• " />

     

    ‘দ্য পান্টার ফ্যান্টাস্টিক’....

    ‘দ্য পান্টার ফ্যান্টাস্টিক’....    

    ১.

    “এই শটে তাঁর থেকে ভাল কেউ নেই এই মহাবিশ্বে”, মার্ক নিকোলাস বলেছিলেন, রিকি থমাস পন্টিং কোনো একবার পুল শট খেলার পর।

    “যদি রিকি পন্টিং আমাকে একটা ইটের দেয়ালের ভিতর দিয়ে যেতে বলে,আমি যাব। এর মানে এই নয় যে আমি একটা ইডিয়ট। এর মানে এই,যদি রিকি না ভাবে যে আমি এটা করতে পারব,সে নিজে করতে পারবে,তাহলে সে কখনোই আমাকে এমন কথা বলতো না”, জাস্টিন ল্যাঙ্গার বলেছিলেন, অধিনায়ক রিকি,বন্ধু রিকি সম্বন্ধে।

     

    ২.                                                      

    ১৯৭৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর। তাসমানিয়ায় গ্রায়েম আর লোরেইন পন্টিং এর প্রথম সন্তানের জন্ম। ৮ বছর বয়সে মাওব্রে ক্রিকেট ক্লাবে যাওয়া আসা শুরু। জীবন বদলে গেল,যখন অ্যাডিলেডের ক্রিকেট একাডেমি থেকে ডাক আসল রিকির। সেখানেই ১৯৯১ সালে শেন ওয়ার্নের সাথে দেখা। রিকি ছিলেন সেখানে সবচেয়ে ছোট। বড়রা যখন মজা করতেন,নাইট-আউটে বের হতেন, রিকি শুধু দেখতেন। কুকুর ভালবাসতেন খুব। আর বাজি ধরতেন কুকুরের দৌড়ে। সেখান থেকে দিনে মোটামুটি ৪০ ডলারের মতো বাড়তি আয় হত, তখন আরামেই চলে যেতো দিন। ওয়ার্নি সেখানেই তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘পান্টার’। তাসমানিয়ার সেই ছোট ছেলেটা হয়ে গেলেন পান্টার, যে ছেলেটা ক্রিকেটের সবকিছু ভালবাসত, ব্যাট,প্যাড,গ্লাভস থেকে শুরু করে ইতিহাস-সংস্কৃতি। সবার আগে এসে কিংবা খেলার মধ্যবিরতিতে নিজের কিটব্যাগ গুছিয়ে রাখতেন তিনি, যাতে কাজের সময় হাতের নাগালে পাওয়া যায় সব।

     

    ৩.

    ১৯৯৫ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। জাস্টিন ল্যাঙ্গার আর রিকি পন্টিং ছিলেন বাড়তি স্কোয়াডের ব্যাটসম্যান। স্বপ্নের তারকারা কিভাবে খেলেন, ড্রেসিংরুমে কিভাবে সময় কাটান, সব খেয়াল করতেন রিকি। সে বছরেরই ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখে, মুত্তিয়া মুরালিধরনের একটা বলের মুখোমুখি হলেন রিকি। ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে মারলেন, ব্যাটের কানায় লাগলো, স্লিপ দিয়ে বের হয়ে গেল বল। তাঁর মাথায় তখন ব্যাগি গ্রিন, যেটা পেয়ে সবার আগে গন্ধ শুঁকেছিলেন সেটার, স্বপ্নের চেয়েও বেশী কিছু ছিল যে সেই ক্যাপটা! ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরী পাননি সেদিন, হয়েছিলেন এলবিডাব্লিউ।  রিকি এখনও বলেন, সেবার তিনি আউট ছিলেন না! তবে গ্যালারীতে বাবা-মার জন্য তা ছিল অদ্ভূত আনন্দ আর গর্বের এক উপলক্ষ্য।

     

    রিকি পন্টিংয়ের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। তখনকার অস্ট্রেলিয়ান ড্রেসিং রুমের পরিবেশ ছিল অন্যরকম। সব কাজ একসাথে করতেন তাঁরা, মাঠের খেলা থেকে মাঠের বাইরে উদযাপন, নাইট-আউট পর্যন্ত। প্রচুর পান করতেন একেকজন। শেন ওয়ার্নের মতে তখন ২ থেকে ৫৬ টা বিয়ার পান করার মত মানুষ ছিলেন সেই ড্রেসিংরুমে!  রিকি সেসবে ভালভাবেই জড়িয়ে গেলেন। এরপর ১৯৯৯ সালের কোনো এক রাতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে একটা ওয়ানডের পর সিডনির কিংস ক্রসের একটা বারে বসে পান করছিলেন রিকি। বেশী পান করে ফেলেছিলেন, হালকা হবার জন্য করেছিলেন আরও বেশী। সেখানেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন একজনের সঙ্গে, আর পরদিন নিজের চোখের নীচে আবিস্কার করেন কালশিটে দাগ। বহিষ্কৃত হলেন তিন ম্যাচ, জরিমানা করা হল তাঁকে। রিকি নিজের কাঁধে সব দায়ভার নিলেন, বললেন চেষ্টা করবেন ভবিষ্যতে ‘কম’ পান করার, চেষ্টা করবেন নিজেকে সামলানোর। এই ঘটনার পর পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘রিকি নকড আউট, থ্রোন আউট’!

