এজবাস্টনে বিরানব্বইয়ের দেজা ভ্যুর আরেক ধাপে পাকিস্তান
নিউজিল্যান্ড ২৩৭/৬, ৫০ ওভার (নিশাম ৯৭*, গ্র্যান্ডহোম ৬৪, আফ্রিদি ৩/২৮, শাদাব ১/৪৩)
পাকিস্তান ২৪১/৪, ৪৯.১ ওভার (বাবর ১০১*, হারিস ৬৮, বোল্ট ১/৪৮, উইলিয়ামসন ১/৩৯)
পাকিস্তান ৬ উইকেটে জয়ী
১৯৯২। পাকিস্তান সেটা শুনলেই সবার আগে ফিরে যায় অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের সেই বিশ্বকাপের সময়ে। সেই বিশ্বকাপটা জেতার পর থেকেই পাকিস্তানের নস্টালজিয়াই আক্রান্ত হওয়ার উপলক্ষ্য হয়তো সেটা। এবারের বিশ্বকাপেও ম্যাচ-বাই-ম্যাচের ফল মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই বিশ্বকাপকে। সেই কাকতালের ধারাবাহিকতায় তাদের ‘প্রয়োজন’ ছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এই ম্যাচে জয়টা। ‘৯২-এর সেই ম্যাচটার সঙ্গে মিল রেখেই জিতল পাকিস্তান। এরপরও পাকিস্তান ‘৯২-কে টানলে আসলে সেটিকে অতিশায়িত বলে ফেলে দেওয়া যায় না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এ ম্যাচের জয় দিয়ে সেমিফাইনালের আশা টিকিয়ে রাখলো তারা, কার্যত প্রতিটি ম্যাচই নক-আউট বনে যাওয়ার প্রথম হার্ডলটা পেরুল তারা। আর এ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো হারলো নিউজিল্যান্ড, ৮ বছরে প্রথমবারের মতো হারলো গ্রুপপর্বে।
‘৯২-এ ক্রাইস্টচার্চের এক বাঁহাতি পেসারের (ওয়াসিম আকরাম) তোপে প্রথমে ব্যাটিং করে অল্প রানেই (১৬৬) গুটিয়ে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। এবার আরেকজন বাঁহাতি পেসার (শাহিন শাহ আফ্রিদি) ভূমিকা রাখলেন নিউজিল্যান্ডকে ২৩৭ রানে আটকে দিতে। জবাবে একজন ডানহাতির (রমিজ রাজা) সেঞ্চুরিতে পাকিস্তান জিতেছিল ৭ উইকেটে, এদিন প্রায় সেটা হয়ে গিয়েছিল, শেষ মুহুর্তে হারিসের রান-আউট ব্যবধান কমিয়ে এনেছে ছয় উইকেটে, তবে ঠিকই সেঞ্চুরি পেয়েছেন একজন ডানহাতি- বাবর আজম। সেবার ম্যাচ খেলা ওয়াসিম আকরাম, রমিজ রাজা, ইয়ান স্মিথরা এদিন ছিলেন ধারাভাষ্যে। সে ম্যাচে খেলা ইনজামাম-উল-হকের ভাতিজা ইমাম-উল-হক খেলেছেন এ ম্যাচে, ছিলেন রড ল্যাথামের ছেলে টমও।
এসব কাকতাল বাদ দিলে এজবাস্টনের ম্যাচটা ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিন এক পিচে পাকিস্তানের নিউজিল্যান্ডকে প্রতিটি বিভাগে পেছনে ফেলার গল্প। আফ্রিদি শুরুতে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বাঁহাতি পেস কেন ‘সেক্সি’, জিমি নিশাম-কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম দেখিয়েছিলেন কিভাবে ঝুলে থাকতে হয়। শাদাব খানের একটা ডেলিভারি গর্বিত করতে পারে শেন ওয়ার্নকে। দ্বিতীয় ইনিংসে শুরুতে ট্রেন্ট বোল্ট দেখিয়েছিলেন ভেলকি, লকি ফার্গুসন হাজির হয়েছিলেন তার পেস নিয়ে, মার্টিন গাপটিল দুর্দান্ত ফিল্ডিং নিয়ে। এরপর বাবর ও হারিস সোহেলের কারুকার্য, যাতে বিফলে গেছে উইলিয়ামসনের সব বাজি।
রানতাড়ায় ইমাম-উল-হক ও ফাখা্র জামান আক্রমণাত্মক শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, প্রথম ১৩ বলের মাঝেই চার বাউন্ডারি মেরে। তবে বোল্ট ছাপিয়ে গেলেন ফাখারকে, তার বলে মিসটাইমিংয়ে লিডিং-এজড হয়ে ফিরলেন। বাবরের সঙ্গে ইমামের জুটি ভাঙতে প্রয়োজন হলো দুটি ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যের। ফার্গুসনের শর্ট বলে বেসামাল ইমাম ধরা পড়লেন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট থেকে ঈগলের শিকার করার মতো করে সামনে লাফিয়ে পড়া মার্টিন গাপটিলের হাতে।
