তপ্ত লন্ডনে উত্তপ্ত অস্ট্রেলিয়ায় পুড়ে গেল নিউজিল্যান্ড
৩৭তম ম্যাচ, লর্ডস
অস্ট্রেলিয়া ২৪৩/৯, ৫০ ওভার
নিউজিল্যান্ড ১৫৭ অল-আউট, ৪৩.৪ ওভার
নিউজিল্যান্ড ৮৬ রানে জয়ী
লন্ডনে এদিন ছিল তপ্ত এক দিন। লর্ডসের মেম্বারস স্ট্যান্ডে দেখা যায়নি তেমন ব্লেজার, দর্শকদের মাঝে ঘুরে ফিরছিল সানক্রিম। সেই তপ্ত দিনে উত্তপ্ত হয়ে উঠল অস্ট্রেলিয়া, যেটা সামাল দিতে পারলো না নিউজিল্যান্ড। অথচ অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটিংয়ে একসময় ৯২ রানে ৫ উইকেটে পরিণত করেছিল নিউজিল্যান্ড, তবে মিচেল স্টার্কদের তোপে তারা শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে গেছে ১৫৭ রানেই। হ্যাটট্রিক করেও দিনটা বিস্মৃত হয়ে গেল বোল্টের, তাকে ছাপিয়ে গেলেন স্টার্ক-বেরেনডর্ফরা। প্রথম ছয় ম্যাচ অপরাজিত থাকা নিউজিল্যান্ড হারলো টানা দুই ম্যাচ, নাগালে থাকা সেমিফাইনালটাও ঝুলে রইল এখনও। আর অস্ট্রেলিয়া ১৪ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থানটা পোক্ত করলো আরেক দফা।
টসে জিতে ব্যাটিং নিয়ে সিদ্ধান্তটা একসময় অবশ্য বুমেরাং হতে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার জন্য। বোল্ট-ফার্গুসনরা তখন আগুন ঝড়াচ্ছেন, আর অস্ট্রেলিয়ার উইকেট পড়ছে টপাটপ। দাঁড়িয়ে গেলেন উসমান খাওয়াজা ও অ্যালেক্স ক্যারি। তাদের ১০৭ রানের জুটিই শেষ পর্যন্ত হয়ে আছে ম্যাচের সর্বোচ্চ। সে জুটিই শেষ পর্যন্ত গড়ে দিল পার্থক্য। আর ব্যাটিংয়ে বড় জুটি শুধু খুঁজেই ফিরেছে নিউজিল্যান্ড, ৯৭ রানে ২ উইকেট থেকে শেষ ৮ উইকেট তারা হারিয়েছে মাত্র ৬০ রানের মাঝেই। আটজন বোলার এনে নিউজিল্যান্ডকে রীতিমত দিশেহারা বানিয়ে ফেলেছিলেন ফিঞ্চ।
স্টার্ক, দ্য রেকর্ড ব্রেকার!/আইসিসি
লর্ডসের উইকেটে শুরুতেই সুইংয়ের দেখা পেয়েছিলেন বোল্ট। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে ভেতরের দিকে ঢোকানো বলে এলবিডব্লিউ করলেন ফিঞ্চকে, এরপর ফার্গুসনের আগুনে পেসে বেসামাল হয়ে পড়লেন ওয়ার্নার। তার শর্ট বলটায় ব্যাট সরিয়ে নিতে গিয়েও পারেননি পুরোপুরি, শেষ মুহুর্তে ওয়ার্নার হয়েছেন গ্লাভড। এ টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়ার ওপেনিং জুটি অন্যতম বড় ভরসার নাম, সেটি দ্রুতই দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে নিউজিল্যান্ড তখন ধরেছে অন্য সুর।
খানিক বাদে স্মিথের উইকেট আরও দুর্দশা বাড়ালো অস্ট্রেলিয়ার। এবার ফার্গুসনের শর্ট বলের চেয়েও যে উইকেট বড় অবদান ইগল-সম গাপটিলের। হুক করেছিলেন স্মিথ, লেগ-গালিতে সেটা ধরেছেন গাপটিল। এর আগে শর্ট কাভার ও দ্বিতীয় স্লিপে দুটি কঠিন সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন গাপটিল, সেসবেরই দায়মোচন করলেন যেন তিনি।
এরপর নিশামের গল্প। মার্কাস স্টোয়নিস কট-বিহাইন্ড, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ফিরতি ক্যাচে পরিণত। ম্যাক্সওয়েলের ক্যাচটা ফলো-থ্রুতে বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে নিয়েছেন নিশাম। নিউজিল্যান্ড তখন উড়ছে রীতিমতো। বাধা হয়ে দাঁড়ালেন খাওয়াজা, বাধা হয়ে দাঁড়ালেন ক্যারি।
