কোপা পেরিয়ে ব্রাজিলের চোখ এখন কাতারে
মাউন্ট করকোভাদোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ক্রাইস্ট, দ্য রিডিমারের গায়ে ব্রাজিলের পতাকার রঙ চড়েছে। রিও ডি জেনিরোতে তার আগে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। মারাকানায় কোপা আমেরিকার ফাইনাল জেতার পর যেই উৎসব ছড়িয়ে গেছে পুরো ব্রাজিলে। এক যুগের অপেক্ষা অবসান হয়েছে ব্রাজিলিয়ানদের, অবশেষে আরেকবার দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পেরেছে তারা।
রিও ডি জেনিরোকে সার্বক্ষণিক পাহারা দেওয়া ক্রাইস্ট ব্রাজিলের রঙে আবৃত হতে পারতেন আরও আগে। ২০১৪ বিশ্বকাপে সেবার জার্মান পতাকার তেরঙ্গা সাজে সেজেছিলেন ক্রাইস্ট। ব্রাজিলের অপেক্ষা ঘোচেনি সেবার, আক্ষেপ জুটেছিল বদলে। ১৯৫০ এর মারাকানাজো এর মতো আরেকটি ‘কুখ্যাত’ ইতিহাসের সাক্ষী হতে থাকতে হয়েছে ব্রাজিলকে। মিনেইরোজো নাম হয়ে গেছে যেটার।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আর এলোমেলো ব্রাজিলকে সেই স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বহুদিন। এরপরের দুই বছর আরও দুইবার কোপা আমেরিকা খেলেছিল ব্রাজিল। একবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়, পরের বার গ্রুপপর্বই পেরুতে পারেনি পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ফাইনালে যে পেরু ছিল প্রতিপক্ষ তাদের কাছেই হেরে কোপা আমেরিকা সেন্টানারিওর গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ব্রাজিল। তখনকার কোচ কার্লোস দুঙ্গারও সেটাই ছিল শেষ, এরপরই তিতে যুগের শুরু।
গত বছর ঠিক একই দিনে বেলজিয়ামের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে ব্রাজিল বাদ পড়েছিল রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে। ততোদিনে দারুণ একটি দল দাঁড়িয়ে করে ফেলেছিলেন তিতে। তবে গোলের সামনে ভুগছিলেন নেইমাররা। গ্যাব্রিয়েল হেসুসকে নিয়মিত খেলিয়ে রবার্তো ফিরমিনোকে দ্বিতীয় পছন্দের স্ট্রাইকার হিসেবে রেখেছিলেন তিতে। বেলজিয়ামের কাছে হারের পর তিতে বলেছিলেন, সিদ্ধান্ত বদলাতে একটু দেরিই করে ফেলেছেন তিনি। আক্ষেপটা থাকবে, কিন্তু এখান থেকেই আরও শিখতে চান বলে জানিয়েছিলেন।
তিতেকে ভুল থেকে শেখার সুযোগটা করে দিয়েছিল ব্রাজিল। ভরসা রেখেছিল তার ওপর। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়ের পরও তোড়জোড় করেনি ব্রাজিল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তার পেছনে অবশ্য একটা যৌক্তিক কারণ ছিল। এক বছর পর কোপা আমেরিকা, সেটাও ঘরের মাঠে। তিতের অধীনে বিশ্বকাপ পর্যন্ত ব্রাজিল হেরেছিল দুইটি ম্যাচ, তার মধ্যে একটি বেলজিয়াম। তিতেকে রাখার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও ছিল।
ব্রাজিলের এই দলের খেলা দেখে হয়ত সোনালী সময়ের কথা মনে পড়ে না আপনার। কিন্তু গোলরক্ষক থেকে শুরু করে স্ট্রাইকার পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি পজিশনে ব্রাজিলের আছে একাধিক বিশ্বসেরা খেলোয়াড়। এরপরও দলটাকে এক সুরে বাধতে হত। মানসিকভাবে শক্তির সঞ্চার করতে হত। ব্রাজিল যে শেষ পর্যন্ত কোপার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল দলের এই ভারসাম্য।
গোলরক্ষক হিসেবে অ্যালিসন খুব সম্ভবত এখন বিশ্বসেরা। ব্রাজিলের ডিফেন্স দলের মূল ভিত্তি। আপনার ইন্টারমিডিয়েটের বইগুলোর মতো। ওসব পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু টিউশনিতে যাওয়ার আগে একবার চোখ বুলিয়ে যেতে হয় আবার। নিজের পরীক্ষার আগে ইন্টিগ্রেশনে আটকে গেলেও সূত্রগুলোতেও একটু চোখ বুলিয়ে নিতে হয়। এরপর পার পেয়ে যান নিমিষেই। ওই বইগুলোর ওপর আপনার যতখানি নির্ভরতা, ব্রাজিলের রক্ষণের ওপর গোটা দল নির্ভর করে আরও বেশি।