পাকিস্তানের বড় একটা জুটি প্রয়োজন ছিল, বাবর-হাফিজ গড়ছিলেন সেটাই, যেটি পেরিয়ে গেল ফিফটি। তবে স্পিনার আসার পর থেকেই অস্বস্তিতে ছিলেন তারা একটু। ব্রেকথ্রু এনে দিলেন কেন উইলিয়ামসন, মিচেল স্যান্টনারের পাওয়া টার্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে যিনি এসেছিলেন পার্ট-টাইম অফস্পিন নিয়ে। হাফিজ পা দিলেন সেই ফাঁদেই, তুলে মারতে গিয়ে মিডউইকেটে ধরা পড়লেন, এ বিশ্বকাপে তৃতীয়বার পার্ট-টাইমারদের বোলিংয়ে বেসামাল হলেন তিনি।
নিউজিল্যান্ডের উইকেট প্রয়োজন ছিল আরও। তবে বাবর-হারিসের মাস্টারক্লাসে সেটা আর পেলেন না তারা। বোল্ট বাবরকে বিট করলেন, বাবর সেটার জবাব দিলেন চার মেরে, এক ওভারেই এমন হলো দুবার। ৩৮ রানে স্যান্টনারের বলে কাট করতে গিয়ে এজড হয়েছিলেন বাবর, সেটা ধরতে পারেননি উইকেটকিপার টম ল্যাথাম। সেবার জীবন পেয়েই বাবর শ্যাডো করছিলেন, খেলা উচিৎ ছিল সোজা ব্যাটে। বাবর এরপর থেকে করলেন সেসবই, যা করা উচিৎ!
উইলিয়ামসন বোলিং করে গেলেন, আনলেন মানরোকে। তবে সেটা হয়ে গেল অতিরিক্ত, উলটো চাপ কমে গেল বাবর-হারিসের ওপর থেকে। এরপর তারা চড়াও হলেন বোল্ট-ফার্গুসনের ওপরও। ৬৩ বলে ফিফটি পেলেন হারিস, বাবর সেঞ্চুরি পেলেন ১২৪ বলে। এটি এ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের প্রথম সেঞ্চুরি, ১৯৮৭ সালের পর নন-ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম সেঞ্চুরি। এদিনই দ্বিতীয় দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ৩০০০ রান হয়ে গেছে বাবরের, পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরিটি পেলেন একেবারে মোক্ষম সময়ে।
হারিসের রান-আউটে ১২৬ রানের জুটি ভাঙলো, তবে ততক্ষণে জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে পাকিস্তানের। এর আগে প্রথম ইনিংসেও নিউজিল্যান্ডের হাইলাইটস ছিল একটি সেঞ্চুরি জুটি, তবে সেটা ছিল ডুবন্ত নিউজিল্যান্ডকে উদ্ধারকারী।
টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া নিউজিল্যান্ডের কাছে বাঁহাতি পেস দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছিল। শরীরী ভাষায় পাকিস্তান ছিল দুর্দান্ত। নিজের প্রথম বলেই পাকিস্তানকে ব্রেকথ্রু এনে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আমির। তার অ্যাঙ্গেল করে বেরিয়ে যাওয়া বলে ব্যাট ছুঁড়ে স্টাম্পে বল ডেকে এনেছিলেন মার্টিন গাপটিল।
এরপর আফ্রিদিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল নিউজিল্যান্ড। দুর্দান্ত লাইন, লেংথ, সিম পজিশন, মুভমেন্ট, পেস, অ্যাকুরেসি- আফ্রিদির ভাষা এলিয়েনের মতো ঠেকছিল ব্ল্যাকক্যাপস ব্যাটসম্যানদের কাছে। মানরো অফস্টাম্পের বাইরের বলে কাট করতে গিয়ে এজড হয়েছিলেন। টেইলরের উইকেটে অবশ্য আফ্রিদির মতো দুর্দান্ত ছিলেন সরফরাজও। প্রথম স্লিপ ও উইকেটকিপারের মাঝ বরাবর যাওয়া ক্যাচটা ডানদিকে ঝাঁপিয়ে নিয়েছেন পাকিস্তান অধিনায়ক। টম ল্যাথামের জন্য আফ্রিদির বল ছিল বেশি ভাল, নিক হওয়া ছাড়া যেন আর কোনও উপায়ই ছিল না ল্যাথামের। একসময় আফ্রিদির বোলিং ফিগার পড়ছিল এমন, ৬-৩-৯-৩!
