ঘরের তারারাই জ্বলছে বিপিএলে
সকালে পুরনো ঢাকার এক গলির মোড়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসতেই কানে এলো কথাটা, “কুমিল্লার রনির জাতীয় দলে চান্স নিশ্চিত...”, বলছিলেন দোকানি নিজেই। টং দোকানের সামনের ভিড় থেকে মোহাম্মদ শহীদ, আল-আমিন হোসেনদের নামও নিলেন কেউ কেউ। জাতীয় দলের সিংহভাগ ব্যাটসম্যানের নিষ্প্রভতা, মাশরাফির চোট নিয়ে খেলে যাওয়া, মোহাম্মদ আমিরের বলে পাকিস্তানের তিন তারকার ঘায়েল হওয়া, এক ম্যাচে সুযোগ পেয়েই ‘বহুজাতিক বাঙালি’ তরুণ নিখিল দত্তর ঝলক দেখানো, বিদেশী তারকারা কে কেমন করলেন...মিনিট দশেকের আলোচনায় বিপিএলের ছোটখাটো একটা ‘রিভিউ’ই শোনা হয়ে গেলো।
পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পরও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের তৃতীয় আসর যে ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশীদের আগ্রহ পুরোপুরি দমিয়ে দিতে পারে নি সেটা বোধকরি পথেঘাটে এমন খণ্ড খণ্ড আলাপচারিতাতেই স্পষ্ট। তথাপি মাঠের পারফরম্যান্সে টিটোয়েন্টি ক্রিকেটের এই ঘরোয়া আয়োজনকে কতোটা আলোকিত করতে পেরেছেন দেশী-বিদেশী তারকারা? সম্ভাবনাময় নবীনরাই বা কতটুকু সম্ভাবনার জানান দিতে পারলেন? শেষ চারের লড়াই সামনে রেখে পরিসংখ্যান ঘেঁটে এসব প্রশ্নের জবাবই একটু খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
ব্যাটিংয়ের জন্য প্রতিকূল উইকেটেই আসরজুড়ে ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়েছেন তিনি। ট্রেডমার্ক কাভার ড্রাইভ কিংবা হাঁটু গেড়ে মিড অনের সীমানা ছাড়ানো শটে অনেক অনুরাগীরই দীর্ঘশ্বাসটুকু আরও দীর্ঘায়িত করেছেন, অবসরটা কি খানিক অবেলায় নিয়ে নিলেন না? ৯ ইনিংস থেকে ২টি অর্ধশতকসহ ৪২.৩৭ গড়ে ৩৩৯ রান, বিপিএলের এবারের আসরে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী রানের মালিক কুমার সাঙ্গাকারা।
লঙ্কান লিজেন্ডের পর রানের খাতায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ জাতীয় দলের ওপেনার তামিম ইকবালের। দল গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও চিটাগং ভাইকিংসের অধিনায়ক ব্যাট হাতে সপ্রতিভ ছিলেন প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই। ৯ ম্যাচ খেলে ৩৭.২৫ গড়ে করেছেন ২৯৮ রান, তিনটি অর্ধশতকসহ তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংসটি ৬৯ রানের।
সাঙ্গাকারা বাদে বিদেশীদের মধ্যে ব্যাট হাতে সবচেয়ে বেশী সাফল্য পেয়েছেন তাঁরই স্বদেশী তিলকরত্নে দিলশান। চিটাগংয়ের হয়ে ইনিংস উদ্বোধনে তামিম ইকবালের এই তারকা সঙ্গী ১০ ম্যাচ থেকে করেছেন ২৬০ রান। ৬৭ রানের একটি অপরাজিত ইনিংস খেলে আসরে দলের দুটিমাত্র জয়ের একটিতে তামিমের সহ-নায়কও তিনি।
শুরুটা খুব সুখকর না হলেও শেষের দিকে ব্যাট হাতে সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন জাতীয় দলের পুরনো মুখ জহুরুল ইসলাম। ৮ ম্যাচে ১৯৬ রান নিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় এই মুহূর্তে তিনি আছেন চার নম্বরে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে জাতীয় দলের অনিয়মিত সদস্য ইমরুল কায়েসের ব্যাট জ্বলেছে বেশ কটি ম্যাচেই। ১০ ম্যাচে ১৯২ রান নিয়ে তিনি আছেন রান সংগ্রাহকদের তালিকার পাঁচ নম্বরে।
ব্যাটসম্যানদের সেরা দশে উপরের তিনজন ছাড়াও আছেন আরও তিন বাংলাদেশীঃ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, নাসির হোসেন ও সৌম্য সরকার। মাঝারি মানের দল নিয়েও ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বরিশাল বুলসকে শেষ চারে জায়গা করে দিয়েছেন মাহমুদুল্লাহ।