থিয়াগো সিলভা আর মার্কিনহোস দুইজন ক্লাবেও খেলেন একসঙ্গে। দুইজনই বল প্লেয়িং ডিফেন্ডার। ব্রাজিলের আক্রমণে বিল্ডআপেও থাকে তাদের বড় ভূমিকা। স্থিতিশীল রক্ষণ যে ব্রাজিল পাবে সেটা জানাই ছিল। দুই ফুলব্যাককে তিতে খেলিয়েছেন ইনসাইড রোলে। তাতে আক্রমণে দুই উইংয়ে থাকা খেলোয়াড়দের সঙ্গে দারুণ সমন্বয় তৈরি করেছে ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই। আর ব্রাজিলের প্রায় প্রতিটি গোলের উৎসও ওই হাফ স্পেস আর ওয়াইড স্পেস কাজে লাগানোর দক্ষতার ফসল।
দানি আলভেজের কথাই ধরা যাক। তিতে গত বছর পর্যন্তও দলের অধিনায়কত্ব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিন, চারজনকে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। সেখান থেকে সরে গিয়ে বিশ্বকাপের পর নেইমারকে পাকাপাকিভাবি অধিনায়কের দায়িত্ব দেন। কোপা আমেরিকার কয়েকদিন আগে আবারও নেইমার ইস্যু, নেইমার শিরোনাম হলেন কারণে-অকারণে। নেইমারকে আড়াল করতে ৩৬ বছর বয়সী আলভেজকে তিতে দিলেন অধিনায়কের দায়িত্ব। আলভেজ প্রথম কয়েক ম্যাচে ছিলেন গড়পড়তা, কিন্তু নক আউট পর্ব থেকে ঝুলিতে থাকা অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে দিলেন। সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার ডিফেন্স লাইন ভেঙে চুরে ঢুকে গেলেন, ডানদিকে দিলেন পাস। গ্যাব্রিয়েল হেসুস ছিলেন ডান প্রান্তে, তার ক্রস থেকে এভারটনের গোল। আলভেজ কাজের সময়ে জ্বলে উঠেছিলেন ফাইনালেও। পেরুর বিপক্ষে প্রথম গোলের বিল্ডআপও আলভেজের পাসেই শুরু হয়েছিল। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, মনোযোগ আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার চিরাচরিত রসিকতা মাঠে ব্রাজিলকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। সমর্থকদের দুয়ো বা স্বাগতিক হওয়ার চাপ- কোনোকিছুই ভাঙতে পারেনি ব্রাজিলের মনোভাবকে।
ব্রাজিলের এই দলে উন্নতির জায়গা আছে আরও। মিডফিল্ডে আর্থার খেলেছেন প্রত্যাশামতো। তবে কাসেমিরো ক্লাবে লুকা মদ্রিচ, টনি ক্রুসদের সঙ্গে যতখানি কার্যকর, ব্রাজিলে ঠিক ততোখানি নন। এখানে ভাবার আছে ব্রাজিলের। ফিলিপ কুতিনিয়োর প্রথমদিকে দলের হাল ধরেছিলেন, তবে নিজের সেরাটা খেলতে পারেননি। তার অবস্থা আপনার হাঁটুর কাছে ছেঁড়া জিন্স প্যান্টের মতো। আত্মীয়-স্বজনের সামনে ওই প্যান্ট পরে যাবেন, আড় চোখে তাকাবেন তারা। কিন্তু বন্ধুমহলে আবার প্রশংসিত হবে হয়ত। কুতিনিয়োর দরকার সঠিক লোক। নেইমার সঙ্গে থাকলে তার খেলার ধার বাড়ে আরও। কোপায় তাই মোটামুটি পাস মার্ক পেয়ে যেতে পারেন কুতিনিয়ো।
তবে টুর্নামেন্ট থেকে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে ফিরমিনো-হেসুসের সমন্বয়। হেসুস প্রথম দুই ম্যাচে একাদশে ছিলেন না। এরপর নিজের স্বাভাবিক পজিশনেও খেলেননি তিনি। কিন্তু ফিরমিনোর সঙ্গে জায়গা সুইচ করে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের হাপিত্যেশ তুলে দিয়েছেন তিনি প্রায় প্রতি ম্যাচেই। আগের বিশ্বকাপে গোলখরার মধ্যে দিয়ে যাওয়া হেসুসের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবারের কোপা আমেরিকার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দুই গোল করেছেন, একটি সেমিফাইনালে, আরেকটি ফাইনালে। গোলের হিসেবে নয়, সার্বিক বিচারে হেসুস প্রমাণ করতে পেয়েছেন নিজেকে।
