• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    'বিগ বেন' স্টোকস ও তার দায়মোচনের প্রহর

    'বিগ বেন' স্টোকস ও তার দায়মোচনের প্রহর    

    বেন স্টোকস ব্যাটে লাথি মারছেন। 

    হাত থেকে একটু আগে ফেলে দিয়েছেন সেটা, যেন ভার নিতে পারছেন না আর। তার অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল, মিচেল স্টার্কের সে ইয়র্কারটা কেমন ছিল। আর সবাইকে বাদ দিয়ে, আর সব মুহুর্ত বাদ দিয়ে তাকেই এই সময়েই বেছে নিতে হবে সেই ডেলিভারিটার? এমন প্রশ্নের জবাব মেলে না। স্টোকস হাত থেকে তাই ব্যাট ফেলে দেন। লাথি মারেন। কী করলে হতাশাটা কমবে, বুঝে উঠতে পারেন না। 

    লর্ডস, লন্ডন।

    শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হোঁচট খাওয়া ইংল্যান্ডের ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। নিশ্চিতভাবেই অস্ট্রেলিয়া ও জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে স্টোকস। লন্ডনের বিখ্যাত ওই ঘড়ি ‘বিগ-বেন’-এর মতো করে। এরপরই স্টার্কের সেই ডেলিভারি। স্টোকস শূন্যহাতে ফিরলেন, তার ৮৯ রান পার্থক্য গড়তে পারলো না। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল তাকে। মার্ক উডের শুধু একটা ডেলিভারি আটকে দিয়ে স্টোকসকে স্ট্রাইকটা ফিরিয়ে দিতে হতো পরের ওভারে। উড করতে পারলেন না। স্টোকস ইংল্যান্ডকে পার করাতে পারলেন না। বিগ-বেনের মতো করে দাঁড়িয়ে থাকলেন শুধু। 

    **** 

    স্টোকসের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারতো ২০১৬ সালে। কলকাতায়। 

    ১৯ রান ডিফেন্ড করতে এসেছিলেন শেষ ওভারে। তার ইয়র্কারগুলি ইঞ্চি-ব্যবধানে শর্ট হয়ে যাওয়ার শাস্তি কার্লোস ব্রাথওয়েট নামের একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান দিলেন টানা চার ছয় মেরে। এর চেয়ে নির্মম কোনও কিছু বোধহয় একজন বোলারের কিছু হতে পারে না। জো রুট সেদিন সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে। সেটা সেদিন যথেষ্ট হয়নি হয়তো স্টোকসের। 

    স্টোকসের ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে যেতে পারতো ২০১৭ সালে। 

    ব্রিস্টলের এক পানশালার বাইরে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন অ্যালেক্স হেলস। হাঙ্গামার মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। সতীর্থরা যখন অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়া সফরে, স্টোকস তখন নিউজিল্যান্ড গেছেন ক্যান্টারবেরির হয়ে খেলতে, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে। সহ-অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন এর আগেই। দলেই জায়গা নেই, আর সহ-অধিনায়কত্ব! স্টোকস ইংল্যান্ডের সে দলের ক্ষ্যাপাটে একজন। 

    দলে ফিরলেন নিউজিল্যান্ড সফরে, ৫ টেস্ট ও ১১টি সীমিত ওভারের ম্যাচ মিস করার পর। 
     


    অদ্ভুতুড়ে সেই ছয় রানের পর ক্ষমা চাচ্ছেন স্টোকস


    ভারতের বিপক্ষে এজবাস্টন টেস্টের চতুর্থ দিন করলেন টানা বোলিং। বিরাট কোহলির প্যাডে আছড়ে পড়ছিল তার বল, অবশেষে তাকে করলেন এলবিডব্লিউ। শেষটাও করলেন তিনি ভারতের লেজ ছেঁটে দিয়ে। তবে এরপরই তাকে ছুটতে হলো ব্রিস্টলে। আদালতে যে তার মামলার শুনানি আছে!

