• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    সাউদাম্পটনে সাকিব-অতলান্তে ডুবে গেল আফগানিস্তান

    সাউদাম্পটনে সাকিব-অতলান্তে ডুবে গেল আফগানিস্তান    

    বাংলাদেশ ৫০ ওভারে ২৬২/৭ (মুশফিক ৮৩, সাকিব ৫১; মুজিব ৩/৩৯, নাইব ২/৫৬)

    আফগানিস্তান ৪৭ ওভারে ২০০ ( শিনওয়ারি ৪৯, নাইব ৪৭; সাকিব ৫/২৯, মোস্তাফিজ ২/৩২)

    ফলঃ বাংলাদেশ ৬২ রানে জয়ী


    ব্যাটসম্যান সাকিব আল হাসানকে আপনি এর মধ্যেই দেখেছেন বিশ্বকাপে। বোলার সাকিবকে ঠিক দেখা যাচ্ছিল না। আজ দেখল আফগানরা। নিজেরা ডুবে গিয়েছিল আগেই, এবার ডুবে গেল সাকিব-অতলান্তে। ২৬২ রানও তাই পাহাড়প্রমাণ বানিয়ে ফেলল বাংলাদেশ, ৬২ রানেই জিতল হেসেখেলেই। শেষ চারের আশাও বেঁচে রইল ভালোমতোই।

    ব্যাট হাতে মুশফিককে যোগ্য সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেছেন এর মধ্যেই। তবে বল হাতে আজ সাকিবকে বেশি করেই দরকার ছিল বাংলাদেশের। বিশেষ করে প্রথম ১০ ওভার শেষে, দুই আফগান ওপেনার রহমত শাহ ও গুলবদিন নাইব ক্রিজে জাঁকিয়ে বসেছেন। প্রথম ১০ ওভারে উঠে গেছে ৪৮ রান, একাদশতম ওভারে এলেন সাকিব। প্রথম ওভারেই ব্রেকথ্রু, উড়িয়ে মারতে গিয়ে মিড অনে ক্যাচ দিলেন রহমত। ২৪ রানে ফিরলেন, আফগানিস্তান হারাল তাদের বড় একটা ভরসাকে।

    আফগানদের খোলসে ঢুকে যাওয়ার শুরুটা সেখান থেকেই। সাকিব ও মিরাজ মিলে আটকে রাখলেন দুজনকে, ওভার প্রতি প্রায় পাঁচ থেকে কয়েক ওভারের মধ্যে রান রেট নেমে এলো চারের মধ্যে। স্পিনাররা আসার পর প্রথম ছয় ওভারে রান উঠল মাত্র ১২। মোসাদ্দেক পেলেন উইকেট, দারুণ ডেলিভারিটা বুঝতে না পেরে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন হাশমতউল্লাহ শহিদি। ক্রিজে ঢোকার আগেই মুশফিক ভেঙে দিলেন স্টাম্প, শহিদি ফিরলেন ১১ রানে।

    একটা বিরতির পর আবার এলেন সাকিব। এরপর করলেন ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটা ওভার। তাতে আছে দুর্দান্ত পরিকল্পনার ছাপও। নাইব সেট হয়ে গেছেন ক্রিজে, সামনে ফিফটির হাতছানি। আফগান অধিনায়কের জন্য একটা শর্ট এক্সট্রা কাভার রেখেছিলেন মাশরাফি, ঠিক সেখানেই ক্যাচ দিলেন তিনি। ৪৭ রানে ফিরলেন নাইব, পাওয়া হলো না ফিফটি। এক বল পর নবীকে করলেন বাঁহাতি স্পিনারের স্বপ্নের ডেলিভারি, ভেতরের দিকে ঢোকা বলটা ভেঙে দিল নবীর স্টাম্প। ১০৪ রানে ৪ উইকেট নেই আফগানদের। আসগর আফগান হুমকি হয়ে উঠতে পারতেন, সাকিবকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ডিপ মিড উইকেটে। সাকিব পেলেন চার উইকেট, তবে তখনও বাকি ছিল অনেক কিছু।

    ইকরাম আলী খিল আজ নেমে গেলেন আগে। কিন্তু কাজে লাগাতে পারলেন না সুযোগটা। লিটনের দুর্দান্ত এক থ্রোতে রান আউট হওয়ার আগে করতে পারলেন ১১। নজিবুল্লাহ জাদরান নামলেন, এরপর খানিকটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল আফগানিস্তান। দুজনের জুটিতে ৫৬ রান উঠে গেল ৪৫ বলে।

    কিন্তু সাকিব যেন বড়ই ‘বেরসিক’, ম্যাচটা একটু জমেও উঠতে দিলেন না। শেষ স্পেলে অবশ্য একটি ছয় খেয়েছিলেন, কিন্তু দিনটা যে তার! নজিবুল্লাহ ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে স্টাম্পড। বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৫ উইকেট হলো সাকিবের, আর যুবরাজ সিংয়ের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এক ম্যাচে হলো ফিফটি আর ৫ উইকেট।

    ম্যাচের রোমাঞ্চ আসলে সেখানেই শেষ। এরপর রশিদ খানকে তুলে নিয়েছেন মোস্তাফিজ, খানিক পর দওলত জাদরানকেও। ম্যাচ তো বাংলাদেশ আসলে জিতেই গেছে তখন! বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেন সাইফ উদ্দিন।