আসরের মাঝপথে যোগ দিয়েও রান সংগ্রাহকদের তালিকায় আট নম্বরে উঠে এসেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের পাকিস্তানি তারকা আহমেদ শেহজাদ। পাঁচ ম্যাচ খেলে একটি অর্ধশতকসহ (৭৬*) করেছেন ১৭৪ রান। ব্যাটসম্যানদের সেরা দশে চারজন বিদেশীর শেষ জন শ্রীলংকার দিলশান মুনাবীরা। ৬ ইনিংসে ব্যাট করে ৫৩ গড়ে ১৫৯ রান নিয়ে কুমিল্লার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ইংলিশ ক্রিকেটার আসহার জাইদি আছেন ১১ নম্বরে।
দেশীয় তারকাদের মধ্যে মুশফিকুর রহিম, এনামুল হক বিজয়, সাকিব আল হাসানরা সেরা কুড়ির মধ্যে থাকলেও ব্যাটিং গড় কারোরই উল্লেখ করার মতো নয়। জাতীয় দলের উদীয়মান তারকা সাব্বির রহমান, মুমিনুল হক, লিটন দাস আর অনিয়মিত মুখ শুভাগত হোম, জিয়াউর রহমানরা তো আদতে ব্যর্থদের তালিকায় উপরের দিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। নতুনদের মধ্যে রনি তালুকদার, নুরুল হাসান, মেহেদী মারুফ, সাদমান ইসলামরা দুয়েক ম্যাচে ঝলক দেখালেও সামগ্রিক পারফরম্যান্সে আশার আলো জ্বালাতে পারেন নি তাঁরাও।
অন্যান্য বিদেশীদের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভিন লুইস এবারের বিপিএলের একমাত্র শতকের অধিকারি। অবশ্য ১০১ রানের অপরাজিত ইনিংসটি বাদ দিলে বাকি পাঁচ ইনিংসে তাঁর মোট সংগ্রহ ৪৪ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দলে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে আসর ছেড়ে যাবার আগে ৪ ম্যাচে ১৪২ রান করেছিলেন মারলন স্যামুয়েলস। গ্রুপ পর্বের শেষভাগে বরিশালের দলে যোগ দেয়া ক্যারিবিয়ান তারকা ক্রিস গেইল প্রথম দু’ ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকলেও তৃতীয় ম্যাচেই খেলেছেন ৪৭ বলে অপরাজিত ৯২ রানের একটি ঝড়ো ইনিংস।
চার-ছয়ের বিনোদন তো দিয়েছেনই, তাড়া করার মতো আর ক’টা রান বেশী পেলে হয়তো প্রতিশ্রুত শতকটাও এরই মধ্যে পেয়ে যেতেন। গ্যালারির দর্শকদের নিয়মিত বিনোদন দিয়ে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিটোয়েন্টি অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি মাঠের খেলায় নিজের বিধ্বংসী মূর্তিটা সেভাবে মেলে ধরতে পারেন নি।
বিদেশীদের মধ্যে সংখ্যায় সর্বাধিক হলেও সাফল্যের খাতায় পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের খুঁজে পাওয়াই দায়। শহীদ আফ্রিদি, শোয়েব মালিক, উমর আকমল, মিসবাহ-উল-হকদের কেউই সামগ্রিক বিচারে নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি।
ব্যাটসম্যানদের পাশাপাশি বোলারদের মধ্যেও সাফল্যের খাতায় স্থানীয়রাই এগিয়ে রয়েছেন, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে দেশীয় বাঁহাতিদের জয়জয়কার। ব্যাট হাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পেলেও বল হাতে পুষিয়ে দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। ৯ ম্যাচ খেলে ১৭ উইকেট নিয়ে উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকায় বিশ্বের অন্যতম সেরা বাঁহাতি স্পিনার আছেন সবার উপরে। ১টি ম্যাচ বেশী খেলে সমপরিমাণ উইকেট দখলে নিয়ে নজরটা বেশ ভালোভাবেই কেড়েছেন কুমিল্লার বাঁহাতি পেসার আবু হায়দার রনি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নিজেকে আগেই চিনিয়েছিলেন, বিপিএলের বর্ণিল আলোয় এবার নামটা ছড়িয়ে গেলো জাতীয় দলের অধিনায়ক থেকে শুরু করে জনতার মুখে মুখে।
বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫টি করে উইকেটও পেয়েছেন দেশীয়রাই, দুই বাঁহাতি স্পিনার মোশাররফ হোসেন ও আরাফাত সানি। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৪টি উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের বিদেশী বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে সফল পাকিস্তানের আলোচিত তরুণ বাঁহাতি পেসার মোহাম্মদ আমির। সমপরিমাণ উইকেটের অধিকারি নারায়ণগঞ্জের ডানহাতি পেসার মোহাম্মদ শহীদ টেস্ট অভিষেকের পর এবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির দাবীটা জোরালো করে রাখলেন।
এঁদের পর সফল বোলারদের মধ্যে ১৩টি করে উইকেট পেয়েছেন জাতীয় দলের দুই পুরনো মুখ শফিউল ইসলাম ও আল-আমিন হোসেন এবং ক্যারিবিয়ান কেভন কুপার। বাংলাদেশের পেস আক্রমণে নতুন মারণাস্ত্র মুস্তাফিজুর রহমানের সাথে ১২টি করে উইকেট পেয়েছেন দুই বিদেশী অলরাউন্ডার আসহার জাইদি ও থিসারা পেরেরা। ব্যাটে-বলে ‘ব্যালান্সড’ পা্রফরম্যান্স দেখিয়ে সিলেটের একাধিক জয়ে ভূমিকা রেখেছেন টিটোয়েন্টির ইংলিশ ‘মার্সেনারি’ রবি বোপারা। অবশ্য দলের বিদায়ের সাথে গ্রুপ পর্বেই শেষ হয়ে গেছে তাঁর বিপিএল মিশন। বাকি বিদেশীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নুয়ান কুলাসেকারা, ইয়াসির শাহ, মোহাম্মদ সামিরা গড়পড়তা সাফল্য পেয়েছেন। সীমিত সংখ্যক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে প্রতিদান দিয়েছেন আফগানিস্তানের অধিনায়ক মোহাম্মদ নবী।
কাগজে-কলমে আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর হয়ে যাওয়া গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বরিশাল বুলস মাঠে নামিয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান ক্রিকেটার নিখিল দত্তকে। একুশ বছর বয়সী এই ‘বাঙালি’ তরুণ অফ স্পিনার ৪ ওভার বল করে মাত্র ১৮ রানের বিনিময়ে ফেরান ঢাকার তিন টপ অর্ডার মোহাম্মদ হাফিজ, নাসির হোসেন ও ম্যালকম ওয়ালারকে।
জাতীয় দলের পেস আক্রমণে দুই অন্যতম প্রধান অস্ত্র রুবেল হোসেন ও তাসকিন আহমেদ চোট কাটিয়ে মাঠে ফিরে সামর্থ্যের জানান দিতে পারেন নি। পুরনো মুখদের মধ্যে আবুল হোসেন, ফরহাদ রেজা, তাইজুল ইসলামরা নির্দিষ্ট দুয়েকটি ম্যাচে সাফল্য পেয়েছেন। নতুনদের মধ্যে রংপুরের বাঁহাতি স্পিনার সাকলাইন সজীব ও পেসার আবু জায়েদ এবং সিলেটের আরেক বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল ইসলাম সম্ভাবনার জানান দিয়েছেন।
শেষ করা যাক একজন ‘আক্ষরিক’ অধিনায়কের ইতিবৃত্ত দিয়ে। ‘আইকন’ হিসেবে যে দল পেয়েছিলেন সে দলের মালিক ‘তাঁকে পেয়ে হিসেবে না মেলার’ আক্ষেপটা খোলাখুলিই প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। সেই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত আইকন’-এর কাঁধে চড়েই মাঝারি মানের দলটা গ্রুপ পর্ব শেষে পয়েন্ট টেবিলে সবার উপরে। অসাধারণ নেতৃত্বের পাশাপাশি তিনি একাধিক ম্যাচে ব্যাট হাতেও অবদান রেখেছেন দলের জয়ে। শেষদিকে চোটের কারণে বল হাতে নিতে না পারলেও মাঠে নেমেছেন ঠিকই। শরীর-মনের উপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল যাওয়ার কথা নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন, এ-ও বলেছেন ছোটখাটো সমস্যা থেকে অতীতে বড় কিছু হয়ে যাওয়ায় কিছুটা সতর্ক থাকছেন। তথাপি একটি ম্যাচও দর্শক হয়ে থাকেন নি। পেশাদারিত্ব আর দায়িত্ববোধের এমন যুগলবন্দীতে সাফল্যের স্বরুপ সম্ভবত সবসময় ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানে খুঁজে পাওয়া যায় না। একজন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে তাই অংকের হিসেবে মূল্যায়নের বৃথা চেষ্টা না-ই করলাম!