ইংল্যান্ডকে স্তব্ধ করে বিশ্বকাপ জাগিয়ে তুললো শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কা ২৩২/৯, ৫০ ওভার
ইংল্যান্ড ২১২ অল-আউট, ৪৭ ওভার
শ্রীলঙ্কা ২০ রানে জয়ী
র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল? টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট? তাদের বিপক্ষে সম্বল ২৩২ রান, তাও আবার এমন ম্যাচে, যে ম্যাচে পরাজয় মোটামুটি নিশ্চিত করবে বিশ্বকাপ থেকে তাদের বিদায়? এত কম রান তাড়া করতে ২০১৪ সালের পর ব্যর্থ হয়নি তাদের প্রতিপক্ষ। এতকিছু বিপক্ষে, তবে শ্রীলঙ্কা সবকিছুকে দেখালো বুড়ো আঙুল। সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখালেন ‘বুড়ো’ মালিঙ্গা, বুড়ো আঙুল দেখালেন ধনঞ্জয়া ডি সিলভা বা নুয়ান প্রদীপরা। তারা যে রূপকথা বড্ড ভালবাসে! হেডিংলিতে তাদের স্মরণীয় জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেন স্টোকস, তবে তাকে একপাশে রেখেই উদযাপনে মত্ত হল শ্রীলঙ্কা। ইংল্যান্ডকে ২০ রানে হারিয়েছে তারা, করে দিয়েছে স্তব্ধ। তারা নিজেদের আশা বাঁচিয়ে রেখেছে, একটু অদ্ভুত শোনালেও ইংল্যান্ডের সেমিফাইনাল হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত! শেষ তিন ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ যে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড!
হেডিংলির যে উইকেট মনে হচ্ছিল ব্যাটিং-সহায়ক, সেখানেই ব্যাটসম্যানদের জীবন পড়ে গেছে অস্বস্তিতে। ৯ম ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হলেন জফরা আর্চার, তখনও জয় থেকে ৫৫ রান দূরে ইংল্যান্ড। তখনও বাকি দিনের সেরা বোলার মালিঙ্গার এক ওভার। সে ওভারটা নিরাপদে পার করে দিয়ে উন্মত্ত ব্যাটিং শুরু করলেন স্টোকস, উদানাকে পরপর দুই ছয়ের পরের ওভারে প্রদিপকে মারলেন পরপর দুই চার। অনেক্ষণ থেকেই সিঙ্গেল নিচ্ছিলেন না ওভারের মাঝে, এক বল ঠেকাতে দিলেন মার্ক উডকে। প্রদিপ তাকে করলেন ১১ নম্বর ব্যাটসম্যানের জন্য বিভীষিকাময় ডেলিভারি, অফস্টাম্পের বাইরে ‘করিডোর অফ আনসার্টেইনিটি’র বলটা খোঁচা মারলেন উড, উল্লাসে মাতল শ্রীলঙ্কা।
রানতাড়া যতখানি সহজ মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ডের কাছে, মালিঙ্গা শুরুতেই সেটা বানিয়ে ফেলেছেন ততখানি কঠিন। প্রথমেই তার ক্ল্যাসিক ফুললেংথের ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ হয়েছেন জনি বেইরস্টো। জেমস ভিনস নড়বড়ে হয়ে পড়েছিলেন শর্ট এক্সট্রা কাভারে ফিল্ডার দেখে, মালিঙ্গার বলে স্কয়ারড আপ হয়ে খোঁচা দিয়েছেন তিনি। জো রুট ও অইন মরগান এরপর ঠিক পথেই রেখেছিলেন ইংল্যান্ডকে, তবে উদানার লো ফুলটসে বোলারস ব্যাকড্রাইভের পর তার দারুণ রিফ্লেক্স ক্যাচে পরিণত হয়েছেন মরগান।
রুটের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছেন এরপর স্টোকস। ২৮তম ওভারে মেন্ডিসকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে ছয় মেরে বার্তা দিয়েছিলেন স্টোকস, সে ওভারে ছয় মেরেছিলেন আরেকটি। তবে তাকে রেখে ফিরেছেন রুটও, মালিঙ্গার লেগস্টাম্পের বাইরের বলে ফ্লিক করতে গিয়ে সূক্ষ্ণ খোঁচা লেগেছিল রুটের ব্যাটে, শ্রীলঙ্কা সে উইকেট পেয়েছে শেষ মুহুর্তে রিভিউ নিয়ে।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিং গভীরতা উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে ততক্ষণে। ডেঞ্জারম্যান জস বাটলারও ফিরেছেন মালিঙ্গা ক্ল্যাসিকে, বেইরস্টোর মতো করেই তিনি হয়েছেন এলবিডব্লিউ। তবে এবার ভাঙছিল লেগস্টাম্প, বেইরস্টোর মতো ক্লিপ করছিল না, রিভিউ নিয়েও সেটা হারিয়েছেন বাটলার। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ধসটা নেমেছে আরেকটু পর।
ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে প্রথমে ছয়ের পর আবার জোরের ওপর মারতে গিয়ে লং-অফে ধরা পড়েছেন মইন। একই বোলারকে জোরের ওপর কাট করতে গিয়ে কট-বিহাইন্ড ওকস, কট-বিহাইন্ড হয়েছেন রশিদও। আর্চার হিরো সাজতে গিয়েছিলেন, উদানাকে টেনে মারতে গিয়ে তিনিও দিয়েছেন লং-অনে ক্যাচ। এরপর শ্রীলঙ্কা ও জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই স্টোকস। তবে তাকে আউট করার প্রয়োজনই পড়লো না শ্রীলঙ্কার!