    মাশরাফির জন্য শুরুটাও খারাপের হয়নি। এই উইকেটে যে আগে ব্যাটই করতে চেয়েছিলেন। টস জিতে আফগান অধিনায়ক নাইব সেই সুযোগই করে দিয়েছিলেন তাকে।

    হ্যাম্পশায়ার বোলের মাঠটা ইংল্যান্ডের অন্য মাঠের চেয়ে একটু অন্যরকম। মাঠটা একদম বৃত্তাকার বা সীমানা বড় হওয়ার জন্য নয়, এখানে যে স্পিনটাও একটু বেশি ধরে। বিশ্বকাপে আগের তিন ম্যাচে সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে ভালোমতো, কোনো দলই ২৩৫-ও পার করতে পারেনি। আর আফগানরা যে স্পিন লেলিয়ে দেবে সেটা জানা ছিল আগে থেকেই। বাংলাদেশও দাবার বোর্ডে প্রথম চালটা দিয়ে দিল, তামিম ইকবালের সঙ্গে নিয়ে এলো লিটন দাসকে।

    এই বিশ্বকাপে আগের সব ম্যাচে তামিম-সৌম্যই ওপেন করেছেন, খুব খারাপও করেননি। ডানহাতি বাঁহাতির জন্য হোক বা মুজিব উর রেহমানের জন্য হোক, লিটনকে আনার ফাটকা খারাপ মনে হচ্ছিল না শুরুতে। ১৬ বলে ১৬ রানও তুলে ফেলেছিলেন লিটন। এরপরেই মুজিবের বলে ক্যাচ তুলে দিলেন শর্ট কাভারে। শহিদি ক্যাচটা ধরেই উল্লাস শুরু করে দিলেন। রিপ্লে দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল না বলটা মাটিতে লেগেছে কি না। তবে তৃতীয় আম্পায়ার সফট সিগনালের ওপর আস্থা রাঝলেন, কপাল পুড়ল লিটনের।

    তামিম আর সাকিব এরপর অবশ্য আর কোনো ঝুঁকি নিচ্ছিলেন না। আফগান স্পিনারদের বেশি চড়ে বসারও সুযোগও দেননি। এর মধ্যে পেসার দওলত ও গুলবদিনের ওভারে রান তুলে ক্ষতিটা পুষিয়েও দিচ্ছিলেন। তার আগে প্রথম ১০ ওভারে রান উঠল ৪৪।  দুজনের জুটিতে ৫০ রান উঠল ৫৮ বলে, বেশ জমেও গিয়েছিল জুটিটা।

    তার পরেই মনযোগ হারালেন তামিম। নবির বাড়তি টার্ন করা বল লাইন মিস করে বোল্ড, আউট হলেন ৫৩ বলে ৩৬ রান করে। ক্রিজে মুশফিক-সাকিব, এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা দুই পারফর্মার। রশিদ খান এলেন, সাকিব এলবিডব্লু হয়েও রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেলেন। রানও উঠছিল ভালোই, দুজন ৫০ রান যোগ করে ফেললেন মাত্র ৪৮ বলে।

    সাকিব এর মধ্যে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১ হাজার রান করে ফেলেছেন। ফিফটিও পেলেন, তবে আজ আর বেশিদূর যেতে পারলেন না। মুজিবের ক্যারম বল বুঝতে না পেরে এলবিডব্লু হয়ে গেলেন, ৬৯ বলে করলেন ৫১। সৌম্য এলেন, তিনিও ক্যারম বল বুঝতে না পেরে এলবিডব্লু। রিভিউ নিলেন, কিন্তু একটুর জন্য বলটা লাগল স্টাম্পে। রিভিউ থাকল, কিন্তু দুর্ভাগা সৌম্য ফিরলেন ৩ রান করেই।

    মাহমুদউল্লাহর শুরুতেই পায়ের পেশীতে টান লাগল, কিন্তু সেই টান নিয়েই খেলে যেতে লাগলেন। মুশফিক শুরুতে বেশ আগ্রাসী ছিলেন, তবে পরিস্থিতি বুঝে এরপর খেলছিলেন ঝুঁকি না নিয়ে। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুটিতে ৫০ রানও হয়ে গেল। ৪০ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ১৯৩, হাতে ৬ উইকেট।

    এর মধ্যে মুশফিকের ফিফটি হয়ে গেছে, ম্যাচের একমাত্র ছয়টাও মেরেছেন। তবে মাহমুদউল্লাহ খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেশি বড় করতে পারলেন না ইনিংসটা, ৩৮ বলে ২৭ রান করে আউট হয়ে গেলেন নাইবের বলে। মোসাদ্দেক আর মুশফিক এরপর একটা ধাক্কা দিলেন রানের চাকায়, ছয় না হলেও চার আসতে লাগল নিয়মিতই। মুশফিক সেঞ্চুরির চেষ্টা করতে গেলেন, কিন্তু ৪৯তম ওভারে মারতে গিয়েই আউট হয়ে গেলেন। ৮৭ বলে ৮৩ রানের ইনিংসটাই অবশ্য আজ পথ দেখাল বাংলাদেশকে। মোসাদ্দেক রইলেন শেষ পর্যন্ত, শেষ বলে আউট হওয়ার আগে খেললেন সময়ের দাবি মেটানো ২৪ বলে ৩৫ রানের ইনিংস। বাংলাদেশের রানও হলো ২৬২, সাউদাম্পটনে এবারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ। সাকিবের জন্য যে রানই আফগানিস্তানের কাছে শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল এভারেস্ট।