• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    রোনালদো-মেসি যেদিন একে অন্যের গুণমুগ্ধ

    রোনালদো-মেসি যেদিন একে অন্যের গুণমুগ্ধ    

    গত বছর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার পর থেকে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা তার এবং লিওনেল মেসির অঘোষিত প্রতিযোগিতা যেন স্তিমিত হয়ে গেছে অনেকটাই। রং হারিয়েছে এল ক্লাসিকোও। এখন বার্সেলোনা, রিয়ালের ম্যাচে আগের মত উত্তাপের দেখা মেলে না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে; ঝড় উঠে না চায়ের কাপে। রোনালদোর জুভেন্টাস যাত্রার পর মোনাকোয় হয়ে যাওয়া ইউয়েফা গ্রুপপর্বের ড্রয়ের দিন এবারই প্রথম দেখা হল দুজনের। বরাবরের মত মেসি-রোনালদো যেন আবারও জানান দিলেন, কেন সমর্থকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে তারা দুজনই।

    খুব সম্ভবত ক্যারিয়ারে এবারই প্রথম কোনও অনুষ্ঠানে একই কালো স্যুট-প্যান্ট পড়ে এসেছিলেন দুজন। মোনাকোয় ভার্জিল ভ্যান ডাইকের পাশেই সংরক্ষিত ছিল দুজনের আসন। প্রথম দেখাতেই কুশলাদি বিনিময় করলেন তারা; পেছনের সারিতে বসা চ্যাম্পিয়নস লিগ, কোপা আমেরিকা জেতা লিভারপুলের ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকারও কয়েক মুহূর্তের জন্য অপলক তাকিয়ে থাকলেন। ১৭৮৬ ম্যাচ, প্রায় ১৪০০ গোল, ১০টি ব্যালন ডি'অর, একই ফ্রেমে। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও রোনালদো-মেসির সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মত।

     

     

    গ্রুপপর্বের ড্রয়ের সময়, বা ইউয়েফার বর্ষসেরা পুরস্কারগুলো ঘোষণার সময় যতবারই ক্যামেরা খুঁজে নিয়েছে তাদের; প্রতিবারই নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলেন দুজন। এরিক ক্যান্টোনার ইউয়েফা প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড জিতে অদ্ভুতুড়ে বক্তব্য যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি তারা দুজনও। তবে যে রাতটা ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন মৌসুমের পথচলা নির্ধারণ করার; বা ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলারকে পুরস্কৃত করার; সে রাতের পাদপ্রদীপের প্রায় পুরো আলোটাই শেষ পর্যন্ত পড়ল মেসি-রোনালদোর ওপরই।

    বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক রেশমিন চৌধুরি গত দুবারের মত এবারও ছিলেন আয়োজকের ভূমিকায়। বর্ষসেরা ফুটবলারের ঘোষণার আগে রেশমিনের নেওয়া সাক্ষাৎকারে রোনালদোর কণ্ঠে ঝরল মেসির প্রতি শ্রদ্ধা, "আমি আর লিও প্রায় ১৫ বছর ধরে ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদের ধরে রেখেছি। আমি জানি না আগে কখনও এমনটা এত ধারাবাহিকভাবে হয়েছে কি না, কারণ এভাবে ফর্ম ধরে রাখাটা মোটেও সহজ নয়।"

    ক্যারিয়ারে আগেও এক সাক্ষাৎকারেও মেসির সাথে সম্পর্ক ভাল হলেও কখনও ডিনার করা হয়ে উঠেনি বলে জানিয়েছিলেন রোনালদো। মোনাকোয় আবারও নিজেদের শ্রদ্ধাশীল পেশাদারি সম্পর্কের কথাই তুলে ধরলেন 'সিআর৭', "আমাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের দিক দিয়ে সম্পর্কটা ভাল। কখনও একসাথে ডিনার করা হয়ে ওঠেনি, আশা করি ভবিষ্যতে কখনও সে সুযোগ হবে।" মোনাকোয় উপস্থিত প্রাক্তন এবং বর্তমান ফুটবলার, ইউয়েফা প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার শেফেরিন, এমনকি কাঠখোট্টা ক্যান্টোনার মুখেও তখন হাসি।

