বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের রিপোর্টকার্ডে কে কত পেলেন
তিন জয়, পাঁচ হার, একটি পরিত্যক্ত। মোটা দাগে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন তাই ব্যর্থই। কিন্তু বিশ্বকাপ শেষে রিপোর্ট কার্ডে কোন ক্রিকেটার কত নম্বর পাবেন...
তামিম ইকবাল
৮ ইনিংসে ২৯.৩৭ গড়ে ২৩৫ রান
৩/১০
পরিসংখ্যান কখনো একটু বিভ্রান্তিকর। সংখ্যার হিসেবে এটা তামিমের সেরা বিশ্বকাপ, এর আগে এক টুর্নামেন্টে এত রান করতে পারেননি কখনোই। সংখ্যা বলছে, বাংলাদেশের ওপেনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রানও তার। ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৩৬, সেখানে বিশ্বকাপের গড়টা হতাশার হলেও কাগজে কলমে একেবারে শোচনীয় নয়। কিন্তু তামিম যেভাবে খেলেছেন, সেটা বিশ্বকাপ শেষেই ভুলে যেতে চাইবেন। গত চার বছরে দুর্দান্ত ফর্মটা টেনে নিয়ে আসতে পারেননি বিশ্বকাপে। শুরুতে রান না পাওয়ার কারণেই নয়, যেভাবে খোলসে ঢুকে ছিলেন সেটা তার পারফরম্যান্সকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তামিমের এবার স্ট্রাইক রেট ছিল ৭১.৬৪, অন্তত ২০০ রান করেছেন বিশ্বকাপে এমন ব্যাটসম্যানের মধ্যে শুধু শেই হোপ ও রহমত শাহর স্ট্রাইক রেট তার চেয়ে কম।
সৌম্য সরকার
৮ ইনিংসে ২০.৭৫ গড়ে ১৪৬ রান, ৪ উইকেট
৩/১০
শুধু ওপেনার হিসেবে সৌম্য এবারের বিশ্বকাপে একেবারেই ব্যর্থ। অনেক ম্যাচেই ভালো শুরু পেয়েছিলেন, কিন্তু ফিফটি করতে পারেননি একবারও। আট ম্যাচে সর্বোচ্চ রান ৪২ বলছে, সৌম্য সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি একেবারেই। অনেক ম্যাচেই ভালো খেলতে খেলতেও দিয়ে এসেছেন উইকেট। একটা ছাড়া বাকি ম্যাচে খেলেছেন ওপেনিংয়েই। তার সামর্থ্য নিয়ে সংশয় না থাকলেও ফোকাস আর টেম্পারামেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন আরও একবার। বল হাতে ৪ উইকেট নিয়েছেন, সেটাই এই বিশ্বকাপে একটু সান্ত্বনা হয়ে থাকবে সৌম্যর।
সাকিব আল হাসান
৮ ইনিংসে ৮৬.৫৭ গড়ে ৬০৬ রান, ৩৬.২৭ গড়ে ১১ উইকেট
১০/১০
বাংলাদেশের তো বটেই, এবারের বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সেরা পারফর্মার। যা করেছেন, ২২ গজে ব্যাট আর বল হাতে তার চেয়ে মিলিতভাবে বেশি কিছু করা খুব কঠিন। বিশ্বকাপে সাকিবের সর্বনিম্ন স্কোর ৪১ রান বলে দিচ্ছে কতটা স্বপ্নের সময় কাটিয়েছেন। বল হাতেও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবার পেয়েছেন ৫ উইকেট। এখন পর্যন্ত সাকিবের চেয়ে এক বিশ্বকাপে বেশি রানই আছে শুধু শচীন টেন্ডুলকার আর ম্যাথু হেইডেনের। সঙ্গে বোলিং যোগ করলে গ্রুপ পর্বে সাকিবের পারফরম্যান্স বিশ্বকাপের ইতিহাসেই সেরা কি না, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশ শেষ চারে উঠলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই টুর্নামেন্টসেরা হতেন। এখনও অবশ্য সাকিব টুর্নামেন্টসেরা না হলে সেটা তার জন্য খানিকটা দুর্ভাগ্যেরই হবে।
মুশফিকুর রহিম
৮ ইনিংসে ৫২.৪২ গড়ে ৩৬৭
৭.৫/১০
উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান মুশফিকের। নিজের ক্যারিয়ারে সেরা বিশ্বকাপ কাটিয়েছেন এবার, বিশ্বকাপের এক আসরে বাংলাদেশের হয়ে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন শুধু এবার সাকিব। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি সেঞ্চুরি করেছেন, তবে সম্ভবত আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটাই সেরা মুশফিকের। তারপরও নিজেও হয়তো পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারবেন না শেষ দিকের পারফরম্যান্সে। ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ন সময়ে রান আউট হয়ে যাওয়া তো আছেই, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে উইলিয়ামসনের সেই রান আউট মিস বহুদিন তাড়া করে বেড়াবে মুশফিককে। ব্যাট হাতে যেমনই হোক, গ্লাভস হাতে মুশফিক এই বিশ্বকাপটা তাই ভুলে যেতে চাইবেন। লেটার মার্কসটাও সেজন্য কমে যাচ্ছে দিন শেষে।
লিটন দাস
৫ ইনিংসে ৪৬ গড়ে ১৮৪
৬/১০
শুরুতে তিনটা ম্যাচে বসে ছিলেন, সেটা লিটন দাসের দুর্ভাগ্যই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৪ রানের দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেললেন, কিন্তু এরপর আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া গেল না লিটনকে। পরের চার ইনিংসে করলেন মাত্র ৯০, নেই একটি ফিফটিও। এবং বাজে বলে উইকেট দিয়ে আসার জন্য কিছুটা দায় নিতে হবে তাকেও। পাঁচে নেমে মানিয়ে নিয়েছেন মোটামুটি, শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিশ্বকাপটা গড়পড়তাই গেছে তার।
মাহমুদউল্লাহ
৬ ইনিংসে ৪৩.৮ গড়ে ২১৯ রান
৭/১০
ছয় নম্বরে নেমে খুব বেশি কিছু করার ছিল না। ছয় ইনিংসে মাত্র একটা ফিফটির কারণটাও অনুমেয়। এর মধ্যে ভারতের বিপক্ষে চোটের জন্য খেলতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দারুণ একটা ইনিংস খেলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটাও পরিস্থিতির বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর নিজের হতাশা থাকবে, তার যে ভূমিকা সেটা পুরোপুরি পালন করতে না পারায়। নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। সুযোগ ছিল ইনিংসটা বড় করার। সেই আক্ষেপ একটু হলেও থেকে যাবে।
মোহাম্মদ মিঠুন
৩ ইনিংসে ১৫.৬৬ গড়ে ৪৭ রান
৪/১০
তিন ম্যাচ দিয়ে একজন ব্যাটসম্যানের পারফরম্যান্স বিচার করা কঠিন। তবে মিঠুনের হতাশা থাকবে, নিউজিল্যান্ড সিরিজের রান বিশ্বকাপে টেনে নিয়ে আসতে না পারার জন্য। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভালো খেলতে খেলতে আউট হয়ে যাওয়ার হতাশা থাকবে। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোনো রান করতে না পারার মাশুল দিতে হয়েছে দল থেকে বাদ পড়ে।
সাব্বির রহমান
২ ইনিংসে ৩৬ রান
৪/১০
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রান করতে পারেননি। তবে সেই ম্যাচে তার ক্যাচ মিসের মাশুল দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে অবশ্য খারাপ করেননি।
মোসাদ্দেক হোসেন
৬ ইনিংসে ১১৭ রান, ৩ উইকেট
৫/১০
মোসাদ্দেকের ভূমিকা ছিল বাকিদের চেয়ে অন্যরকম। ফিনিশার হিসেবে সাতে খেলা, আর সঙ্গে রানের লাগাম আটকে বোলিং করা। দুই ভূমিকায় কিছুটা সাফল্য আর কিছুটা ব্যর্থতা পেয়েছেন। সাত নম্বরে নেমে নিশ্চয় ফিফটি বা সেঞ্চুরি করা কঠিন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে মোসাদ্দেকের ইনিংস ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আবার ভারত, পাকিস্তান বা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যর্থ হয়েছেন। স্পিনারদের জন্য কঠিন কন্ডিশনে বল হাতেও ঠিক সেভাবে কিছু করতে পারেননি, যদিও পার্ট টাইমের চেয়ে অনেকটা বেশিই বল করতে হয়েছে তাকে।
সাইফ উদ্দিন
৭ ম্যাচে ৩২.০৭ গড়ে ১৪ উইকেট , ৫ ইনিংসে ২৯ গড়ে ৮৭ রান
৭/১০
সাইফ উদ্দিনের বোলিংটা সংখ্যা দিয়ে মাপলে বিভ্রান্ত হবেন। বিশ্বকাপে এবার সবচেয়ে বেশি ইয়র্কার দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে এক বিশ্বকাপে তার চেয়ে বেশি উইকেট শুধু এবার মোস্তাফিজেরই। আবার এটাও ঠিক, বিশ্বকাপে অন্তত ১০ উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্যে সাইফ উদ্দিনের ইকোনমি রেটই সবচেয়ে খারাপ। শুধু বোলিং হলে অবশ্য গড়পড়তার বিশ্বকাপই বলা যেত। তবে ভারত ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে যেভাবে ব্যাট করেছেন, তাতে ব্যাট হাতেও নিজের দারুণ সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন। সঙ্গে ফিল্ডিংয়েও চিনিয়েছেন নিজেকে। সাইফ উদ্দিন তাই লেটার মার্ক না হলেও খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
মেহেদী হাসান মিরাজ
৭ ইনিংসে ৫৬.৮৩ গড়ে ৬ উইকেট
৬/১০
পরিসংখ্যান বলবে, মিরাজের বিশ্বকাপটা কেটেছে জঘন্য। তবে নিজের ভূমিকার কথা বললে মিরাজ অনেকটাই সফল। এই বিশ্বকাপে সাকিব ছাড়া বাংলাদেশের আর কেউ হৃদয় দিয়ে খেলার কথা বললে মিরাজের নাম আসবে শুরুর দিকেই। রান আটকে রাখার যে কাজ, সেটা করেছেন ভালোমতোই। বাংলাদেশের সব বোলারের মধ্যে ওভারপ্রতি সবচেয়ে কম রান দিয়েছেন মিরাজ, অন্তত ৬ উইকেট পাওয়া স্পিনারদের মধ্যে মিরাজের ইকোনমিই সবচেয়ে ভালো।
মাশরাফি বিন মুর্তজা
৮ ম্যাচে ৩৬১ গড়ে ১ উইকেট
১/১০
বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বকাপের ইতিহাসেই মাশরাফির চেয়ে বাজে বোলিং অন্তত পরিসংখ্যানের বিচারে আর কারও নেই। এমন দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপও আগে হয়নি বাংলাদেশ অধিনায়কের, এই বিশ্বকাপে ১০ ওভার কোটা পূরণ করতেই পেরেছেন মাত্র একটি ম্যাচে। অধিনায়কত্ব শুরুর দিকে ভালো হলেও শেষ দিকে শরীরী ভাষাও খুব ইতিবাচক ছিল না তার।
রুবেল হোসেন
২ ম্যাচে ১৩১ গড়ে ১ উইকেট
৪/১০
সুযোগ পেয়েছেন মাত্র দুই ম্যাচে, সে হিসেবে পারফরম্যান্স যাচাই করা কঠিনই। তবে সেই দুই ম্যাচেও নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮৩ রান দিয়ে উইকেটবিহীন ছিলেন, ভারতের বিপক্ষে ৪৮ রান দিয়ে পেয়েছেন একটি উইকেট।
মোস্তাফিজুর রহমান
৮ ম্যাচে ২৪.২ গড়ে ২০ উইকেট
৭.৫/১০
এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট তার। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তো বটেই, বিশ্বকাপেই এক আসরে এর চেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার কীর্তি আছে আর মাত্র ১২ বার। তবে পরিসংখ্যান বলছে না, নতুন বলে কোনো উইকেটই নেই তার, যদিও সেজন্য ক্যাচ মিসের দায় আছে। অন্তত ১৫ উইকেট যারা নিয়েছেন, এর মধ্যে ট্রেন্ট বোল্টের গড়ই মোস্তাফিজের চেয়ে কম। ৬.৭ ওভারপ্রতি রানও খুব পক্ষে নেই। সংখ্যা যতটা মনে করাচ্ছে, মোস্তাফিজের বিশ্বকাপ তাই উজ্জ্বল নয় ততটা।
আবু জায়েদ রাহী
একটি ম্যাচও খেলেননি বিশ্বকাপে।
দল হিসেবে ফিল্ডিং
৩/১০
দল হিসেবে ফিল্ডিংয়ে এবার বাংলাদেশ দলের জন্য ছিল ভুলে যাওয়ার মতো। আটটির মতো ক্যাচ মিস হয়েছে, তার চেয়েও বাজে ছিল গ্রাউন্ড ফিল্ডিং। শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো এক দুইটি ম্যাচ বাদ দিলে ফিল্ডিং বাংলাদেশকে ভুগিয়েছে কমবেশি সব ম্যাচেই।