অসিদের দর্প-চূর্ণ করেই ফুরোল ইংলিশদের অপেক্ষা
অস্ট্রেলিয়া ৪৯ ওভারে ২২৩ অলআউট (স্মিথ ৮৫, ক্যারি ৪৬, স্টার্ক ২৯; ওকস ৩/২০, রাশিদ ৩/৫৪, আর্চার ২/৩২ )
ইংল্যান্ড ৩২.১ ওভারে ২২৬/২ (রয় ৮৫, রুট ৪৯, মরগান ৪৫, বেইরস্টো ৩৪; কামিন্স ১/৩৪)
ফলঃ ইংল্যান্ড ৮ উইকেটে জয়ী
অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শেষদিকে টিভিতে নিশ্চয় একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ আপনার কান এড়িয়ে যায়নি। এজবাস্টনের ওপর আবার বোমা টোমা পড়ল না তো? সেরকম কিছু না, তবে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবিতে ব্যানার নিয়ে উড়ে গিয়েছিল চারটি বিমান। কে জানে, ভালো করে তাকালে দেখা যেত কোনো একটা বিমানে হয়তো ‘গড সেভ দ্য কুইনও’ লেখা ছিল!
এজবাস্টনের আকাশে সূর্য মেঘের ফাঁক থেকে দেখা দিয়েছে কমই। তবে আকাশের মতো বার্মি আর্মির মুখ গোমড়া থাকেনি। ক্রিকেট নামের খেলার জন্ম দিয়েছে যারা, তারাই এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ পায়নি কখনো। সেটা দূরে থাক, ১৯৯২ সালের পর থেকে ফাইনালেই তো ওঠা হয়নি কখনো। এরপর রঙিন পোশাকে ইংল্যান্ডের মনে রাখার মুহূর্ত এসেছে খুব কম। এই ইংল্যান্ড গত চার বছরে যেভাবে খেলেছে, তাদের নিয়ে আশায় বুক বাঁধার লোকের অভাব ছিল না। অবশেষে শেষ পর্যন্ত তারা সন্তর্পণে বলতে পারছে, ইটস কামিং হোম।
ফর্ম আর ইতিহাস, সবকিছু ছিল অস্ট্রেলিয়ার পক্ষেই। এই ইংল্যান্ডকেই হারিয়েছে গ্রুপ পর্বে, সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বকাপে তারা কখনো সেমিফাইনালেই হারেনি। তার ওপর মহামূল্যবান টসও যখন জিতেছিল, অস্ট্রেলিয়ার পক্ষেই আপনি হয়তো বাজি ধরবেন। কিন্তু স্রেফ ওই পর্যন্তই। এরপর অস্ট্রেলিয়া আর কিছুই মিলল না।
একটু ভুল বলা হলো, ওকসের প্রথম বলেই চার মেরে ওয়ারনার সাময়িক একটা আশা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পরের ওভারেই অ্যারন ফিঞ্চ জফরা আর্চারের বলে এলবিডব্লু হয়ে ফিরে গেলেন প্রথম বলেই। ওয়ার্নারও ওকসের পরের ওভারে ক্যাচ দিলেন স্লিপে, আর হ্যান্ডসকম বলের লাইন মিস করে বোল্ড। ১৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ওখানেই আসলে ব্যাকফুটে চলে গেছে অস্ট্রেলিয়া।
এরপর রান করার জন্য রক্তই ঝরাতে হয়েছে তাদের। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই। আর্চারের একটা বাউন্সারে হেলমেটই খুলে গিয়েছিল পাঁচে উঠে আসা অ্যালেক্স ক্যারির, থুতনিতে পরে নিতে হয়েছে সেলাই। রক্তও ঝরেছে একটু, সেটা আসলে প্রতীক হয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রামেরও। স্মিথ আর ক্যারিকে প্রতিটা রানের জন্য আসলেই লড়াই করতে হয়েছে। তারপরও একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছিলেন দুজন, শত রানের জুটিও হয়ে গিয়েছিল।
