টাইব্রেকারে প্যারাগুয়েকে হারিয়ে 'থার্ড টাইম লাকি' ব্রাজিল
২০১১, ২০১৫। শেষ তিনবারের ভেতর দু’বার কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছিল ব্রাজিল, দু’বারই প্যারাগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরেছিল তারা। আর ২০১৫ আসরে প্যারাগুয়ের কাছেই পেনাল্টিতে বিদায়টা এসেছিল ঠিক এদিনেই। পুরো ম্যাচ দারুণ খেলেও টাইব্রেকারে যাওয়ার পর তাই হয়তো প্যারাগুয়ের ইতিহাস পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাতেই ছিল ব্রাজিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্যারাগুয়ের তিন দান নয়, হল ব্রাজিলের ‘থার্ড টাইম লাকি’। অ্যালিসন সেখানে নায়ক। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে টাইব্রেকারে ৪-৩ ব্যবধানে প্যারাগুয়েকে হারিয়ে এক যুগ পর কোপার সেমিফাইনালে উঠেছে ব্রাজিল। শেষ চারে তাদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা বা ভেনেজুয়েলা।
নির্ধারিত সময়ে খেলা ছিল গোলশূন্য। এই নিয়ে এই দুইদলের খেলা রেকর্ড ৮ বারের মতো শেষ হয়েছে সমতায়। কোপার কোয়ার্টার ফাইনালে রাখা হয়নি এক্সট্রা টাইম। তাই সরাসরি টাইব্রেকারেই নির্ধারণ হয়েছে ফল। টাইব্রেকারে প্রথম শটে প্যারাগুয়ের অধিনায়ক গুস্তাভো গোমেজের শট দারুণ এক সেভে ফিরিয়ে দেন ব্রাজিল গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। আর প্রথম শটেই দলকে লিড এনে দেন উইলিয়ান। এরপরের দুই শটে গোল করে দু’দলই; ব্রাজিলের হয়ে জাল খুঁজে পান মার্কিনহোস এবং ফিলিপ কুতিনিয়ো; প্যারাগুয়ের হয়ে গোল করেন রোহাস এবং ভালদেজ। ব্রাজিলের হয়ে চতুর্থ শটে গোল করতে ব্যর্থ হন রবার্তো ফিরমিনো। কিন্তু ফিরমিনোকে বাঁচিয়ে দেন ডার্লিস গঞ্জালেস, প্যারাগুয়ের পঞ্চম কিক থেকে লিভারপুল ফরোয়ার্ডের মত বাইরে তিনি। ‘স্কোর টু উইন’ পঞ্চম পেনাল্টি জালে পাঠিয়ে ১২ বছর পর কোপায় ব্রাজিলের সেমিফাইনাল যাত্রা নিশ্চিত করেন গ্যাব্রিয়েল হেসুস। কোপার ইতিহাসে টাইব্রেকারে সবচেয়ে বেশি মায়চ খেলার রেকর্ডও হয়ে গেছে ব্রাজিলের। উরুগুয়ে আর আর্জেন্টনা ৮ বার করে ভাগ্য নির্ধারণ করেছে টাইব্রেকারে, ব্রাজিলের জন্য সংখ্যাটা আরও এক বেশি।
কোয়ার্টার ফাইনালে আসা দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পয়েন্ট পাওয়া প্যারাগুয়ের বিপক্ষে পুরো ম্যাচেই ছড়ি ঘুরিয়েছে ব্রাজিল। গোলের সুযোগ তৈরি, বল দখল, শট- সব দিক দিয়েই এগিয়েছিল তারা। কিন্তু গোলটাই আর পাওয়া হয়নি তাদের। দ্বিতীয়ার্ধে লাল কার্ড দেখে প্যারাগুয়ে দশ জনের দলে পরিণত হওয়ার পরও ব্রাজিলের ভাগ্য খোলেনি। প্রায় আধঘন্টার ওপর প্যারাগুয়ের চেয়ে একজন বেশি নিয়েও গোল করতে পারেনি ব্রাজিল। বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা ম্যাচের মত এদিনও প্রথমার্ধে গোল করতে পারেনি ব্রাজিল।
পোর্তো আলেগ্রেতে হলুদ কার্ডের খড়গে খেলতে পারেননি কাসেমিরো। তার বদলে নেমেছিলেন নাপোলি মিডফিল্ডার অ্যালান। আর আক্রমণ ছিল শেষ ম্যাচের মতোই। ফিরমিনো, এভারটন, হেসুস তিনজনই ছিলেন শুরুর থেকে। ম্যাচের শুরুতেই ফিরমিনো এবং হেসুসের দুটি প্রচেষ্টা প্যারাগুয়ের রক্ষণভাগকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রাজিল। বল দখলে এগিয়ে থাকলেও ম্যাচ যত গড়িয়েছে, ব্রাজিলের আক্রমণের ধার কমেছে ততটাই।
