ক্লুজনারকে যেমন দেখেছি...
এই বছর বিপিএলে রাজশাহী কিংসের কোচ হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার। পেশাদারি কারণে সে সময় এই লেখক তাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, হয়েছে অনেক আলাপচারিতা। ক্লুজনারের জন্মদিনে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এই ছোট্ট উপহার
মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বাড়ে, আবার কিছু কিছু জিনিস নিশ্চিতভাবেই কমে। মুগ্ধতা তার একটি। আপনি যতই বুড়ো হবেন, আপনার সামনে থেকে যে কোনো ঘোর বা বিভ্রম একটু একটু করে কাটতে শুরু করবেন। তারপরও কিছু কিছু ঘোর আসলে কাটতে চায় না। যার একটি ৯৯ এর সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। ক্লুজনার-ডোনাল্ড-স্টিভ ওয়াহ-অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে এমন একটা ফ্রেম হয়ে গেছে, আজ থেকে ২০ বছর পরেও এসে যেন চোখে লেগে থাকে মুহূর্তটা। সেই ঘটনা তো আছেই, আরও নানা কারণে ল্যান্স ক্লুজনারের আবেদন অন্তত আমার কাছে অন্যরকম। সামনাসামনি যখন প্রথমবার তাকে একদম কাছ থেকে দেখার, কথা বলার সুযোগ হলো- ছেলেবেলার সেই মুগ্ধতা কিঞ্চিৎ হলেও ফিরে এলো।
খেলোয়াড় ক্লুজনারকে যখন ছেলেবেলায় দেখেছিলাম, দাঁড়িগোফ ছিল না তার। শৈশবের স্মৃতি প্রতারণা কম করে, তাই তাকে ক্লুজনার হিসেবে জানার সঙ্গে সঙ্গে চিনেছিলাম জুলু নামেও। পত্রিকায় পড়েছিলাম, নাটালে জুলু আদিগোষ্ঠীর সঙ্গে বেড়ে ওঠার জন্য জুলু ভাষাটাও জানা তার। সেজন্যই ওই নাম। কিন্তু সেই ছেলেবেলায় দেখে মনে হতো, মানুষের স্নায়ুও কি এতোটা শীতল হতে পারে? নইলে যখন জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চার রান দরকার, তখন ডিওন ন্যাশের লো ফুলটসটা কীভাবে ছয় মেরে জিতিয়ে দেন দলকে? লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে কীভাবে জয় ছিনিয়ে নিয়ে আসেন মাথা ঠাণ্ডা রেখে?
ক্লুজনারকে প্রথম দেখায় জিজ্ঞেস করায় মুচকি হেসে বলেছিলেন, পরে শিখিয়ে দেব তোমাকে। এজবাস্টন ৯৯ এর স্মৃতি তো আছে, জুলু অন্তত আমার নিজের কাছে বেশি স্পেশাল ছিল আরেকটা কারণে। নব্বই দশকের যেসব বোলারদের বোলিং অ্যাকশন নিজেদের বারান্দায় বা বাড়ির সামনের উঠোনে কপি করতে করতে আমরা বেড়ে উঠেছি, তাদের মধ্যে ক্লুজনার ছিলেন একজন। হাত দুইটি সামনের দিকে নিয়ে এগিয়ে আসা, এরপর ডেলিভারি স্ট্রাইডের আগে একটা লাফ- যার পর হাত দুইটি তাক করে বলটা ছোঁড়া-ঠিক যেন বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়ার মতো- ওই অ্যাকশনটা এখনও চোখে ভাসে। সেটা নিয়ে জানতে চাওয়ার পর হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘কেন, নকল করার জন্য আমার চেয়ে আর ভালো অ্যাকশন পাওনি? আরও কত কত অ্যাকশন ছিল।’
সবার সঙ্গে ক্লুজনারকে মিলিয়ে অবশ্য লাভ নেই। ছোটবেলায় ধারণা ছিল, লোকটা বেশ গম্ভীর। এমনিতে উদযাপন করলেও মুখে হাসিটা কমই ছিল। কোচ হয়ে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই ভারিক্কি ভাবটা একটু বাড়ার কথা। তবে তার মানে এমন নয় যে, লোকটা অমিশুক বা আলাপী নন। বরং ঠিক তার উলটো। দেখা হতেই সবসময় আগ বাড়িয়েই জানতে চান কুশল। মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেন-‘হাউ আর ইউ, অল গুড?’
