‘সাদা’ ক্রিকেট, ‘কালো’ ক্রিকেট - শেষ পর্ব
সাদা-কালো বৈষম্য, শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গ জাতিবিদ্বেষ- বিংশ শতাব্দীতেও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসবের শিকড় উপড়ে ফেলা যায়নি। ইতিহাসের একমাত্র দেশই হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানে প্রত্যেক খেলার জাতীয় দল ছিল একাধিক! প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ছিল শুধু সাদা ক্রিকেটারদের জন্যে। কালো তো বটেই অশ্বেতাঙ্গরাই সেখানে সু্যোগ পেত না। কালোদের জন্যে চালু ছিল আলাদা লিগ, সু্যোগ-সুবিধা ছিল সীমিত, মাঠ সংকট ছিল প্রকট। অনেক ক্ষেত্রেই মাঠগুলোতে কালোদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করা হত। বিস্ময়কর হলেও সত্যি গত শতাব্দীর ষাটের দশকে দুনিয়ার একপ্রান্তে যখন চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিল, দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন সরকার তখন ব্যস্ত ছিল সাদা-কালো বৈষম্য জিইয়ে রাখার নির্লজ্জ এবং প্রকাশ্য অনাচারে। জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে সম্প্রীতিই যেখানে শেষ কথা, দক্ষিন আফ্রিকায় সেই খেলাধুলা নিয়েই ঘটছিল সম্প্রীতি বিনাশের কর্মযজ্ঞ।এসবের ফলশ্রুতিতেই তাদের উপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞা। দীর্ঘ ২২ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছিল নির্বাসিত। ক্রিকেটীয় চেতনার জন্যে অপমানকর সেই ঘটনাবলীর পূর্বাপর আর প্রভাব নিয়েই চার পর্বের এই ধারাবাহিক।
আরো পড়ুনঃ
'সাদা' ক্রিকেট, 'কালো' ক্রিকেট - পর্ব ১
'সাদা' ক্রিকেট, 'কালো' ক্রিকেট - পর্ব ২
'সাদা’ ক্রিকেট, ‘কালো’ ক্রিকেট - পর্ব ৩
১৫. শেষ সফর...
‘Here comes the sun, here comes the sun, and I say it’s alright.’ বীটলসের গানটার মতো দক্ষিণ আফ্রিকাতেও সেবার শীত বিদায় নিল। দুনিয়াটাই তখন ঝকঝকে, এক ঝাঁক তারুণ্যের সুবাতাস, স্নায়ুযুদ্ধের রেশ প্রায় মিলিয়ে গেছে। অর্থনীতি দাঁড়িয়ে গেছে পশ্চিমা দেশগুলোয়। বীটলসের এ্যালবাম ‘Abbey Road’ চার মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪ মাসে, তাও শুধুমাত্র ইউকেতে। তখন বেলবটম আর মিনি স্কার্টের যুগ, হিপ্পি কালচার আসন গেঁড়ে বসছে গোটা আমেরিকা জুড়ে। তারুণ্য তখন বেপরোয়া, ‘গাঁজা সেবন’ হচ্ছে তখনকার যুগের ‘স্মার্ট’ কালচার! প্রযুক্তির জয়যাত্রাও থেমে নেই, আবিষ্কৃত হয়েছে প্রথম বহনযোগ্য তথ্যভাণ্ডার- ফ্লপি ডিস্ক। সময়কাল ১৯৭০, এই তো সেদিনের কথা। কিন্তু সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আচার-ব্যবহারে পার্থক্য মনে হয় অনন্তকালের!
