বাংলাদেশের ধূসর দিনে রং হারাল বিশ্বকাপও
স্কোর
অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে ৩৮১/৫ (ওয়ার্নার ১৬৬, খাওয়াজা ৮৯; সৌম্য ৩/৫৮)
বাংলাদেশ ৫০ ওভারে ৩৩৩/৮ (মুশফিক ১০২*, মাহমুদউল্লাহ ৬৯, তামিম ৬২, সাকিব ৪১; স্টোয়নিস ২/৫৪, স্টারর ২/৫৫, কোল্টার নাইল ২/৫৮)
ফলঃ অস্ট্রেলিয়া ৪৮ রানে জয়ী
ম্যাচ শুরুর আগে মাইকেল ভন টুইট করেছিলেন, বিশ্বকাপের স্বার্থে বাংলাদেশের জয়টা আজ খুব দরকার। ইংল্যান্ড, ভারত, নিউজিল্যান্ড বাদে বাকিরাও তো তাকিয়ে ছিল এই ম্যাচের দিকে। বাংলাদেশের জয়ে সবাই একটা লাইফলাইন পায়। বাংলাদেশ পারল না, বিশ্বকাপের রোমাঞ্চও যেন কিছুটা থিতিয়ে এলো। সেমিফাইনালে উঠতে হলে পরের তিনটি ম্যাচ তো বাংলাদেশের জিততে হবেই, এরপরও আসবে অনেক যদি-কিন্তু।
অথচ বাংলাদেশের আজ আফসোস করার কথা ছিল না। ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তো বটেই, নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্কোরটা নতুন করে লিখল বাংলাদেশ। কিন্তু সবকিছু হয়ে রইল শেষ পর্যন্ত সান্ত্বনাই।
খেলা যা শেষ হওয়ার আসলে প্রথম ইনিংসের পরেই শেষ হয়ে গেছে। ৩৮২ রান করার পর ম্যাচ প্রায় অস্ট্রেলিয়ার পকেটে। বিশ্বকাপে ৩২৯ রানের বেশি তাড়া করে জেতার কীর্তি নেই কারও। তাও আবার সেটা করতে হবে স্টার্ক-কামিন্সের অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। বাংলাদেশের মিশন ইম্পসিবলে ভরসা ছিল একটাই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ওই দুর্দান্ত রান তাড়া।
কিন্তু প্রতিদিন তো সাকিব আল হাসান অমন খেলবেন না। লিটন দাসও পর পর দুই ম্যাচে ওরকম অসাধারণ হয়ে যাবেন না। সবার কাছ থেকেই নিজেদের সামর্থ্য ছাড়িয়ে অন্য কিছুর আশা ছিল। মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহই যা একটু সেটা করতে পারলেন, কিন্তু অন্যদেরও যে করার দরকার ছিল!
সেজন্য নিজেদের দোষও কম নেই। সৌম্য আর তামিমের কাছ থেকে ভালো একটা শুরু দরকার ছিল। ৮ বলে ১০ রান করার তামিম ইকবালের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে সৌম্য হয়ে গেলেন রান আউট, তাও আবার একেবারে হাস্যকরভাবে। সৌম্য তাতে নিজের দায় এড়াতে পারেন না, বিশেষ করে তার কাছ থেকে শুরুটা যখন দরকার ছিল।
সাকিব আজও শুরু পেয়েছিলেন। বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৪০০ রানও হয়ে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্টোয়নিসের একটা স্লোয়ার বুঝতে না পেরে ক্যাচ দিলেন মিড উইকেটে। ৪১ বলে ৪১ রানের ইনিংসটা শেষের সঙ্গে ধাক্কা খেল বাংলাদেশের আশাও।
তামিম ইকবাল অবশ্য শুরুর স্লথগতিটা পুষিয়ে দেবেন বলেই মনে হচ্ছিল। ৬৫ বলে পেয়েছিলেন ফিফটি, তার কাছ থেকে আজ দাবি ছিল বড় কিছুর। কিন্তু স্টার্কের বলে প্লেড অন হওয়ার আগে করলেন ৬২ রান, দলকে রেখে গেলেন আরও অতল খাদে।
জয় আর বাংলাদেশ তখন ক্রমে ক্রমে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। লিটন শুরুটা পেয়েছিলেন, কিন্তু জাম্পার বলে এলবিডব্লু হয়ে গেলেন ১৭ বলে ২০ রান করে। মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ হাল ছেড়ে দিলেন না, শত রানের জুটিও হলো। কিন্তু ভাঙা মাস্তুল নিয়ে কি আর উত্তাল সমুদ্রে জাহাজডুবি ঠেকানো যায়? মাহমুদউল্লাহ ৫০ বলে করলেন ৬৯, মুশফিক পেলেন সেঞ্চুরি, তাও ৯৫ বলে। কিন্তু সবকিছুই শেষ পর্যন্ত হৃদয় খুঁড়ে বেদনাই জাগাল।
কিছু দিনে আসলে কিছুই ঠিকমতো হয় না। বৃষ্টি যখন আসার দরকার হয় , তখন দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। মোস্তাফিজের ইয়র্কার সব হয়ে যায় হাফ ভলি, সাকিব লাইন হারিয়ে এলোমেলো হয়ে যান, রুবেল শুরুটা ভালো করার পর খেই হারিয়ে ফেলেন। ক্যাচ হাত গলে বেরিয়ে যায়, রান আউট মিস হয়ে যায়। বাংলাদেশ আজ ট্রেন্টব্রিজের প্রথম সাড়ে তিন ঘন্টায় এরকমই একটা দিন কাটাল।