অবশ্য মাঠে নামলে নিজে যেন ঘোরের মধ্যে চলে যান একটা। নেটে কাছ থেকে দেখেন খেলোয়াড়দের, কখনো দরকার হলে তাদের টিপস দেন। নিজে ব্যাটিং আর বোলিং-দুটিতেই ছিলেন পারঙ্গম। কোচিং ক্যারিয়ারেও ব্যাটিং বা বোলিং দুই ভূমিকাতেই কাজ করেছেন। তাই ছাত্রদের নেটে বল করার সময় যেমন দেখেছেন কাছ থেকে, আবার ব্যাটিং করার সময় পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মৌনী ঋষির মতো। তবে এমন নয়, কোচ হিসেবে অনেক কিছু করেছেন। ওই সময়েই একবার বলেছিলেন, এই পর্যায়ের কোচের খেলোয়াড়দের হাতেকলমে বেশি কিছু শেখানোর থাকে না। বরং ফোকাসটা ঠিক রাখা, টুকটাক টেকনিক্যাল দিক দেখিয়ে দেওয়া- এসব নিয়েই কাজ করেন বেশি।
তবে ব্যাট দেখলে হাত নিশ্চয় নিশপিশ করে তার। বিশেষ করে শেষ দিকে নেমে ঝড় তোলার যে কাজটা করতে হয়েছে অনেকবার, এখনকার ক্রিকেটে সেই সুযোগ অন্যভাবেই পেতেন। ক্লুজনারের সময় টি-টোয়েন্টির ধারণা এলেও সেটা ফেলেফুঁপে ওঠেনি এখনকার মতো। আজকের আইপিএলে সম্ভবত রেকর্ড দামেই বিকোতেন। অমন বোলিং আর মারকুটে ব্যাটিংয়ের প্যাকেজ যে ক্রিকেট খুব বেশি দেখেনি! আর টি-টোয়েন্টিতে তো এই প্যাকেজেরই সবচেয়ে বেশি চাহিদা। ক্লুজনারের কাছে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে দার্শনিকের মতো বলেছিলেন, যেটা হয়নি সেটা নিয়ে আফসোস করে আসলে লাভ নেই।
এই নির্লিপ্ত দর্শনটা আসলে তার মজ্জাগতই। খেলোয়াড় হিসেবে অনেক স্নায়ুক্ষয়ী মুহূর্ত এসেছে, যখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজের কাজ করে গেছেন। ৯৯এর ওই সেমিফাইনাল ব্যতিক্রম, সেদিন কী হয়েছিল আসলে নিজেও বোধ হয় জানেন না। ক্লুজনারের সাথে দেখা হলো আর সেই আলাপ হলো না, সেটাও কী হয়? ২০ বছর পর সেই দিনের প্রসঙ্গে হৃদয় খুঁড়ে একটু বেদনা জাগবেই। তার জবানটাই হুবুহু তুলে দেওয়া যাক, ‘আসলে এটা নিয়ে মাথাও ঘামাইনি কখনো। ক্রিকেটকে আমি খেলা হিসেবেই দেখেছি। আপনি নিজের শতভাগটা দেবেন, এরপর কী হলো তাতে তো আপনার হাত নেই খুব একটা। অনেক কিছুই অনেক রকম হতে পারত। কী হলে কী হলো, সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আমরা সেই ম্যাচ জিতে পাকিস্তানের কাছে ফাইনালেও হেরে যেতে পারতাম। আমি হয়তো বা ছয় মেরে আগেও আউট হতে পারতাম। সত্যি কথা হচ্ছে, ওই ম্যাচে আমরা যথেষ্ট রানও করতে পারিনি। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। মূল ব্যাপার হচ্ছে, আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হবে শতভাগ। দেখতে হবে, চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি কি না। এরপরও আপনি অপেক্ষাকৃত ভালো কারও কাছে হেরে যেতে পারেন। আমাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আর অ্যালানের (ডোনাল্ডের) কথা বলেও লাভ নেই। ওর পর্যন্ত ব্যাট করতে আসারও কথা ছিল না। ওর কাজটা তো আরও আগে অন্য কারও উচিত ছিল। আমরা হেরে গেছি, কারণ আমরা জিম্বাবুয়ের কাছে আগেই হেরে গিয়েছিলাম।’
তবে ক্লুজনার মানে তো শুধু ৯৯ এর ওই ঘটনা নয়, এরপর আছে আরও অনেক কিছু। বিশেষ করে যেভাবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি হলো, তাতে গ্রায়েম স্মিথের ভূমিকা নিয়ে এক সময় সমালোচনাও হয়েছিল। সেটা মনে করিয়ে দেওয়া হলে এত বছর পর আর ও নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলেন না। শুধু ছোট্ট করে বললেন, নিজের ফর্ম খারাপ ছিল বলেই বাদ পড়তে হয়েছিল। ওই সময়ের দায়টা নিজের কাঁধেই নিচ্ছেন। অথচ এক সময় স্মিথকে দুষেছিলেন প্রকাশ্যে। বয়স কত কিছুই না বদলে দেয় সহজে!
তবে একটা ব্যাপার বদলায় না, সেটা হলো নেশা। ক্রিকেট যার রক্তে আছে, ২২ গজে গিয়ে মারাটা যার কাছে একটা মাদকের মতো, তার আসলে ক্রিকেট ছেড়ে দূরে থাকাটা কঠিন। বিশেষ করে খেলা ছাড়ার পর আরও। ক্লুজনার সেখানেও কম উত্থান পতন দেখেননি। জিম্বাবুয়ের কোচ হিসেবে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক টালমাটালে চাকুরিটা ছাড়তে হলো। বলেছিলেন, জিম্বাবুয়ের ওই সময়টা বেশ উপভোগ করেছিলেন। তবে ক্লুজনার বোধ হয় সেই বিরলগোত্রীয় অভাগা, সুখ যাদের কপালে বেশিদিন হয় না। জিম্বাবুয়ের দায়িত্ব ছাড়ার পর কোনো জাতীয় দলে পূর্ণকালীন ভূমিকায় তাই কাজ করা হয়নি।
আরেকটা জানার বিষয় ছিল, তার উত্তরসূরিদের কার মধ্যে নিজের ছায়া দেখেন বা দেখেছেন? একটা মজার কথা বললেন অবশ্য, গিলক্রিস্ট, বাউচারদের মতো উইকেটকিপাররা ওই সময়ের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে পাক্কা অলরাউন্ডার হয়ে উঠছেন তা মনে করিয়ে দিলেন। তবে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হলে ভেবেচিন্তে কাকে বেছে নিলেন বলুন তো? ইংল্যান্ডের অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ। কে জানে, এই মুহূর্তে প্রশ্নটা করা হলে স্টোকসের কথাই হয়তো বলতেন।
তবে সবকিছুর পরও ক্লুজনার একজনই। একজন নব্বই দশকের কিশোরের অন্তত তার কাছে যে ঋণ, সেটা তো শোধ করা মুশকিল!