বিদায়ের বিউগলে মাথা নিচু করেই ফিরছে বাংলাদেশ
পাকিস্তান ৫০ ওভারে ৩১৫/৯ (ইমাম ১০০, বাবর ৯৬, ইমাদ ৪৩; মোস্তাফিজ ৫/৭৫, সাইফ ৩/৭৭)
বাংলাদেশ ৪৪.১ ওভারে ২২১ অলআউট (সাকিব ৬৪, লিটন ৩২, মাহমুদউল্লাহ ২৯; শাহীন ৬/৩৫)
ফলঃ পাকিস্তান ৯৪ রানে জয়ী
ভেন্যু বদলাল, জার্সি বদলাল, কিন্তু বদলাল না গল্পটা। এক সাকিব আল হাসানের সওয়ার হয়ে আর কতই বা এগুনো যায়? অধিনায়কের বিদায়ী ম্যাচটাও তাই উজ্জীবিত করতে পারল না বাকিদের। বিশ্বকাপের শেষটা মাথা নিচু করেই হলো বাংলাদেশের, পাঁচ বছর পর পাকিস্তানের কাছে কোনো ওয়ানডে হারল তারা। পাওয়ার খুব বেশি কিছু ছিল না বাংলাদেশের, তবে হারানোর ছিল অনেক কিছু। শেষ ম্যাচে লড়াইও করতে পারেনি তারা, অনেক কিছু হারিয়েই দেশে ফিরছে বরং।
অথচ কাল থেকেই বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমে বয়ে যাচ্ছিল আবেগের একটা চোরাস্রোত। মাশরাফি বিন মুর্তজার বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ, টসের সময়ই যে কথাটা আরও স্পষ্ট করে বললেন। ভাগ্যটা অবশ্য আজও পক্ষে রইল না তার, বিশ্বকাপের শেষটাও হলো টসে হেরে। কিন্তু হারের জন্য সেটা একটা কারণ হতে পারে, দোষটা শেষ পর্যন্ত নিজেদের ঘাড়েই নিতে হবে বাংলাদেশের।
গল্পটা আসলে ঘুরেফিরে একই থাকল। মাশরাফি বল হাতে আরও একবার বিবর্ণ, আরও একবার ১০ ওভারের কোটা পূরণ করতে পারলেন না। প্রথম ১০ ওভারে অবশ্য বাংলাদেশ উইকেট পেয়েছে আজ, ফাখার জামানকে সাইফ উদ্দিনের আউট করাটা অনেকক্ষণ পর্যন্ত হয়ে ছিল বাংলাদেশের একমাত্র সাফল্য। এর পরই বাবর আজম ও ইমাম-উল-হক ধীরে ধীরে চড়ে বসলেন বোলারদের ওপর। আর বাংলাদেশের ফিল্ডাররাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
বোলিংয়ের হতশ্রী দশাটা এই বিশ্বকাপে সামনে এসেছে বার বার, তবে ফিল্ডিংয়ের এমন হালের জন্য কোনো অজুহাতই আসলে দাঁড় করানো যায় না। আজ অন্তত তিন বার বল হাত গলে চার হয়ে গেছে, আরও বেশ কয়েকবার হয়েছে মিসফিল্ডিং। সেখান থেকে অন্তত গোটা বিশেক রান বেশি দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে ক্যাচ মিসের মূল্য ছাড়িয়ে গেছে সবকিছুকে।
সেটার জন্য মোসাদ্দেক হোসেন আজ সবার আগে দাঁড় হবেন কাঠগড়ায়। ৫৭ রানে বাবর আজম সহজ ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন পয়েন্টে। কিন্তু সেটা হাতে জমাতে পারেননি তিনি। তার পরের ওভারেও একটা ক্যাচ বুঝতে পারেননি মুশফিক, বল তার পায়ে লেগে উলটো আহতই করেছে তাকে। জীবন পাওয়ার মূল্যটা সেঞ্চুরি করেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন প্রায় বাবর। ৯৬ রানে সাইফউদ্দিনের বলে আউট না হলে বাংলাদেশকে আরও বড় মূল্যই দিতে হতো।
মোস্তাফিজ নিজের প্রথম উইকেট পেয়েছেন খানিকটা পাকেচক্রে, তার বলে সেঞ্চুরি করে হিটউইকেট হয়েছেন ইমাম। শেষে বল না করলে তার জেগে ওঠা হয় না, আজও শেষে মোস্তাফিজ দুর্দান্ত। ৪২ ওভার শেষের আগে ২ উইকেটে ২৪৬ রান থেকে যে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত ৩১৫ রানে থামল, তাতে তারই কৃতিত্ব। তবে একদিক দিয়ে পাকিস্তানের তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি। ৭ উইকেট হারিয়েও শেষ ১০ ওভারে ঠিকই ৮৫ রান তুলেছে তারা। এর মধ্যে মোস্তাফিজ ফিরিয়েছেন হারিস সোহেল, শাদাব খান, মোহাম্মদ আমির ও ইমাদ ওয়াসিমকে। বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচে ৫ উইকেট পেয়েছেন, ২০ উইকেটও হয়ে গেছে। তবে সাইফ উদ্দিন ও মোস্তাফিজের মিলে ১৫০ রানের বেশি দেওয়াটা ভুলে যাওয়া যাবে না। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশ অন্য সব দলের চেয়ে এই বিশ্বকাপে বেশি উইকেট যেমন পেয়েছে, রানও দিয়েছে বেশি। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। ২৬ বলে ৪৩ রান করে আজ মূল সর্বনাশটা করেছেন ইমাদই।
এখানে অবশ্য মেহেদী হাসান মিরাজের নামটা ভুলে যাওয়া অন্যায় হবে। সবাই যখন বাজে লাইন লেংথে বল করে বাবরদের কাজ সহজ করে দিয়েছেন, মিরাজের ১০ ওভারে ৩০ রান দিয়ে ১ উইকেট নেওয়াটা রীতিমতো অলৌকিকই মনে হবে।
ব্যাটিংয়ের গল্পটাও অন্য সব ম্যাচের প্রায় কার্বন কপি। তামিম ইকবাল এবারের বিশ্বকাপে আরও একবার নিজের ছায়া হয়ে থেকেছেন। ২১ বলে ৮ রানে আউট হওয়ার আগে ধুঁকেছেন ভীষণ। সৌম্য সরকার তার মতোই শুরু করেছিলেন, আজ একটা জীবনও পেয়েছিলেন। কিন্তু আরও একবার শুরুটা থেমে গেছে বিশের ঘরে।
মুশফিকই এবারের বিশ্বকাপে অর্জুন সাকিবের পাশে ভীমের মতো একটু দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু আজ তিনিও ব্যর্থ, আউট মাত্র ১৬ রান করেই। লিটন শুরুটা পেয়ে গিয়েছিলেন, সাকিবের সঙ্গে তার জুটিটাই জমেছিল বেশি। কিন্তু ৩২ রানে স্লোয়ারে বোকা বনে তার উইকেটের সঙ্গে বড় একটা ধাক্কা খায় বাংলাদেশও।
সাকিব তখনও ছিলেন। এর মধ্যে টুর্নামেন্টে আরেকটি ফিফটি পেয়ে গেছেন। শচীন টেন্ডুলকার ও ম্যাথু হেইডেনের পর মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে এক বিশ্বকাপে ৬০০ রানও হয়ে গেছে। কিন্তু একা আর কতক্ষণ ভাঙা নৌকা নিয়ে দাঁড় বাওয়া যায়? ৬৪ রান করে শাহীন শাহ আফ্রিদির বলে তার আউটের সঙ্গে শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশের আশাও। মাহমুদউল্লাহ আর মোসাদ্দেক হোসেন লড়েছেন, কিন্তু সেটা শুধু হারের ব্যবধানটাই কমিয়েছে একটু। সাইফ উদ্দিন আজ আর ব্যাট হাতে কিছু করতে পারলেন না, শেষটাও তাই ভুলেই যেতে চাইবে বাংলাদেশ।