এমনিতে ট্রেন্টব্রিজে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ফ্ল্যাট উইকেটগুলোর একটি। ইংল্যান্ড বিশ্বরেকর্ড গড়ে জিতেছিল এখানেই, টসে জিতে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চও তাই ব্যাট নিতে বেশিক্ষণ ভাবলেন না। ওয়ার্নার আর ফিঞ্চ এই বিশ্বকাপে একটি ম্যাচ ছাড়া বাকি সবগুলোতেই অন্তত ৫০ রানের জুটি গড়েছেন। আজকের পিচে দুজন সুযোগটা ছাড়লেন না।
না, একটু ভুল বলা হলো। একটা সুযোগ তো দিয়েছিলেন। মাশরাফির অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা তাড়া করতে গিয়ে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়েছিলেন ওয়ার্নার। সাব্বির বুঝতেই পারেননি, বল তার হাত গলে চলে গেছে। ১০ রানে পাওয়া সেই জীবনের মূল্য ওয়ার্নার এমনভাবে দেবেন কে জানত? পরে শুন্য রান করে আরও দুঃস্বপ্নের করে রেখেছেন দিনটা।
এমন নয়, যে পাওয়ারপ্লে থেকেই ঝড় তুলেছে অস্ট্রেলিয়ায়। বরং এই বিশ্বকাপে তাদের এখন পর্যন্ত যে রেসিপি, এগিয়েছে সেটা মেনেই। প্রথম ১০ ওভারে কোনো ঝুঁকি নেয়নি, রান উঠেছে ৫৩। ওয়ার্নার আরও একবার শুরুতে সতর্ক, স্মিথই বরং ছিলেন বেশি আগ্রাসী। ১৬.৩ ওভারে উঠেছে ১০০। ফিঞ্চ মিরাজকে মারলেন চার-ছয়, আগ্রাসী হয়ে ওঠার হুমকি দিয়েচ্ছিলেন। কাউকে দিয়ে কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সৌম্যকে আনলেন মাশরাফি। শুরুতেই ব্রেকথ্রু, ফিঞ্চ ক্যাচ তুলে দিলেন শর্ট থার্ডম্যানে।
ওয়ার্নার তার আগেই ফিফটি পেয়ে গেছেন ৫৫ বলে। ছন্দটা পেয়ে গিয়েছিলেন, খাওয়াজা একটু অস্বস্তিতে থাকলেও সেটি কাটিয়ে উঠতে খুব একটা সময় নিলেন না। বাংলাদেশের বোলাররা কেউই কিছু করতে পারছিলেন না, এলোমেলো বল করে আরও সুবিধা করে দিচ্ছিলেন। তারপরও ৩০ ওভার শেষে ১ উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া যখন ১৬৮ করল, মাশরাফি অন্তত ৩৪০ এর নিচে আটকে ফেলার একটা ছবি দেখতে পাচ্ছিলেন।
কীসের কী, সেই আশা কিছুক্ষণ পরেই কর্পুর হয়ে উবে গেল। ৩০ ওভারের পর থেকেই এক্সেলেটরে চাপ দিলেন ওয়ার্নার-খাওয়াজা। এর মধ্যে ওয়ার্নারের সেঞ্চুরি হলো ১১০ বলে, নিজের মতো লাফ দিয়ে সেটির উদযাপনও করলেন। ও হ্যাঁ, তার আগে রান আউটের একটা সুযোগ হয়তো হতে পারত, কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে পারেননি সাব্বির।
ওয়ার্নার-খাওয়াজা এরপর দেখিয়েছেন, ঝড় না তুলেও কীভাবে রান বাড়ানো যায়। রুবেল-সাকিবের পর পর দুই ওভারে দুইটি ছয় মারলেন ওয়ার্নার, মোস্তাফিজের এক ওভারে চারটি চার মেরে যোগ দিলেন খাওয়াজাও। মাশরাফিও দুইটি চার খেলেন, রুবেল দ্বিতীয় স্পেলে এসে বেদম পিটুনি খেলেন। এর মধ্যে ওয়ার্নারের ১৫০ হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ইনিংসটা খেলে ফেলবেন। শেষ পর্যন্ত সৌম্য এসেই দিলেন ব্রেকথ্রু, ১৪৭ বলে ১৬৬ রান করে আউট হলেন ওয়ার্নার।
ম্যাক্সওয়েলের জন্য মঞ্চটা সাজানো ছিল, এসেই শুরু করলেন ধুন্দুমার। দেখতে দেখতে ৯ বলে করে ফেললেন ৩২, ওয়ানডের দ্রুততম ফিফটিও হাতছানি দিচ্ছে তাকে। খাওয়াজার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়ে গেলেন, বেঁচে গেল বাংলাদেশ। তখন যে ৪০০ উঁকি দিতে শুরু করেছে! খাওয়াজাও সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলেন না, ৭২ বলে ৮৯ রান করে আউট হয়ে গেলেন। বোলার? সৌম্য! এর আগে ওয়ানডেতে যার ছিল মাত্র এক উইকেট, আজ তিন উইকেট নিয়ে তিনিই সফলতম বোলার। এর মধ্যে বৃষ্টি দেখা দিয়ে গেল একবার, কিছুক্ষণ বন্ধও থাকল ম্যাচ। তবে অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রান পর্যন্ত যাওয়া আটকাল না। বাংলাদেশের জন্য সেটাও হয়ে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরের।