল্ড। ২৫০ হলো বাংলাদেশের, তখনও ৮ ওভার বাকি। মুশফিকের সামনে টুর্নামেন্টের প্রথম সেঞ্চুরির হাতছানি। কিন্তু মনযোগ হারিয়ে ফেললেন হঠাৎ, ফেলেকায়োর বলটা ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ডিপ পয়েন্টে। ২২ রানের আক্ষেপে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরতে হলো প্যাভিলিয়নে।
হঠাৎ করেই খানিকটা চাপে বাংলাদেশ, সেটাই পরের কয়েক ওভারে গুটিয়ে রাখল মাহমুদউল্লাহ-মোসাদ্দেককে। তবে দুজন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, যেটি এলো শেষ চার ওভারে। মরিসের ওভারে দুই চার মেরে মোসাদ্দেক আবার জাগিয়ে দিলেন ওভালকে। মাহমুদউল্লাহ চুপ করে ছিলেন ততক্ষণ, এক ওভার পর থেকে যোগ দিলেন তিনিও। মরিসকে পর পর দুই বলে চার মারলেন, সেই ওভারেই অবশ্য ফিরে গেলেন মোসাদ্দেক। ২০ বলের ২৬ রানের ইনিংসটা বাংলাদেশকে পার করাল ৩০০।
শেষ ওভারে রাবাদাকে প্রথম বলেই ছয় মারলেন মাহমুদউল্লাহ, মিরাজ এসে প্রথম বলে মারলেন চার। বাংলাদেশ পেল ৩৩০, বিশ্বকাপ তো বটেই, নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসেই যা সর্বোচ্চ রান।
বোলিংয়ে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল আফসোস দিয়ে। মাহমুদউল্লাহ একটুর জন্য রান আউট করতে পারলেন না, এইডেন মার্করাম দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ দিয়েও চার পেয়ে গেলেন। তবে রান আসছিল না, শেষ পর্যন্ত সেই চাপটাই কাল হলো। মিরাজের বলে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন ডি কক, কিন্তু কী করবেন বুঝতে না পেরে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অনেক। মুশফিক শাপমোচন করলেন দারুণ এক থ্রোতে, ভেঙে দিলেন স্টাম্প। ৪৯ রানে প্রথম উইকেট হারাল দক্ষিণ আফ্রিকা।
মার্করাম ও ফাফ ডু প্লেসি এরপর হাল ধরলেন। রানের গতিও বাড়ল, পেসাররা খাবি খাচ্ছিলেন। কিন্তু ভেতরের দিকে ঢোকা দারুণ এক বলে মার্করামকে ফেরালেন সাকিব, ৪৫ রানে। ১০২ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারাল আফ্রিকা।
তবে ডু প্লেসে খেলছিলেন দুর্দান্ত, স্পিন-পেস সবকিছু বিপক্ষেই ছিলেন স্বচ্ছন্দ। ৪৫ বলে পেলেন ফিফটি, লক্ষ্যটা কমিয়ে আনছিলেন একটু একটু করে। কেউই কিছু করতে না পারার পর মিরাজকে আনলেন মাশরাফি। এবার টার্নে বোকা বনলেন ডু প্লেসি, ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড। ৬২ রানে থামলেন, ম্যাচের ভাগ্য কি ঠিক হয়ে গেল ওখানেই?
মিলার ও ফন ডার ডুসেন অবশ্য সেরকম মনে করাচ্ছিলেন না। রান রেট ঠিক রেখেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দুজন। এর মধ্যে সৌম্য একটা হাফ-চান্স ছাড়লেন মিলারের, আরেকবার মাহমুদউল্লাহ ফ্লাইট বুঝতে মিস করলেন। দর্শকদের চুপ করতে অনুরোধ করলেন, চাপটা বোঝা যাচ্ছিল দুই দলের। মোস্তাফিজ এলেন, মিলার ৩৮ রান করে ক্যাচ দিলেন পয়েন্টে।
ফন ডার ডুসেন বুঝতে দিচ্ছিলেন না,আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বছরখানেকের বেশি হয়নি তাঁর। ৩৮ বলে করে ফেললেন ৪১, ম্যাচটা বের করে ফেলার হুমকি দিচ্ছিলেন। সাইফ উদ্দিন ৩ ওভারে ২১ রান দেওয়ার পর ফিরলেন, প্রথম বলেই বোল্ড। সেই ওভারটা মেডেন দিলেন সাইফ, এরপর ফেরালেন ফেহলেকায়োকে।
আর বাকিটা ছিল মোস্তাফিজের জন্য। ডুমিনিই ছিলেন প্রোটিয়াদের একমাত্র ভরসা হয়ে, কিন্তু ৪৫ রানে তাঁর বোল্ডেই শেষ হয়ে গেল সব আশা। রাবাদা-তাহিররা শুধু বাংলাদেশের অপেক্ষাটাই দীর্ঘতর করেছেন।