ব্রাজিলের এই স্কোয়াডে একমাত্র ব্রাজিলিয়ান লিগে খেলা খেলোয়াড় ছিলেন এভারটন। ২৩ বছর বয়সী গ্রেমিও স্ট্রাইকার অবশ্য এরপর আর কতদিন ব্রাজিলে থাকবেন সেটা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই ইউরোপের বড় ক্লাবগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে এভারটনকে। তার গতি আছে, বলের ওপর দারুণ নিয়ন্ত্রণও আছে। আর ফরোয়ার্ড হয়েও আছে গেম রিড করতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা। প্রথম দুই ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমেছিলেন। প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত এক গোল করলেন। পেরুর বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচ থেকে একাদশে জায়গা পাকা হলো তার। সে ম্যাচেও ওই বাম দিক থেকে কাট করে ডান পায়ের দুর্দান্ত গোলে প্রথম ম্যাচের কথা মনে করিয়ে দিলেন আরেকবার।
কোপা শুরুর কয়েকদিন আগে ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে গিয়েছিলেন নেইমার। তার জায়গাতেই খেলেছেন এভারটন। গত কয়েক বছরে নেইমার কাজের চেয়ে অকাজে বেশি শিরোনাম হয়েছেন তিনি। যেখানেই নেইমার, সেখানেই যেন বিতর্ক। বিতর্ক হয় পিছু নিয়েছে তার, নইলে ডেকে এনেছেন নিজেই। কোপার আগে নেইমার বাদ পড়ায় অবশ্য একরকম সুবিধাও হয়েছে তিতের। অযাচিত কারণে চাপ বাড়েনি তার দলের ওপর। এভারটনও তার অভাব খুব একটা বুঝতে দেয়নি। কিন্তু সেরা অবস্থায় থাকা নেইমারকে খুব বেশি করেই দরকার ব্রাজিলের। দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বই ব্রাজিলের কাছে সব নয়। লক্ষ্য বিশ্বকাপ। রোনালদিনহো, রোনালদো, রিভালদোরা এখন আর একসঙ্গে খেলেন না। একাই ব্যবধান গড়ে দেওয়ার মতো খেলোয়াড় এখন ব্রাজিলের আছেন কেবল নেইমারই। তিতে অবশ্য বরাবরই নেইমারকে বাঁচিয়ে আসছেন। অনেকটা সন্তানের মতোই। মাঝেসাঝে তাঁকে উপদেশ বা পরামর্শও দিয়েছেন। এখন নেইমার নিজেকে কতখানি বদলাবেন সেটা তার ওপরই। নইলে আরও একটি দুর্দান্ত প্রতিভা ব্রাজিলের নষ্ট হবে শূন্য হাত ফিরেই।
কোপায় ব্রাজিলের জয়টা অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। ছিল ভয় জয় করার। বরং শিরোপা না জিতলেই সেটা হত দুর্যোগ। এই ব্রাজিলের খেলায় হয়ত মন ভরেনি আপনার। সেমিফাইনাল, ফাইনালে ব্রাজিলের আধিপত্য না দেখে কিছুটা হতাশও হতে পারেন। রূপকথার ব্রাজিলের মতো সাম্বার ছন্দে ঘাটতি থাকলেও সময়ে সময়ে এই দলও আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারে পুরনো দলের কথা। একালের ব্রাজিল আর সেকালের ব্রাজিল একটা জায়গায় কিন্তু এখনও আবার এক- ম্যাচে আধিপত্য থাকুক না থাকুক, ফল বের করে এনে দেবে তারা। এই দলের সবচেয়ে বড় পুঁজি ভারসাম্য। তিলে তিলে গড়ে তোলা তিতের দলের ভারসাম্য নাটকীয় কিছু না হলে খুব তাড়াতাড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই। এরপর শুধু পোলিশ করতে হবে, ঝকঝকে-তকতকে বানাতে হবে।
২০১৪ সালে যেদিনে জার্মানির কাছে সেমিফাইনালে নাস্তানাবুদ হয়েছিল, ২০১৮ তে যেদিন বেলজিয়ামের কাছে হেরেও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল- ঠিক সেদিনেই ব্রাজিল আবার শুরু করল নতুন পথে হাঁটা। এবার মিনেইরোজোর দুঃখ ম্লান হয়েছে ব্রাজিলিয়ানদের। এই একযুগে ব্রাজিলের ঝুলিতে ছিল কেবল দুইটি কনফেডারেশনস কাপ। আর ২০১৪ এর সেমিফাইনালের পর নতুন করে আবেগ, উৎকণ্ঠা ভেসে বেড়িয়েছিল এতদিন ব্রাজিলের আকাশে বাতাকে। তাই বলিভিয়ার বিপক্ষে গোলশুন্য প্রথমার্ধ শেষেও সমর্থকদের দুয়োর রোল ওঠে মাঠে। সাওপাওলো বা মিনেইরো, মারাকানা বা গ্রেমিও যে মাঠেই ব্রাজিল খেলেছে সেখানেই ব্রাউনিয়ান মোশনে ঘুরে বেড়িয়েছে উৎকণ্ঠা। আপাতত কোপা আমেরিকা জিতে সমর্থকদের ধাতস্থ করতে পেরেছে ব্রাজিল। তিতে আরেকটু সময় কিনে নিতে পেরেছেন। সামনের বছরের মার্চ থেকে শুরু বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। আর লক্ষ্যও তো সেটাই। বাছাইপর্ব উতরানো নয়, শিরোপা। বিশ্বকাপ।