     

     

    পরের প্রশ্নে রোনালদোকে লা লিগায় খেলার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন রেশমিন। এবার কিছুটা স্মৃতিকাতরই মনে হল রোনালদোকে, "অবশ্যই (লা লিগায় খেলা মিস করি)। আমি রিয়ালের হয়ে ৯ বছর খেলেছিলাম। অনেক শিরোপা জিতেছি, অনেক চমৎকার মুহূর্ত আছে স্মৃতিতে। লা লিগা ছাড়াও গত ১৫ বছর আমরা একে অন্যকে ভাল খেলতে বাধ্যই করেছি বলে মনে হয় আমার; যেটা আমাদের দুজনের ক্যারিয়ারের জন্যই ভাল হয়েছে। ফুটবল ইতিহাসের অংশ আমরা দুজনই। এটা চিন্তা করতেই ভাল লাগে।"

    এতক্ষণ শ্রোতার ভূমিকায় থাকা মেসি জানালেন; লা লিগায় ঠিকই রোনালদোকে মিস করেন তিনিও, "লা লিগায় আমার আর ক্রিসের প্রতিদ্বন্দ্বীতা দুর্দান্ত ছিল। লক্ষ্য সবসময় ছিল গোল করে দলকে জেতানো। অবশ্যই লা লিগায় আমি তাকে মিস করি।" দুজনের মাঝে কোনও ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বীতা নেই- সবসময়ই বলে এসেছেন মেসি। কিন্তু স্বল্পবক্তা মেসিও যেন এবার জানান দিলেন; নিজেদের প্রমাণ করার এই অঘোষিত লড়াই ছুঁয়ে গেছে তাকেও।

     

     

    ইউয়েফার বর্ষসেরা ফুটবলার হতে না পারলেও সেরা ফরোয়ার্ড ঠিকই হয়েছেন মেসি, রোনালদোর ঝুলি সেদিক দিয়ে খালিই ছিল এবার। আগামী বছর ৩৫-এ পা দেবেন তিনি। ক্যারিয়ারের এই সময়ে এসে অবসরের চিন্তাভাবনা করছেন কি না; রেশমিনের এমন প্রশ্ন হেসেই উড়িয়ে দিলেন আত্মবিশ্বাসী রোনালদো, "আমি তার (মেসি) ২ বছরের বড় হলেও আমার মনে হয় বয়স অনুযায়ী শারীরিক দিক দিয়ে এখনও সম্পূর্ণ ফিট আমি। আমি আগামী বছর; দুই বছর, তিন বছর এই স্টেজে ফিরে আসতে চায়। যাতে যারা আমার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়; তারা যেন আমাকে বারবার এখানে দেখতে পায়।"

    ২০১৮-তে চার বছর পর ইউয়েফার বর্ষসেরা ফুটবলারের শ্রেষ্ঠত্বে মেসি-রোনালদোর মনোপলি ভেঙ্গে শেষ হাসি হেসেছিলেন লুকা মদ্রিচ। এবারও খেতাবটি নিজেদের করে নিতে পারলেন না মেসি বা রোনালদো; লিভারপুল এবং নেদারল্যান্ডসের হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানোর পর খুব সম্ভবত পাওনা পুরস্কার বুঝে নিলেন ভ্যান ডাইক। কিন্তু মোনাকোয় ২০১৯-২০ চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বের ড্রয়ে বার্সেলোনার 'গ্রুফ অফ ডেথ'-এ পড়া, ক্যান্টোনার বিচিত্র বক্তব্য, বা ভ্যান ডাইকের ইউয়েফার বর্ষসেরা হওয়া- সব ছাপিয়ে সবাই হয়তো দিনটি মনে রাখবেন রেশমিন চৌধুরির নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারের জন্যই। যে সন্ধ্যায় মেসি-রোনালদো আবারও প্রমাণ করলেন; এই ১৫ বছরের পথচলায় একজনের ক্যারিয়ারের আরেকজনের প্রভাব ঠিক কতটা ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।