কিক অফের আগে: শিরোপার সঙ্গে ব্রাজিলের লক্ষ্য সমর্থকদের ভালোবাসাও ফিরে পাওয়া
কবে কখন
ব্রাজিল-পেরু
কোপা আমেরিকা ফাইনাল; মারাকানা; ৮ জুলাই, রাত ২টা
১৯১৯, ১৯২২, ১৯৪৯, ১৯৮৯। এবারের আগে চারবার কোপা আমেরিকার আয়োজক ছিল ব্রাজিল, প্রতিবারই শেষ হাসি হেসেছে তারা। এবারও ফেভারিট হিসেবেই টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল নেইমারবিহীন ‘সেলেসাও’রা, সব বাধা টপকে মারাকানায় ফাইনালও খেলবে তারা। কিন্তু তারপরও কেন যেন সমর্থকদের প্রত্যাশার পারদ মেটাতে পারেনি তিতের দল। প্রতিপক্ষ পেরু; উরুগুয়ে, চিলির মত দলকে বিদায় করে যারা ৪৪ বছর পর খেলতে নামছে কোপার ফাইনালে। ২০১৬ সালে এই পেরুর কাছে হেরেই কোপার গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ‘সেলেসাও’রা। ব্রাজিলের কাছে এবারের গ্রুপপর্বেই ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল তারা। পুরো টুর্নামেন্ট চমক উপহার দেওয়া পেরুর সামনে সুযোগ, ১৯৫০-এর মারাকানাজোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনা।
ব্রাজিলের জন্য ফাইনাল জয়টা শুধুই একটা শিরোপার লড়াই নয়, সমর্থকদের মন জয় করে নেওয়ারও পরীক্ষা। ২০০৭ সালের পর আর কোপা জেতা হয়নি ব্রাজিলের। দুইটি কনফেডারেশনস কাপ জিতলেও, সেগুলোর মুল্য ব্রাজিলিয়ানদের কাছে কমই। আর গত চার বিশ্বকাপে ধারাবাহিক ব্যর্থতাও যোগ হয়ে ব্রাজিলিয়ানদের হতাশা বেড়েছে আরও। তাই এবারের কোপা জিতে নিজ দেশের সমর্থকদের খুশি করাও বড় দায়িত্ব হয়েছে দাঁড়িয়েছে দানি আলভেজদের।
পেরুর কাছে ওই হারের পর কোচ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিতে। দুঙ্গার রক্ষণাত্মক ব্রাজিলকে খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন তিনি, ফিরিয়ে এনেছিলেন সাম্বার আক্রমণাত্মক নৃত্য। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ আট থেকে বিদায় নেওয়ার পর দায়িত্ব হারানোর আশঙ্কাও জেগেছিল তিতের। এবারের টুর্নামেন্টে শুরুটাও ভাল হয়নি ব্রাজিলের। প্রথম দুই ম্যাচেই নিজ সমর্থকদের থেকে শুনতে হয়েছিল দুয়ো। টুর্নামেন্টে এখনও গোল খায়নি ব্রাজিল, প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়েছে ১০বার।
বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে দুয়ো শুনে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পরও ব্রাজিল কোচ ভালমতই জানেন; এক যুগ পর লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করতে না পারলে হয়তো দুঙ্গার ভাগ্যই জুটবে কপালে, "এবারের টুর্নামেন্টে আমরা এখনও নিজেদের সেরাটা দিতে পারিনি। সমর্থকদের দুয়ো আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার। বলিভিয়া ম্যাচ থেকে আর্জেন্টিনা- আমাদের পারফরম্যান্সের উন্নতির অন্যতম কারণ তারাই। পেরুকে আমরা টুর্নামেন্টে আগে একবার হারালেও ফাইনালের আগে কেতাবী পরিসংখ্যানের কোনও ভিত্তি নেই। প্রতি-আক্রমণে তারা দুর্দান্ত। পেরুর বিপক্ষে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।" কোচের সাথে একমত মিডফিল্ডার কাসেমিরোও, 'গ্রুপপর্বে কী হয়েছে সেটা ফাইনালের আগে কোনওভাবেই প্রভাব ফেলবে না। সেবার বড় ব্যবধানে জিতলেও ফাইনালে কোনও গোলউৎসব হবে না। পেরুকে হারানো বেশ কষ্টসাধ্যই হবে ফাইনালে।'
১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে তার গোলেই বিদায় নিয়েছিল পেরু। বিশ্বকাপে ফিরতে এরপর তিন যুগ লেগেছিল পেরুর, কাকতালীয়ভাবে সেটাও হয়েছিল রিকার্ডো গারেচার অধীনেই। একসময় পেরু সমর্থকদের চক্ষুশূল এখন তাদের কাছে ‘ন্যাশনাল হিরো’। কিন্তু গারেচা মনে করেন; কৃতিত্ব তার নয়; বরং তার স্কোয়াডের, "আসলে কোচ যত ভালোই হোক, ফুটবলাররা নিজেদের প্রমাণ করতে না পারলে কোনও লাভ নেই। রাশিয়া বিশ্বকাপে আমরা ফ্রান্সকে কাঁপিয়েই দিয়েছিলাম। এবার ব্রাজিলের কাছে হারের পর ছেলেরা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা আসলেই প্রশংসনীয়। উরুগুয়ে, চিলির বিপক্ষে আমরা নিজেদের প্রমাণ করেই ফাইনালে এসেছি, ভাগ্যের জোরে নয়।"
স্ট্রাইকারদের ফর্মহীনতা নিয়ে গত প্রায় বছরখানেক বেশ ভুগতে হয়েছে ব্রাজিলকে। কিন্তু এবারের কোপায় নিজেদের চিনিয়েছেন রবার্তো ফিরমিনো এবং গ্যাব্রিয়েল হেসুস। এতদিন দুজনকে রোটেট করে খেলিয়েছিলেন তিতে, কিন্তু এবার দুজনকেই নামিয়েছেন একসাথে। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে তাদের বোঝাপড়াও দারুণ। আর্জেন্টিনা ম্যাচে ফিরমিনোর গোল এসেছে হেসুসের পাসে, হেসুসের গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন ফিরমিনো। আক্রমণে ছন্দ খুঁজে পাওয়া ব্রাজিলের রক্ষণভাগ ফর্মে আছে আগে থেকেই। অ্যালিসনই তাই বড় নায়ক। এবারের টুর্নামেন্টে কোনও গোল খাননি আলভেজ-সিলভারা। ব্রাজিলের সামনে সুযোগ উরুগুয়ে (১৯১৭, ১৯৮৭), আর্জেন্টিনা (১৯২১), কলম্বিয়ার (২০০১) পর পুরো টুর্নামেন্টে গোল না খেয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। মাঝমাঠে কাসেমিরো, আর্থারের ‘ডাবল পিভোট’-এর কারণে মাঝমাঠে ‘ফ্রি রোল’-এ নিজের সেরাটা দিতে পারছেন ফিলিপ কুতিনিয়ো। বাঁ-প্রান্তে এভারটনও আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। সব মিলিয়ে ফাইনালের আগে সাম্প্রতিক সময়ের সেরা ফর্মেই আছে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ভাগ্যের জোরে নয়, নিজেদের প্রমাণ করেই ফাইনালে এসেছে ব্রাজিল।
ব্রাজিলের মত নিজেদের প্রমাণ করার চেয়ে এতদূর আসতে পারার পেছনে পেরুর ভাগ্য সাহায্য করেছে দারুণ। প্রতিপক্ষ পেরু এতদূর আসার স্বপ্নও হয়তো দেখেনি। গ্রুপপর্বের সেরা দুই তৃতীয় দলের একটি হয়ে শেষ আটে এসেছিল তারা। উরুগুয়ের বিপক্ষে পেরুর জালে তিনবার বল পাঠিয়েছিল সুয়ারেজ-কাভানিরা, ‘ভিএআর’-এ বাতিল হয়েছে তিনটিই। টাইব্রেকারে উরুগুয়েকে হারানোর পর শেষ চারে পেরুর প্রতিপক্ষ ছিল চিলি, কোপার শেষ দু’বারের চ্যাম্পিয়ন। সেমিতে অবশ্য ভাগ্যের জোরে নয়, নিজেদের প্রমাণ করেই ফাইনালে এসেছে গুরেরোরা। সানচেজদের ৩-০ গোলে হারিয়ে ৪৪ বছর পর কোপার ফাইনাল নিশ্চিত করেছে গারেচার দল।
ব্রাজিলের মতই ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলে থাকে পেরু। দুই উইংয়ে এডিনসন ফ্লোরেস এবং আন্দ্রে কারিওর গতি সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেয়েছে চিলি। ফাইনালে ব্রাজিলের আক্রমণ সামলাতে মাঝমাঠে রেনাটো তাপিয়া এবং ইয়োশমার ইয়োতুনের ‘ডাবল পিভোট’-এর উপর দায়িত্বটা বেড়ে যাবে অনেকটাই। কারণ পুরো টুর্নামেন্টে নিজেদের রক্ষণ বেশ ভুগিয়েছে পেরুকে, কেবল গ্রুপপর্বেই ৬ গোল হজম করেছে তারা। আক্রমণের চেয়ে প্রতি-আক্রমণ নির্ভর পেরুর লক্ষ্য থাকবে ব্রাজিলের বিপক্ষে লিড নেওয়া। কারণ পিছিয়ে পড়লে রক্ষণের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে গারেচার দলকে, সেক্ষেত্রে ব্রাজিলের ব্যবধান বাড়ানোর সম্ভাবনাও হয়তো বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।
দলের খবর
ফাইনালের আগে ইনজুরি নিয়ে বেশ ভাবতে হচ্ছে ব্রাজিলকে। উরুর মাংশপেশির ইনজুরিতে পেরুর বিপক্ষে থাকছেন না উইলিয়ান, মাম্পসের জন্য অনিশ্চিত রিচার্লিসনের খেলাও। সেক্ষেত্রে আক্রমণে আবারও হেসুস-ফিরমিনো-এভারটনের উপরই ভরসা রাখবেন তিতে। ফিটনেস নিয়ে সংশয় আছে ফিলিপে লুইসেরও, সেক্ষেত্রে রক্ষণের বাঁ-প্রান্তে আবারও দেখা যাবে অ্যালেক্স সান্দ্রোকে। মাঝমাঠে কুতিনিয়োর সাথে থাকবেন কাসেমিরো এবং আর্থার মেলো।
পেরুর হয়ে থাকছেন না ফরোয়ার্ড জেফারসন ফারফান। টুর্নামেন্টে তার জায়গায় নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেছেন এডিনসন ফ্লোরেস।
সম্ভাব্য একাদশ
ব্রাজিল (৪-২-৩-১): অ্যালিসন; আলভেস, সিলভা, মার্কিনহোস, লুইস; কাসেমিরো, আর্থার; হেসুস, কুতিনিয়ো, এভারটন; ফিরমিনো
পেরু (৪-২-৩-১): গালিসি; আদভিঙ্কুলা, জাম্ব্রানো, আব্রাম, ট্রাউকো; ইয়োতুন, তাপিয়া; ফ্লোরেস, কুয়েভা, কারিও; গুরেরো
সংখ্যায় সংখ্যায়
- পেরুর বিপক্ষে খেলা ৪৫ ম্যাচে মাত্র ৪বার হেরেছে ব্রাজিল (৩২ জয়, ৯ ড্র)
- ব্রাজিলের বিপক্ষে পেরুর ৪ জয়ের ৩টিই এসেছে কোপা আমেরিকায়
- দু’বার কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেলেছে পেরু, জিতেছে দু’বারই (১৯৩৯, ১৯৭৫)
- এবারের কোপায় সেরা রক্ষণ এবং সেরা ফরোয়ার্ড লাইন- দুটিই ব্রাজিলের
প্যাভিলিয়ন প্রেডিকশন: ব্রাজিল ৩-০ পেরু