সেই বছরের জানুয়ারিতেই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসল। দলটির অধিনায়ক বিল লরি, আছেন ইয়ান চ্যাপেল এর মত দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান। ব্যাটিং অর্ডারের লেজও যেকোন বোলিং আক্রমণকে শাসন করার ক্ষমতা রাখে। আছেন নিল ম্যাকেঞ্জির মত ফাস্ট বোলার, গ্লিসনের মত মায়াবি স্পিনার। সদ্য ভারতের মাটিতে স্বাগতিকদের বিধ্বস্ত করে আসা সেই দলটিই তখন ‘আনঅফিসিয়ালি’ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
আলী বাখেরের তাতে কি আসে যায়? অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলা আগের সিরিজটা তো তাঁর দলই পরিস্কার ৩-১ ব্যবধানে জিতেছিল। ৪ বছর পর সেই অস্ট্রেলিয়ার কাছেই বিনা যুদ্ধে তিনি হার মানতে চাইলেন না। হার মানা অবশ্য লাগেও নি। চারটি টেস্টে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। বিশাল বিশাল ব্যবধানে চারটি টেস্টই হারলো অস্ট্রেলিয়া! ব্যবধানগুলো শুনবেন? প্রথম টেস্টে ১৭০ রান, দ্বিতীয় টেস্টে ইনিংস এবং ১২৯ রান, তৃতীয় টেস্টে ৩০৭ রান আর চতুর্থ টেস্টে ৩২৩ রান! অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসেই এমন লজ্জাকর পরাজয়ের ইতিহাস হয়তো আর আছেই দুই-একটা। উড়তে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা অবশ্য এই সাফল্য উপভোগ করতে পারেনি। এরপরই তো তাঁরা নিষিদ্ধ হল। যে সুরটা উঠেছিল ইতিহাসের অন্যতম অজেয় দল হবার, নিষেধাজ্ঞার ধাক্কায় সেটা মিলিয়ে গেল জমে উঠবার আগেই!
অনেক সাফল্য নিয়ে বীটলস ‘৬৯ সাল শেষ করেছিল।‘৭০ এ এসেই তাঁদের মধ্যেই দেখা দিল ফাটল। ‘সান’ দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এসেছিল ঠিক, শীতের কাঁপন এড়িয়ে রৌদ্রের উজ্জ্বলতার মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটেও ছিল উচ্ছ্ল কল্লোল। কিন্তু বর্ণবাদের নিকষ কালো আঁধারে বীটলসের সুরের মতো মিইয়ে গেল সেই ঢেউগুলোও!
১৬. আফসোস, আফসোস এবং আফসোস...
অনাদরে ফুলের কলিরা ঝরে যায়। শীতের কর্কশ থাবায় রিক্ত হয় গোলাপের সৌরভ। সুযোগের অভাবে তেমনি বিদীর্ণ হয় অসংখ্য দক্ষিণ আফ্রিকানদের হৃদয়!
ব্যারি রিচার্ডস। অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশ করা ঐ সিরিজে প্রায় ৭৩ গড়ে করেছিলেন ৫০৮ রান। দুইটি করে শতক আর অর্ধশতক ছিল তাঁর, খেলেছিলেন মাত্র সাতটি ইনিংস। এই ব্যাটসম্যানকে ক্যারিয়ার শেষ করতে হয়েছে ঐ চারটি টেস্টের স্মৃতি নিয়েই! ইতিহাসের অন্যতম দুর্ভাগা ব্যাটসম্যান বলা হয় তাঁকে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর ৮০টি সেঞ্চুরি সেই দুর্ভাগ্যের প্রতীক হয়েই যেন সৌভাগ্যের দিকে বক্রহাসি হাসে।
গ্রায়েম পোলকের কথা কি বলবেন? ২৩টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাতেই সাতটি শতক আর এগারটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। কমপক্ষে ২০০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর উপর গড় আছে শুধু আর একজনেরই- ব্র্যাডম্যান! পোলক সেই হাতে গোণা কয়েকজন ব্যাটসম্যানদের একজন, যাঁর টেস্ট গড় ফার্স্ট ক্লাসের চাইতেও বেশি! অনভিজ্ঞ অবস্থায় খেলেই যার গড় ছিল ৬০ এর উপরে, অভিজ্ঞ হয়ে খেলার সুযোগ পেলে তিনি কোথায় যেতেন কে জানে?
আর ক্লাইভ রাইস? নাহ, রাইস টেস্ট ক্রিকেট মিস করেননি, টেস্ট ক্রিকেটই এই অনন্য প্রতিভার ঝলক নিজের শতবর্ষী গায়ে মাখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পোলক অথবা রিচার্ডস তো তাও টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু রাইসের জীবনে সেই সুযোগটাও আসেনি। ৪৮২টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছিলেন, রান করেছেন ২৬০০০ এর উপরে। সাথে যোগ করুন ফাস্ট বোলিং এ নেয়া ৯৩০ টি উইকেট। বলা হয় ক্লাইভ রাইস টেস্ট খেলার সুযোগ পেলে ইয়ান বোথাম কিংবা ইমরান খান নয়, ঐ যুগের সেরা অলরাউন্ডার হিসাবে তাঁর নামই ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকতো!
এডি বারলোর কথাই বা বাদ থাকবে কেন? মাত্র ৩০ টেস্টের ক্যারিয়ার। তাতেই প্রায় ৪৬ এর মতো গড়ে করেছেন আড়াই হাজার রান। ছিলেন দুর্দান্ত ফিল্ডার। মাইক প্রক্টর? মাত্র সাত টেস্টের ক্যারিয়ার। কিন্তু শিকার করেছেন ৪১ উইকেট। প্রতিপক্ষকে নাকানি চুবানি খাইয়েছেন অসামান্য গতি দিয়ে। বোলিং এভারেজ ১৫ আর ইকোনমি রেট ২.৪৪ সেই সাক্ষ্যই তো দেয়। সাথে লোয়ার অর্ডারে নেমে ২৫ গড়ে করা ২২৬ রান যোগ করুন! কি অসামান্য বোলিং অলরাউন্ডার হবার প্রতিভাটাই না তাঁর ছিল! খেলার সুযোগ পেলে আজ ম্যাচ রেফারি হিসেবে শুধু নয়, ডেল স্টেইনদের পূর্বসূরী হিসেবে হয়তো তাঁর নামই আসতো!
দলটির অধিনায়ক আলী বাখের। এক ঝাঁক প্রতিভার নেতৃত্ব দেয়ার সকল ক্ষমতাই যে তাঁর ছিলো, তা পরবর্তীতে প্রশাসনিক দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ দিয়েই তিনি সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। আধুনিক ‘ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা’ গড়ে উঠার পিছনে তাঁর অবদান অসামান্য। ভাবুন তো একবার, এই দলটি যদি নিয়মিত খেলার সুযোগটা পেত তাহলে কি হতে পারতো? হয়তো প্রথম দুইটি বিশ্বকাপজয়ী হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম আসতো না। হয়তো অস্ট্রেলিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্য গোটা আশির দশক জুড়ে দেখতে হতো না। ক্রিকেট আরো রঙ পেতো, অন্যরকম থাকতো আজকের ক্রিকেট ইতিহাসটাও!
১৭. ‘রেবেল ট্যুর’
কাঁহাতক আর কতো সহ্য করতে পারবেন আপনি? আপনি ক্রিকেট খেলতে পারেন, আপনার শরীর জুড়ে এড্রেনালিনের নিঃসরণ, আপনার প্রতিভা আকাশ ছোঁয়া কিন্তু আপনি একই সাথে পঙ্গু! সেরা হতে পারতেন যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ ভাগ্যকে মেনে নিলেন। ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে মন দিলেন ডাক্তারিতে কেউ, কেউবা বনে গেলেন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। কেউ পাড়ি দিলেন অস্ট্রেলিয়ায়, কেউবা ইংল্যান্ডে। আর কয়েকজন ক্রিকেটকে ভালবাসে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই থেকে গেলেন।
বেলবটমস থেকে আসল স্বাভাবিক প্যান্টের যুগ। মিনিস্কার্টের দৈর্ঘ্য পৌছুঁলো হাঁটু পর্যন্ত। বাজারে আসলো নতুন জুতো ‘স্নিকার’। উত্থান হলো মাইকেল জ্যাকসনের, এক ‘থ্রিলার’ দিয়েই মাত করে দিলেন গোটা দুনিয়া। তখন ১৯৮২, নিষেধাজ্ঞার একযুগ পার হয়ে গিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট অন্ধকার কানাগলিতে পথ হাতরে বেড়াচ্ছে তখনো। রাজনৈতিক অস্থির পটভূমিকায় হারিয়ে যাচ্ছে খেলাধূলা। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষ নেমেছে রাজপথে, খেলার মাঠ তো তখন ঊষর প্রান্তর। শিশুরা খেলে না, খেলে যে কোন ভবিষ্যৎ নেই। ক্রিকেট বাঁচিয়ে রাখাই তখন দুস্তর মরু পাড়ি দেয়ার মত দুঃসাধ্য কাজ।
