• " />

     

    সেই সব ম্যাচ- ১ : “দুই সেরার এক ধ্রুপদী লড়াই”

    সেই সব ম্যাচ- ১ : “দুই সেরার এক ধ্রুপদী লড়াই”    

    ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই। বিশ্বকাপে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ের খেলা চলছে। জিতলে তো কথাই নেই, ড্র করলেও কাপ ব্রাজিলের। অপরদিকে উরুগুয়েকে জিততেই হবে। খেলায় তখন ১-১ সমতা। খেলার ৭৯ মিনিটে ২ লক্ষ ধারণক্ষমতার মারাকানা স্টেডিয়ামকে স্তব্ধ করে দিলেন ২৪ বছরের এক তরুণ। তরুণের নাম অ্যালসিডেস ঘিঘিয়া। তাঁর জয়সূচক গোলেই ব্রাজিলকে কাঁদিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বসেরার ট্রফি হাতে তুললো উরুগুয়ে।

     

    বছরখানেক পরের কথা।

     

    ইউরোপে তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাঙ্গেরির সোনালী প্রজন্ম। মাঠের খেলার কারণে যাদের ডাকা হচ্ছে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স। দলের নেতা ব্যাকব্রাশ করা চুলের খাটো এক ভদ্রলোক। নাম ফেরেঙ্ক পুসকাস। নিকনেম গ্যালোপিং মেজর।

     

    ১৯৫২ সালের ২ আগস্ট। ফিনল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের ফাইনালে মুখোমুখি হলো হাঙ্গেরি আর যুগোস্লাভিয়া। হাঙ্গেরি কি পরিমাণ বিধ্বংসী ছিল তা বোঝা যাবে একটা তথ্যেই। সেমিফাইনাল পর্যন্ত মোট চার ম্যাচে তাঁরা গোল করেছিলো ১৮টি। যুগোস্লাভিয়াও কম ছিল না কোন অংশে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত হাঙ্গেরির চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলে তাঁরা গোল করে ২৬ টি। যার মধ্যে ছিল ভারতের সাথে ১০-১ গোলের বিশাল জয় আর শক্তিশালী রাশিয়ার সাথে ৫-৫ গোলের ড্র। হাঙ্গেরিকে যদি কেউ থামাতে পারতো, তবে সেটা একমাত্র সম্ভব ছিল যুগোস্লাভিয়ার পক্ষেই। ফাইনালে ৭০ মিনিট পর্যন্ত হাঙ্গেরিকে ঠেকিয়ে রেখেছিলো যুগোস্লাভিয়া। তারপরেই গোলমুখের ফাঁস খুলে ফেলেন অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাস। ৮৮ মিনিটে জিবর দ্বিতীয় গোল করলে অলিম্পিকের সোনাজয়ী দলের নাম হয় হাঙ্গেরি।

     

    এরপরে কেটে গেলো প্রায় ২ বছর।

     

    ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপের ৫ম আসর বসলো সুইজারল্যান্ডে। ৪ বছর আগের বিশ্বকাপজয়ী উরুগুয়ে দল তখন আরও পরিণত। দলে এসেছেন অবদুলিও ভারেলা নামের একজন খেলোয়াড়। আর হাঙ্গেরির অবস্থা তখন “মাঠে নামো, প্রতিপক্ষকে ছিঁড়ে ফেলো, ম্যাচ জেতো” টাইপের। গ্রুপ পর্ব আর কোয়ার্টার ফাইনাল পেরিয়ে এই দুই দলের দেখা হলো সেমিফাইনালে। সৃষ্টি হলো শতাব্দীর সেরা এক স্মরণীয় ম্যাচের উপাখ্যান। হাঙ্গেরির পক্ষে তখন তাঁদের সাম্প্রতিক ফর্ম আর উরুগুয়ের পক্ষে বিশ্বকাপে কখনো তাঁদের না-হারার ইতিহাস। দুই দলই মাঠে নেমেছিলো তাঁদের সেরা খেলোয়াড়টিকে ছাড়া। ইনজুরির কারণে খেলেননি হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাস আর উরুগুয়ের অবদুলিও ভারেলা।

     

    পুসকাস না থাকাতে হয়তো ম্যাগিয়ার্সদের মনে একটু হলেও ভয় কাজ করছিল। সে ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কাজটি শুরু করেন জোলটান জিবর। ১২ মিনিটে গোল করে দলকে লিড এনে দেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই অসাধারণ এক হেডে ব্যবধান ২-০ করেন ন্যান্দোর হিদেকুটি। পুসকাস না থাকায় হাঙ্গেরির তেমন কোন সমস্যা না হলেও ভারেলা না থাকায় উরুগুয়ের আক্রমণগুলো গোলে রূপান্তরিত হচ্ছিলো না।

     

    গ্রীস এবং ট্রয়ের যুদ্ধে দেবরাজ জিউস প্রথমদিকে দুপক্ষকেই সাহায্য করছিলেন। কিন্তু শেষে এসে তিনি গ্রীকদেরকেই সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক তেমনি এই ম্যাচের শুরু থেকে ভাগ্যদেবী হাঙ্গেরিকে সাহায্য করলেও খেলার শেষদিকে তিনি উরুগুয়ের দিকে মুখ ফেরান। তাইতো হুয়ান হোবার্গ নামক এক আর্জেন্টাইন (হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন) দশ মিনিটের মধ্যে ২ গোল করে সমতা ফিরিয়ে ফেললেন।

     

    পিছিয়ে পড়েও সমতা এনে উরুগুয়ে তখন রীতিমতো উড়ছে। হাঙ্গেরির তখন ভগ্নদশা। কিন্তু ভাগ্যদেবীর আরও ‘রসিকতা’ বাকি ছিল। খেলার এক্সট্রা টাইমে উরুগুয়ের হুয়ান শিয়াফিনোর শট বারে লাগে। উরুগুয়ে আরও সমস্যায় পড়ে যখন ডিফেন্ডার ভিক্টর আন্দ্রাদে অসুস্থ হয়ে সাইডলাইনে চলে যান। এ সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করেননি চতুর স্ট্রাইকার স্যান্ডোর ককসিস। ১০৯ এবং ১১৭ মিনিটে ২ গোল করে উরুগুয়ের কফিনে শেষ পেরেক মেরে হাঙ্গেরিকে ফাইনালে নিয়ে যান তিনি।

     

    এ পরাজয় ছিল বিশ্বকাপে উরুগুয়ের প্রথম পরাজয়। ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার ২৪ বছর পরে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পায় তাঁরা। খেলা শেষ হওয়ার পরে হাঙ্গেরির কোচ গিয়ুলা ম্যান্ডি বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত যতগুলো দলের মুখোমুখি হয়েছি তাদের মধ্যে উরুগুয়েই ছিল সেরা।” পরিসংখ্যান বলবে, এই ম্যাচে জয়ী দলের নাম হাঙ্গেরি আর পরাজিত দলের নাম উরুগুয়ে। কিন্তু এই ম্যাচে আসল জয়ীর নাম তো ফুটবল।

     

    এই ম্যাচের পরের ম্যাচেই হাঙ্গেরির প্রায় ৪ বছরের জয়যাত্রায় ছেদ টেনে দেয় পশ্চিম জার্মানি। হাঙ্গেরির কি দুর্ভাগ্য! ম্যাচটা ছিল বিশ্বকাপ ফাইনাল। পরবর্তীতে যে ম্যাচের নাম হয়ে যায় “মিরাকল অব বার্ন।”