    স্টোকসের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ এনেছিলেন, যারা সাক্ষী ছিলেন, তারা কেউই তাকে চিনতেন না। তবে সংবাদমাধ্যমে স্টোকসের এই খবর ছাপা হলো ফলাও করে। এক সমকামী যুগলকে স্টোকস বরং বাঁচিয়েছিলেন বলেই বের হলো পরে। তবে পেশাদার কোনও স্পোর্টসম্যানের অত রাতে অমন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়াটা নিশ্চয়ই কাজের কথা নয়! 

    মামলা থেকে মুক্তি পেলেও ইসিবির অভ্যন্তরীণ তদন্তের মুখোমুখি হতে হলো তাকে। সেখানে অবশ্য পার পেয়ে গেলেন জরিমানা দিয়েই। এর আগেই স্টোকস কাটিয়েছেন তার অস্বস্তির ১৫ মাস। তার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে তার তখনকার স্পন্সর। 

    ব্রিস্টল তাকে ছেড়ে যায়নি। তার মতে, এ জীবনে সেটা ছেড়ে যাবে না তাকে। এরপর থেকে তিনি পরিবর্তিত একজন। রাতে বাইরে যান না, যা পার্টি তা হোটেলেই করেন। মাথা ঠান্ডা রাখতে শিখেছেন। 

    **** 

    ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে গল্পের শেষ নেই। কারও বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। কেউ মদ্যপ জীবনে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন। কেউ আছেন মুসলিম, উদযাপনে শ্যাম্পেন থেকে গা বাঁচিয়ে চলেন। ইসলামে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। কেউ এসেছেন ছোট কোনও শহর থেকে। কেউ এসেছেন অন্য দেশ থেকে, ক্রিকেট খেলবেন বলে। কেউ জন্ম নিয়েছেন অন্য দেশে, কেউ বেড়ে উঠেছেন অন্য কোথাও। 

    তাদের সবাইকে এক করেছে ক্রিকেট। আর ইংল্যান্ড দলটা। 
     

    অধিনায়ক মরগানের কাছে এই দলের সবচেয়ে বড় শক্তির নাম বেন স্টোকস। ১৩ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছিলেন বাবা-মার সঙ্গে। বাবা ছিলেন নিউজিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক রাগবি লিগের প্লেয়ার। ছোটবেলায় ক্রিকেট স্টোকসের কাছে ছিল ক্ষ্যাপাটেপনার একটা ব্যাপার। যা নিয়ে মাতামাতি করা যায়। উচ্ছ্বাসে ভাসা যায়। সেই ক্রিকেটেই নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে পেরে খুশি ছিলেন তিনি। 

    কলকাতা পেছনে ফেলে এসেছেন। আসতে পেরেছেন। পেছনে ফেলে আসতে পেরেছেন ব্রিস্টলকে, অন্তত মনে হয় সেরকমই। এ বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডের চার বছরের সাধনার, কঠোর পরিশ্রমের। অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের, তবে তারা অটুট ছিলেন নিজেদের পরিকল্পনায়। বিশ্বাস রেখেছিলেন নিজেদের ওপর। 

    সেসবের জাজমেন্ট ডে এসে হাজির হলো লর্ডসে। ১৪ জুলাই। রবিবার। 

    ****

    ‘হোপ ইজ আ গুড থিং। মে বি দ্য বেস্ট অফ থিং। অ্যান্ড নো গুড থিং এভার ডাইজ।’ 

    হয়তো স্টোকসের আশা ফুরিয়ে যায়নি কলকাতার পর। ব্রিস্টলের পর। 

    স্টোকস আশা করে ছিলেন হয়তো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই ম্যাচে। সে আশা টেকেনি। এজবাস্টনে ভারতের বিপক্ষে তার ৫৪ বলে ৭৯ রানের ইনিংস এগিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচে তেমন কিছু করতে পারেননি, সেমিফাইনালে করা লাগেনি। তবে লর্ডসে তাকে প্রয়োজন ছিল ইংল্যান্ডের।