সব এলোমেলো হয়ে গেল ক্যারি মনযোগ হারালে। রাশিদের বলটা উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছিলেন ভিন্সকে, এবার আর ক্যারি করতে পারলেন না। স্টোয়নিসের দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ শেষ হলো আজও, দ্বিতীয় বলেই এলবিডব্লু হয়ে গেল। এক ওভারে দুই উইকেট নিয়ে রাশিদ চেহারা বদলে দিলেন ম্যাচের। ১১৮ রানে ৫ উইকেট নেই অস্ট্রেলিয়ার।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের কিছু করার দরকার ছিল আজ, পুরো টুর্নামেন্টে মলিন থাকার শাপমোচন হয়ে যেত। শুরুটা পেয়ে গিয়েছিলেন, রাশিদকে উড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের প্রথম ছয়ও মেরেছেন। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণটা মিলল না আজও, আর্চারই করলেন সর্বনাশ। নাকল বলটা বুঝতে পারেননি ম্যাক্সি, ক্যাচ দিয়েছেন শর্ট কাভারে। ২২ রানে আউট হয়ে গেলেন, অস্ট্রেলিয়ার বড় স্কোরের আশা ওখানেই শেষ।
স্টিভ স্মিথ এক প্রান্ত থেকে বিহবল হয়ে দেখছিলেন সতীর্থদের আসা যাওয়া। টুর্নামেন্টে বিগ ফোরের বাকিদের সঙ্গে একই উচ্চতায় আসবেন, সেই আভাসও দিচ্ছিলেন ব্যাটে। কিন্তু একা একা আর কি কিছু করা যায়? শেষ পর্যন্ত সঙ্গী পেলেন মিচেল স্টার্কে। দুজন মিলে অষ্টম উইকেটে যোগ করলেন ৫১ রান, কিন্তু সেটা ভাঙল ম্যাচের সবচেয়ে জাদুকরী মুহূর্তে।
সিঙ্গেল নেওয়ার জন্য দৌড়েছিলেন স্মিথ, পৌঁছেও যেতেন ঠিকঠাক। কিন্তু গ্লাভস খুলে বাটলার করলেন দুর্দান্ত একটা থ্রো। স্মিথের দুই পায়ের ফাঁক গলে অবিশ্বাস্যভাবে সেটা ভেঙে দিল স্টাম্প। ৮৫ রানে আউট স্মিথ, অস্ট্রেলিয়া এরপর যোগ করতে পারল মাত্র ৬ রান। ২২৩ রান যথেষ্ট নয় অবশ্যই, তবে নকআউট বলেই হয়তো একটু আশা ছিল।
কিন্তু সেটা খান খান করে দিতে সময় নেননি জেসন রয় ও জনি বেইরস্টো। প্রথম কয়েকটা ওভারই কেবল দেখে শুনে খেলেছিলেন দুজন। মিচেল স্টার্ক আজ তার লাইন লেংথ বা ইয়র্কার, কিছুই খুঁজে পাননি। নতুন বলে জেসন বেরেনডর্ফ পাননি বিপদে ফেলার মতো সুইং। প্যাট কামিন্সও দিতে পারেননি ব্রেকথ্রু। স্টিভ স্মিথ এসে এক ওভারে দিয়েছেন ২১ রান। রয়কে আজ আসলে আটকাতে পারেনি কিছুই। বেইরস্টো এক প্রান্ত থেকে দেখেছেন, কীভাবে অসি বোলিংকে ছিড়েখুড়ে টেমস নদীতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত স্টার্ক এসে আউট করেছেন বেইরস্টোকে, তবে তার আগে ইংল্যান্ড করে ফেলেছে ১২৪ রানই। এই আউটেই এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ড হয়ে গেছে স্টার্কের।
জেসন রয়কে থামানোর জন্য অবশ্য অন্যরকম কিছুই দরকার ছিল। কামিন্স সেটা করেছেন, তবে সেটার জন্য দরকার হয়েছে চূড়ান্ত সৌভাগ্য। লেগ সাইডে বলটা পুল করার চেষ্টা করেছিলেন রয়, আপিল করলেন কামিন্স। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আঙুল তুলে দিলেন ধর্মসেনা।, রয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, রিভিউ শেষ হয়ে যাওয়ায় নেওয়ার উপায়ও নেই। মাথা নাড়তে নাড়তেই মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হলো।
তাতে অবশ্য ইংল্যান্ডের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। আফসোসও করতে হয়নি। রুট আর অধিনায়ক মরগান মিলে ঠিক করেছিলেন, খেলা শেষ করে দেবেন দ্রুতই। ২৩ থেকে ২৮ পর্যন্ত প্রতি ওভারেই হয়েছে বাউন্ডারি। ১২.৩ ওভারে দুজনের অবিচ্ছিন্ন ৭৯ রানের জুটিতে তাই জয় নিশ্চিত করেই ফিরেছে ইংল্যান্ড। আর তাতে ফুরিয়েছে ২৭ বছরের অপেক্ষাও।