খাওয়াজা ধীরগতির ছিলেন, তবে ক্যারি খেললেন পরিস্থিতি বিরুদ্ধ দারুণ পেসের এক ইনিংস। খাওয়াজার ফিফটি করতে লেগেছিল ৮০ বল, ক্যারি করলেন সেটি ৪৭ বলেই। এদিন ম্যাট হেনরিকে বাদ দিয়ে বাড়তি স্পিনার হিসেবে ইশ সোধিকে খেলিয়েছে নিউজিল্যান্ড, তবে ৬ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে ঠিক সুবিধা করতে পারলেন না তিনি। সহসাই ব্রেকথ্রুটিও পেল না কিউইরা।
সে জুটি ভাঙলেন উইলিয়ামসন নিজে। ক্যারি শর্ট কাভারে ক্যাচ দিয়েছিলেন। খাওয়াজা ছিলেন আরও কিছুক্ষণ, কামিন্সের সঙ্গে জুটিতে তুলেছেন আরও ৪৪ রান। শেষ ওভারে গিয়ে বোল্টের ইয়র্কারের শিকার হয়ে ফেরার আগে খাওয়াজা করেছেন ৮৮ রান। খাওয়াজার উইকেটটি ছিল বোল্টের হ্যাটট্রিকের প্রথমটি।
এরপর স্টার্ক সামলাতে পারেননি বোল্টের ইয়র্কার, হারিয়েছেন স্টাম্প। বেরেনডর্ফও ইয়র্কার পেয়েছেন, হয়েছেন এলবিডব্লিউ। শুরুর মতো শেষটাও নিউজিল্যান্ড করেছিল দারুণ। তবে এরপর তাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, সেটা যদি তারা জানতো!
প্রথম ইনিংসে দুর্দান্ত ছিলেন বোল্ট/আইসিসি
গাপটিল-নিকোলস শুরুটা করেছিলেন বেশ ধীরলয়ে। লক্ষ্য ছোট বলে সে কৌশলটা খুব বুমেরাং হবে বলে মনে হচ্ছিলও না তখন। বিপত্তি বাঁধালেন বেরেনডর্ফ। তার বলে কট-বিহাইন্ড হয়ে নিকোলসের উইকেট মূলত খুলে দিল উইকেটের বাঁধ, নিউজিল্যান্ডের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিতে অবশ্য সময় লেগেছে আরেকটু। গাপটিল এরপর ইনসুইংয়ের শিকার, হয়েছেন এলবিডব্লিউ। বেরেনডর্ফ আরেকবার দিয়েছেন তার প্রতি রাখা অস্ট্রেলিয়ার আস্থার প্রতিদান।
নিউজিল্যান্ডের সব ভরসা গিয়ে ঠেকেছিল উইলিয়ামসনের ওপর, সঙ্গে ছিলেন টেইলর। তবে দিনটা উইলিয়ামসনের নয়। দিনটা টেইলর বা নিউজিল্যান্ডেরই নয়।
ফিঞ্চ বোলিংয়ে আনলেন স্মিথকে, প্রায় সাড়ে চার বছর পর বোলিং করতে এলেন তিনি। এরপর ফিঞ্চ নিজে এলেন। এলেন ম্যাক্সওয়েল। পার্ট-টাইমারদের দিয়ে যেন জুটিটা আলগা করলেন ফিঞ্চ, স্টার্ক এসেই দিলেন ব্রেকথ্রু। তার অফস্টাম্পের বাইরের বলে গ্লাইড করতে গিয়ে কট-বিহাইন্ড উইলিয়ামসন, এর আগে যিনি দুবার কঠিন দুটি সুযোগ দিয়ে বেঁচেছিলেন।
টেইলর শিকার কামিন্সের, ট্রেডমার্ক পুল করতে গিয়ে তিনি বল তুলেছিলেন আকাশে। নিউজিল্যান্ডের ধসের দামামা বেজে গেছে ততক্ষণে।
কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই স্মিথকে তুলে মারতে গিয়ে তাকে দিলেন প্রায় বিস্মৃত উইকেটের স্বাদ। ২০১৪ সালের নভেম্বরের পর আবার ওয়ানডে উইকেট পেলেন স্মিথ। লর্ডসে এদিনও স্মিথ শুনেছেন দুয়ো, তবে উইকেট নিয়ে হাসিমুখেই জবাব দিলেন সেসবের। লায়নকে এরপর দারুণ বোলিংয়ের পুরষ্কারটা দিলেন জিমি নিশাম। আগের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন নিশাম-গ্র্যান্ডহোম, এবার আর পারলেন না।
নিউজিল্যান্ড গুটিয়ে যাওয়া তখন সময়ের অপেক্ষা। স্টার্ক বেশি সময় নিলেন না। ম্যাচে দ্বিতীয় বাঁহাতি হিসেবে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগালেন, সেটা অবশ্য পেলেন না। তবে নিউজিল্যান্ডের লেজ ছেঁটে দিয়ে স্টার্ক পেলেন পাঁচ উইকেট, বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে তিনবার এই কীর্তি হলো তার।