এর আগে টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া শ্রীলঙ্কার শুরুটাই হয়েছিল বিভৎস। শুরু থেকেই আঁটসাঁট লাইন বেছে নিয়েছিলেন জফরা আর্চাররা, তারই শিকার দিমুথ করুনারত্নে। তিনি খোঁচা দিয়ে ফিরেছেন আর্চারের প্রথম ওভারেই। এক বলের ব্যবধানে ক্রিস ওকসকে স্ল্যাশ করতে গিয়ে থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়েছেন কুসাল পেরেরা।
এরপর দশ ওভারের মতো চলেছে ফার্নান্ডো-শো। তপ্ত গরমে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছিল তার স্ট্রোক ঝলমল ইনিংস। আর্চারকে কাভার ড্রাইভে চার মেরে শুরু করেছিলেন, তাকেই মেরেছিলেন দুই ছয়। কুসাল মেন্ডিসের সঙ্গে ৫৯ রানের জুটিতে ফার্নান্ডো একাই করেছেন ৪৯ রান। তবে মার্ক উডের শর্ট বলে র্যাম্প বা আপার-কাট ধরনের কিছু করতে গিয়ে থার্ডম্যানে ধরা পড়েছেন তিনি, দারুণ এক ইনিংসের শেষটা হয়েছে বাজেভাবেই।
মেন্ডিসের সঙ্গে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের সংগ্রাম শুরু হয়েছে এরপর। তবে সে সংগ্রামটা আদতে কিসের, ধোঁয়াশা ছিল যেন সেটা নিয়েই। টিকে থাকার লড়াই করেছেন তারা, রানরেটের বারোটা বেজে গেছে তাতে। ৭১ রানের সে জুটি ভেঙেছিলেন আদিল রশিদ। ইংল্যান্ড পেসাররা এ উইকেটেও সময় কাটিয়েছেন দারুণ, শুরুতে এলোমেলো হলেও উইকেটের দেখা পেয়েছেন আদিল রশিদ। শততম ওয়ানডেতে একটা রেকর্ডও করেছেন মইন, ২০১১ বিশ্বকাপে অজন্তা মেন্ডিসের পর এই প্রথম কোনও বোলার ১০ ওভার বোলিং করেও বাউন্ডারি দেননি কোনও। গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে ক্যাচিংয়েও দারুণ ছিল ইংল্যান্ড।
নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন যেন ইংল্যান্ডের প্রধান স্পিনার, সহসাই তিনি এরপর পেয়ে গেছেন পরপর দুই বলে দুই উইকেট। প্রথমটিতে দারুণ অবদান আছে ইংল্যান্ড অধিনায়ক অইন মরগানের, অফস্টাম্পের বাইরে থেকে স্লগ করতে গিয়েছিলেন মেন্ডিস, শর্ট মিডউইকেটে বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে গোলকিপারের মতো করে সেটি ধরেছেন মরগান। পরের বলেই রশিদকে ফিরতি ক্যাচ দিয়েছেন জিভান মেন্ডিস, এ ম্যাচেই যিনি এসেছেন দলে।
ইংল্যান্ডের দারুণ ক্যাচিংয়ের শুরু তখন মাত্র। ম্যাথিউসের সঙ্গে এরপর ৪৭ রানের জুটি ছিল ধনঞ্জয়া ডি সিলভার, তবে সে জুটিটাও থেমেছে সময়ের আগেই। এবার আর্চারের স্লো শর্ট বলে টেনে মারতে গিয়ে মিড-অনে গোলকিপার স্টাইলে আরেকটি ক্যাচের শিকার ডি সিলভা, এবার সেটি নিয়েছেন রুট।
থিসারা পেরেরা আর্চারের সহজ ও তৃতীয় শিকার হয়েছেন, উদানা ও মালিঙ্গাকে এরপর ফিরিয়েছেন উড। ম্যাথিউস ৮৪ বলে পূর্ণ করেছিলেন ফিফটি, শেষ ওভারে গিয়ে মেরেছেন প্রথম ছয়। তবে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কার। অন্তত প্রথম ইনিংস পর মনে হচ্ছিল তেমন।
তবে শ্রীলঙ্কা যে রূপকথা বড্ড ভালবাসে।