ক্রিকেট বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই দক্ষিণ আফ্রিকা ইংলিশ দলকে আমন্ত্রণ জানালো। তবে টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্যে নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশ্য ছিল আনফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচ খেলে হলেও দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ ফিরিয়ে আনা। ১৯৮২ সালেই প্রথম সফর করল ইংল্যান্ড। ১২ জনের দলটিতে ইয়ান বোথাম ছাড়া তখনকার সব ইংলিশ টেস্ট খেলোয়াড়রাই ছিলেন। সাংঘাতিক গোপনীয়তার মধ্যে ইংলিশ দল জোহানেসবার্গে পৌঁছুলো। এরপরই ফাঁস হল সফরের খবর। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার অনুগত সংবাদপত্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই এই সফরকে সাধুবাদ জানাচ্ছিল। কিন্তু গোটা বিশ্বের মতামত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ইংলিশ ‘হাউস অব পার্লামেন্ট’-ই এই সফরকারী দলের তীব্র নিন্দা করে নাম দেয় ‘দ্য ডার্টি ডজেনস’।
আইসিসি এই খেলোয়াড়দের তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। ক্রিকেট দুনিয়া ওলট-পালট করে দেয়া এই ঘটনায় ঐ দলের সাতজনেরই ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। এদের মধ্যে বিখ্যাত নাম হচ্ছে জেফ্রি বয়কটের। ঐ সময় তিনিই ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী।
আইসিসির এই কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও কিন্তু ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছে। শ্রীলঙ্কা তখন টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার জন্যে লড়ছে, এর ফাঁকেই গেল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়েছে, অস্ট্রেলিয়া পরপর দু'বছর সফর করেছে। শেষ সফরটি করেছে ইংল্যান্ড, ১৯৯০ সালে। অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের ঐ দলগুলো দেশের নাম নিয়ে খেলতে পারতো না। মূলত জাতীয় দলে খেলার সুযোগহীন খেলোয়াড়রাই এই সফরগুলোতে আসতেন। মূল দলে খেলা কেউই আইসিসির নিষেধাজ্ঞার ভয়ে আসতে চাইতেন না।
বিদ্রোহ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে এসে মৃতপ্রায় ক্রিকেটকে জাগিয়ে তোলার এই উদ্যোগকে কি সাধুবাদ জানাবেন? এই উদ্যোগের সমর্থন করলে কিন্তু আপনি অপমান করবেন বর্ণবাদবিরোধী যুদ্ধে লড়াই করা ওই সময়ের গণমানুষকে। ক্রিকেট কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলাই, জীবনের চাইতে সেটা কখনোই বড় হয়ে উঠতে পারেনা। এতো বছর পরেও তাই সেই সফরগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে, সফরকারী খেলোয়াড়দের আজও নীতিবিবর্জিত বলে গাল দেয়া হয়। আবার তারাই দক্ষিণ আফ্রিকায় ভূয়সী প্রশংসায় ধন্য হোন। বড়ই বৈচিত্র্যময় এই জীবন! বড়ই বৈচিত্র্যময়!
১৮. ক্রিকেট জগতে পুনর্বাসন
‘অকুলীন’ সেসব দিন শেষ হয়ে অবশেষে অবশ্য ‘শুভ্রতায় সমুজ্জ্বল’ দিন এসেছে। ক্রিকেট ফিরেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। রাজনৈতিক পটভূমি পালটে গেছে, নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরে জন্ম হয়েছে বর্ণবাদহীন দক্ষিণ আফ্রিকার। পতাকা বদলেছে, বদলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এসবের প্রেক্ষিতেই ১৯৯১ সালে আইসিসি নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়। ‘স্প্রিংবক’ দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট দল রূপান্তরিত হয় ‘মাইটি প্রোটিয়া’ দলে!