আক্রমণাত্মক শুরু মিলিয়ে যাওয়ার পর গোলমুখে বিবর্ণ ব্রাজিলকে পেয়ে আরেকটু হলেই লিড নিতে পারত ‘বাস পার্ক’ ট্যাকটিক্স এবং প্রতি-আক্রমণে খেলা প্যারাগুয়ে। কিন্তু ২৯ মিনিটে ডিবক্সে হার্নান পেরেজের সুযোগসন্ধানী ক্রসে ডার্লিস গঞ্জালেজের আগুনে শট দুর্দান্তভাবে ফিরিয়ে দেন অ্যালিসন বেকার। প্রথমার্ধে আর গোলের সুযোগ পায়নি কোনও দলই। তবে এবার গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর বলিভিয়া বা ভেনেজুয়েলা ম্যাচের মত দুয়ো শুনতে হয়নি ব্রাজিলকে।
বিবর্ণ প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধে জ্বলে ওঠাকে যেন এবারের কোপায় ‘রুটিন’ই বানিয়ে ফেলেছে ব্রাজিল। তবে এবারের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলের বদলে আবারও স্পটলাইটে এসেছে বিতর্কিত ‘ভিএআর’। ৫৩ মিনিটে ফাবিয়ান বালবুয়েনা, ফিরমিনোকে ফাউল করায় পেনাল্টির বাঁশি দেন রেফারি। ভিডিও রেফারির শরণাপন্ন হয়ে মাঠের বাইরে এসে মনিটরে ফাউলটি আবারও দেখে ফ্রিকিকের সিদ্ধান্ত দেন রেফারি, কিন্তু বালবুয়েনা দেখেন লাল কার্ড। তাতে ফুঁসে ওঠে মাঠে উপস্থিত প্যারাগুয়ে সমর্থকেরা, প্রতিবাদের জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয় প্যারাগুয়ে কোচ এদুয়ার্দো বেরিৎজোকেও।
বালবুয়েনার ফাউলে পাওয়া ফ্রিকিকে ব্রাজিল অধিনায়ক দানি আলভেজের শট দারুণভাবে ফিরিয়ে দেন গোলরক্ষক গাতিতো ফার্নান্দেজ। দ্বিতীয়ার্ধের বাকিটা সময় ১০ জনের প্যারাগুয়েকে সমতায় রেখেছেন ফার্নান্দেজই। দুর্দান্ত সব সেভে ফিরিয়ে দিয়েছেন কুতিনিয়ো, ফিরমিনোদের। অবশ্য ভাগ্যও সহায় হয়েছিল প্যারাগুয়ের। ৭৪ মিনিটে কুতিনিয়োর পাসে গোলের ছয় গজ দূর থেকে শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি হেসুস। অবশ্য ‘ভিএআর’ নিয়ে আরও অভিযোগ থাকতেই পারে প্যারাগুয়ের।
৮৩ মিনিটে বল দখলের লড়াইয়ে প্যারাগুয়ের মিগেল আলমিরনকে কনুই দিয়ে আঘাত করে বসেন আর্থার। ‘ভিএআর’-এর সাহায্য নিয়েও আর্থারকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করে দেন রেফারি। ৮৮ মিনিটে আবারও প্যারাগুয়ের ত্রাতা হয়ে আসেন ফার্নান্দেজ। কুতিনিয়োর ফ্রি-কিক থেকে বদলি অ্যালেক্স সান্দ্রোর হেড দুর্দান্তভাবে ফিরিয়ে দেন তিনি। অবশ্য ভাগ্যও সহায় ছিল গোলরক্ষক ফার্নান্দেজের। ম্যাচের একেবারে অন্তিম মুহূর্তে আরেক বদলি উইলিয়ানের আগুনে শট তাকে পরাস্ত করলেও প্রতিহত হয় ক্রসবারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেনাল্টিতে হেরে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে ফার্নান্দেজ এবং প্যারাগুয়েকে। পুরো ম্যাচে ব্রাজিল মোট ২৫ বার গোলের অ্যাটেম্পট নিয়েছে। আর ৮ বার গোল বাঁচিয়েছেন প্যারাগুয়ে গোলরক্ষক। শেষ তিন কোপার হিসাবে এক ম্যাচে এটাই যে কোনো গোলরক্ষকের যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ সেভ।
দীর্ঘ এক যুগ অপেক্ষার পর কোপার সেমিফাইনালে ব্রাজিল, তাও নিজেদের মাটিতে। সব ঠিক থাকলে শেষ চারেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের ‘সুপারক্লাসিকো’ দেখতে যাচ্ছে ফুটবলবিশ্ব। শেষ যেবার সেমিতে গিয়েছিল ব্রাজিল, সেবার শেষ হাসি হেসেছিল তারাই। আর দুই ম্যাচে জয় পেলেই এক যুগ পর লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব পুনরোদ্ধার করবে ‘সেলেসাও’রা। নিজ সমর্থকদের সামনে এর চেয়ে মধুর আর কীইবা হতে পারে তিতের দলের জন্য।
ব্রাজিল একাদশ: অ্যালিসন; দানি আলভেজ (পাকেতা), থিয়াগো সিলভা, মার্কিনহোস, ফিলিপে লুইস (সান্দ্রো); আর্থার মেলো, অ্যালান (উইলিয়ান); এভারটন, কুতিনিয়ো, উইলিয়ান; ফিরমিনো