    ফাইনালের দিন ‘ফ্রি-টু-এয়ার’-এ ক্রিকেট ফিরল ১৪ বছর পর। ইংল্যান্ড ক্রিকেটে সুপারস্টার বলতে ছিলেন ইয়ান বোথাম। ছিলেন অ্যান্ড্রিউ ফ্লিনটফ। ১৯৮১ আর ২০০৫ এর অ্যাশেজে তাদের টিভিতে দেখেছিল ইংল্যান্ড। এরপর একটা শূন্যতা। ইংল্যান্ডের সুপারস্টার নেই। জাতীয় হিরো নেই ক্রিকেটে। 

    লর্ডসের উইকেটটা কৌশলি। এমন উইকেটে ইংল্যান্ড এ টুর্নামেন্টে ধুঁকেছে। নিউজিল্যান্ডের ২৪১ রানের স্কোরটাও তাই মালগাড়ির মতো লম্বা ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন-আপের কাছে হয়ে পড়লো হেঁটে হেঁটে ঢাকা-দিনাজপুরের পথ পাড়ি দেওয়ার মতো কঠিন এক ব্যাপার। 


    কলকাতা, ২০১৬


    জস বাটলারের টাইমিং হয়তো আপনার প্রেমিকার মুখের কথার চেয়েও বেশি মোলায়েম। বাটলার টাইমিং করতে থাকলেন। স্টোকস ইনিংসে টাইমিংয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। মুখ কামড়ে পড়ে থাকা যেন। যে প্রজন্ম অনেকদিন পর ইংল্যান্ডের টেলিভিশনে সরাসরি ক্রিকেট দেখছিল, তাদের মনে হওয়া স্বাভাবিক, ক্রিকেট বোধহয় তেমনই আছে, যেমনটি তারা গল্প শুনেছেন। 

    ক্যাচিংয়ে এদিন অতিমানবীয় ছিল নিউজিল্যান্ড। বদলি ফিল্ডার টিম সাউদিই বা ব্যতিক্রম হবেন কেন। বাটলারের মিসটাইমিংয়ে ওঠা কঠিন ক্যাচটা সহজ করে ধরলেন তিনি। থাকলেন শুধু স্টোকস। আর টেইল-এন্ডার। ইংল্যান্ডের টেইল-এন্ডাররা ব্যাটিং পারেন, তাদের স্ট্রাইক রেট বা পরিসংখ্যান সেটার প্রমাণ দেয়। তবে এ বিশ্বকাপে ঠিক কাজের সময় জ্বলে উঠতে পারেননি তারা। তাদেরকে টেনেছেন স্টোকস। আরেকবার সেই দায়িত্ব তার ওপর। 

    তবে ততক্ষণে লড়াইটা ‘বিগ-বেন’-এর মতো দাঁড়িয়ে থাকা নয়। শেষ ৫ ওভারে ৪৬ রান। ইংল্যান্ড ও বিশ্বকাপের মাঝে ব্যবধান। স্টোকস ও ঐশ্বর্যের মাঝে ব্যবধান। অথবা স্টোকস ও সেই নিকষ আঁধারের মাঝে ব্যবধান। 

    ****

    ট্রেন্ট বোল্ট প্রথম দুই বলই করলেন ব্লকহোলে। অফসাইডে ইনফিল্ড ছাড়িয়ে যেতে পারলেন না স্টোকস। শেষ বলে ১৫ রানের কঠিন লক্ষ্য। তৃতীয় বলটা স্টোকস প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগে পাঠালেন স্ট্যান্ডে। পরের বলেও ছয়। তবে সেটি ছাড়িয়ে গেল সবকিছুকে। 

    আপনার কল্পনাতেও হয়তো ছিল না এমন কিছু। স্টোকস নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি। গাপটিলের থ্রো ডাইভ দিয়ে বাঁচার চেষ্টায় থাকা স্টোকসের ব্যাটে লাগবে, এরপর হবে চার। এমন কিছু চিন্তা করতে পারলে আপনার কল্পনাশক্তি প্রখর, আপনার সেটি কাজে লাগানো উচিৎ। 