নিউজিল্যান্ডের সব আশা-ভরসা তখন আরেকবার গিয়ে ঠেকেছে কেন উইলিয়ামসনের ওপর। গেম অফ থ্রোনসের ব্যাটল অফ বাস্টার্ডের জন স্নো, প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তিনি দাঁড়িয়ে একা। লড়াই করলেন বেশ কিছুক্ষণ, মূলত সেটা ছিল টিকে থাকার লড়াই। এলেন শাদাব খান। যে ডেলিভারিটা করলেন, তাতে গর্বিত হওয়ার কথা শেন ওয়ার্নেরও। দারুন লুপ, উইলিয়ামসনকে সামনে ঝুঁকে আনলো সেটা, এরপর টার্ন করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে চুমু দিয়ে গেল গ্রে নিকোলসে। ইনিংসের অর্ধেক পেরিয়ে গেছে, নিউজিল্যান্ডের রান তখন ৮৩, অর্ধেক ব্যাটসম্যান ফিরে গেছেন!
এলেন নিশাম, এলেন গ্র্যান্ডহোম। সরফরাজ ২৩ ওভারের মাঝেই হাফিজকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন ৭ ওভার, মানে, তখন তার হাতে তার স্ট্রাইক বোলাররা। পুরো শক্তি নিয়ে আক্রমণ করবেন। আফ্রিদির বলে একসময় তিন স্লিপ আর গালি ছিল, হাফিজের বলে স্লিপের সঙ্গে ছিল সিলি পয়েন্টও। তবে নিশাম-গ্র্যান্ডহোমকে টলাতে পারলেন না তারা। তাদের জুটির আগে নিউজিল্যান্ডের রান-রেট ছিল ৩.১৫, তারা দুজন মিলে ১৩২ রান যোগ করলেন ছয়ের ওপর রানরেটে।
শুরুতে দুজনই নড়বড়ে ছিলেন একটু, ধীরে ধীরে চড়াও হয়েছেন পাকিস্তান বোলারদের ওপর। ৩৩তম ওভারে এসে প্রথম ছয় হয়েছে নিউজিল্যান্ড ইনিংসে। ৭৭ বলে ফিফটি পূর্ণ করেছেন নিশাম, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে আনলেও ব্রেকথ্রু পাননি সরফরাজ। প্রথম ৭ ওভারে ১৭ রান দেওয়ার পরের দুই ওভারে ২৩ রান দিয়েছিলেন শাদাব। আফ্রিদি অবশ্য বোলিং শেষ করেছেন ২৮ রানে ৩ উইকেট নিয়েই।
নিশামকে আউটের কাছাকাছি পাকিস্তান গিয়েছিল আফ্রিদির বলে, যেখানে আম্পায়ারস রিভিউয়ের ওপরে রিভিউ নিয়েছিলেন সরফরাজ। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি নিশাম শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন সেঞ্চুরি থেকে ৩ রান দূরে। গ্র্যান্ডহোম ৬৪ রানে রান-আউট হয়েছেন ৪৮তম ওভারে গিয়ে, তবে শেষ ৫ ওভারে ৫৩ রান ঠিকই তুলেছে নিউজিল্যান্ড।
বাবর-হারিসের কাছে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট হয়নি যেসব।