তখনও এই নভেম্বর মাস। সকালে মিষ্টি মিষ্টি শীতের আভাস। কোলকাতার রাস্তার মানুষ আর মানুষ। সবার হাতে দুটো পতাকা, একটা ভারতের আরেকটা দক্ষিণ আফ্রিকার। দুই গালে দুই দেশের রঙ, কন্ঠে ভ্রাতৃত্বের স্লোগান, হাতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্বাগতম জানিয়ে পোস্টার। ইডেন গার্ডেন তখন প্রকম্পিত। আর দক্ষিণ আফ্রিকান দল তখন ভালবাসায় উদ্বেলিত। ক্রিকেট কখনো কখনো কেবলমাত্র উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, আসল জয়গান তো মানবতার, বন্ধনের, ভালবাসার! কোলকাতাবাসী সেদিন পরম মমতায় দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে ফেরাকে বরণ করে নিয়েছিল। তখন থেকেই প্রোটিয়ারা ক্রিকেট শক্তি, ২২ বছরের নির্বাসন তাঁদের হারাতে পারেনি, মৃতপ্রায় ক্রিকেটকে আই.সি.ইউ থেকে তুলে এনে সেই দক্ষিণ আফ্রিকাই তাই আজ বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দল। যে দলে অশ্বেতাঙ্গ কারো জায়গা হতো না সেই দলেই এখন কালো-মুসলিম-শ্বেতাঙ্গ-বান্টু সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন। রংধনুর দেশটির ক্রিকেট দলটি আক্ষরিক অর্থেই এখন ভ্রাতৃত্বে গাঁথা।
***************
বাসিল ডি অলিভেইরার কথা শুনবেন না? তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া সেই ঘটনাপুঞ্জ নিয়েই তো এতোসব নাটক। তিনি পরবর্তীতে ইংল্যান্ডেই থিতু হয়ে যান। ২০০০ সালে ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা তাঁদের শতাব্দী সেরা ১০ জন ক্রিকেটারদের দলে তাঁকে স্থান দেয়, যদিও তিনি জন্মভূমির হয়ে একটি টেস্টও খেলেননি। ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া দক্ষিন আফ্রিকা-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজটারই নাম দেয়া বাসিল ডি’অলিভেইরা ট্রফি! ২০০৫ সালে রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে পান সম্মানসূচক উপাধি। আশৈশব বঞ্চিত অলিভেইরা প্রাচুর্য আর সম্মানের মধ্যে থেকে ২০১১ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এখন সবকিছু স্বাভাবিক। ক্রিকেট এখন শুধু ক্রিকেটীয় কারণেই খবর হয়। কিন্তু আফসোস কি এড়ানো যায়? ক্লাইভ রাইস, ব্যারি রিচার্ডস, মাইক প্রক্টর, গার্থ লে রুক্সদের বুকভরা আক্ষেপ এখনো তাই ওয়ান্ডারার্সের আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। শেষ বয়সে এসে কপর্দকহীন গ্রায়েম পোলকের অর্থের জন্য আকুতি তাই কেপটাউন, নাটালের পরতে পরতে কান্নার প্রতিধ্বনি তুলে। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুধু ক্রিকেটই যে নির্বাসিত হয়নি, হত্যা হয়েছে একঝাঁক স্বপ্ন, নষ্ট হয়েছে আদিগন্ত প্রতিভার সমাহার। বর্ণবাদের ওই যুদ্ধজয়ী হিসেবে তাই এই ক্রিকেটারদেরও নাম আসবে। সমস্ত ক্রিকেটপ্রেমীদের আফসোসভরা দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে দিয়েই তাঁরা বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
‘ভালবাসাহীন এই দিন সব নয়- শেষ নয়
আরো দিন আছে,
তাতো বেশি দূরে নয়
বারান্দার মতো ঠিক দরজার কাছে!’