    লর্ডস, ২০১৯


    অদ্ভুত এই ঘটনার পর স্টোকস দুই হাত তুলে ক্ষমা চাচ্ছিলেন যেন নিউজিল্যান্ডের কাছে। পরে বলেছেন, আজীবন উইলিয়ামসনের কাছে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে যাবেন, অথচ গাপটিলের থ্রোয়ের দিকে না তাকিয়েই ডাইভ দিয়েছিলেন তিনি! আদিল রাশিদ স্টোকসকে বুঝাচ্ছিলেন মাথা ঠান্ডা রাখতে। তবে স্টোকস তখন যেন অন্য জগতে। ২ বল, ৩ রান- স্টোকস ও বিশ্বকাপের মাঝে ব্যবধান। মিডল স্টাম্পের ইয়র্কার খেলে টেক-অফ করতে গড়বড় হয়ে গেল তার, মোমেন্টাম ধরে রাখতে পড়েই গিয়েছিলেন প্রায়। রাশিদ নিজের উইকেটটা স্যাক্রিফাইস করলেন। 

    পরের বলে লো ফুলটস। স্টোকস ঝুঁকিটা নিলেন না। মিড-অনের দিকে খেলে ডাবলস নিতে চাইলেন। উড আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন, তবে ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারলেন না নন-স্ট্রাইক প্রান্তে। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ফাইনালে সুপার ওভারের নিয়ম রেখেছিল আইসিসি, এবার সেটি গেল সেই সুপার ওভারেই। 

    স্টোকস ব্যাটে একটা লাথি মারলেন। হতাশায়। বিশ্বকাপটা না জেতানোর হতাশায়। উড সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে। 

    **** 

    সুপার ওভারে জস বাটলার নামবেন, সেটা একরকম নিশ্চিতই। তবে এমন একটা ইনিংসের পর স্টোকস কি আবার নামবেন? নাসের হুসেইন কমেন্ট্রিতে সমাধান দিলেন, সাহস থাকলে একবার গিয়ে স্টোকসকে বলেই দেখুন না না নামার কথা! মরগান ড্রেসিংরুমে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, স্টোকস নামবেন কিনা।

    স্টোকস নামলেন, তবে গ্লাভস বদলানোর কথা মনে পড়লো মাঠে ঢোকার আগমুহুর্তে। ওপর থেকে হয়তো ফেলে দেওয়া হলো সেটা। বাটলারের সঙ্গে মিলে সুপার ওভারে বোল্টের কাছ থেকে তুললেন ১৫ রান। যে ১৫ রান ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ নিশ্চিত করতে পারতো মূল ম্যাচেই। 

    জফরা আর্চারে ভরসা রাখলো ইংল্যান্ড। স্টোকস এসে তাকে বললেন, যেটাই ঘটুক, এ মুহুর্তটা তার ক্যারিয়ার নির্ধারণ করতে পারবে না। শেষ ওভারে মোটামুটি বড় একটা সংগ্রহ ডিফেন্ড করতে না পারার অভিজ্ঞতা স্টোকসের চেয়ে ভালো (বাজে) আর কার আছে! 

    আর্চার নিশামের বলে ছয় খেলেন, তবে ভরসা রাখলেন নিজের স্কিলের ওপর। শেষ বলে ২ রান, মুহুর্তটা নিজের করে নিতে পারতেন গাপটিল। গাপটিল অবশ্য বড় শটের দিকে গেলে না। সে ওভারেই মিসফিল্ড করা রয় থ্রোটা করলেন নিখুঁত। বাটলার বলটা ধরতে ভুল করলেন না। 

    আর্চার ওদিকে গিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করছেন এরপর। জেসন রয় কাঁদছেন। অইন মরগান ছুটছেন। সবাই ছুটছেন। জো রুট কাঁধে উঠে পড়েছেন জনি বেইরস্টোর। স্টোকস শুয়ে পড়েছেন। এরপর ছুটেছেন আর্চারের দিকে। 

    স্টোকস একটু পর গিয়ে নিয়েছেন ফাইনালের ম্যাচসেরার পুরস্কার শচীন টেন্ডুলকারের কাছে। যেদিন স্টোকসকে খুব করে প্রয়োজন ছিল ইংল্যান্ডের, সেদিন তিনি দাঁড়িয়ে গেছেন বিগ-বেনের মতো। লর্ডসে এদিন কলকাতা, ব্রিস্টলের দায়মোচন হয়েছে তার। 

    তিনি বনে গেছেন ইংল্যান্ডের জাতীয় হিরো।