     

    ৪.                                     

    ২০০০ সাল। রিকির দেখা হয়ে গেল রিয়ান্নার সাথে। আইনের ছাত্রী ক্রিকেটের ভক্ত ছিলেন না মোটেও, সেই সাক্ষাতে শেন ওয়ার্ন-ও পরে যোগ দিয়েছিলেন। রিয়ান্না শুধু বুঝেছিলেন সামনের মানুষটা ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত; কিন্তু কে - সে বিষয়ে কোন ধারণাই ছিল না। রিকির মাঝে পরিবর্তন আসা শুরু করল এরপর। ‘রাফ এন্ড টাফ’ রিকি সুন্দর সুন্দর শার্ট পড়া শুরু করলেন, চোখে ‘ফ্যান্সি সানগ্লাস’, পায়ে পলিশ করা সু। ল্যাঙ্গারের কাছে সেই রিকি অপরিচিত, নতুন পন্টিংকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, “দ্যাটস নট পান্টার”! রিকি বদলে গেলেন; মানুষ হিসেবে, ক্রিকেটার হিসেবে। ল্যাঙ্গার তাঁর দেখা সবচেয়ে বড় ‘ক্রাশ’ বলেন এটিকে!

     

    সেই ট্রেডমার্ক পুল...

     

    ৫. 

    স্টিভ ওয়াহর বিদায়ের পর অস্ট্রেলিয়ার নতুন অধিনায়ক খোঁজার পালা। রিকির মতে ‘প্রার্থী’ ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শেন ওয়ার্ন। আর তিনি হলে হতে পারতেন ১৩ নম্বর পছন্দ। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চিন্তা অবশ্যই ভিন্ন ছিল। সামনে দক্ষিন আফ্রিকা সফর, হোটেলের রুমে ভোর ৬.৩১ মিনিটে ফোন পেলেন জেমস সাদারল্যান্ডের। জানলেন তিনিই হচ্ছেন স্টিভের উত্তরসূরী। প্রথম যিনি হোটেল রুমে নক করলেন অভিনন্দন জানাতে, তিনি গিলি, তারপর এলেন ওয়ার্নি। রিকি পন্টিং পেলেন ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটার দায়িত্ব!

     

    বিশ্বকাপ তখন। প্রথম ম্যাচের কয়েক ঘন্টা আগে খবর এল শেন ওয়ার্ন ডোপ টেস্টে পজিটিভ প্রমাণিত হয়েছেন। তখন রিকির অভিব্যাক্তি দেখে স্ত্রীর মনে হয়েছিল, “শ্যেন, তুমি আমার স্বামীর একি হাল করেছো!” ড্রেসিং রুমে ওয়ার্ন সবার উদ্দেশ্যে কথা বললেন। রিকি সেদিন বলেছিলেন, যে কারও মনে যে কোনো প্রশ্ন থাকলে করে ফেলতে। কিন্তু একবার যখন তাঁরা সেই রুমের বাইরে যাবেন, ওয়ার্নকে নিয়ে কিংবা সেই ঘটনা, কোন কিছু সম্বন্ধেই কোন কথা বলা যাবে না আর। দলের সেরা বোলারকে হারিয়ে যেকোনো অধিনায়কের ভেঙ্গে পড়ার কথা। তাই যদি হয়, তাহলে তিনি রিকি পন্টিং কেন!

     

    পন্টিং আর তাঁর দল ভেঙ্গে পড়েনি। এটার প্রমাণ দিতে পারবে ভারত, ফাইনালে পন্টিংয়ের এক ইনিংসের কাছে কিভাবে তাঁদের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছিল, একবার গিয়ে জিজ্ঞাসা করেই দেখুন না!

     


    সময়ের অন্যতম সেরা ফিল্ডার!

     

     

    ৬.

    অধিনায়ক পন্টিং ছিলেন ব্যাটসম্যান পন্টিংয়ের চেয়েও ‘কঠোর’। তিনিও হয়তো সবসময় হাসতে পারতেন, চাইলেই মজা করতে পারতেন মাঠের ভিতরে। কিন্তু তাঁর ক্রিকেটের ধরণটাই যে আলাদা! তিনি ‘সিরিয়াস’, তিনি ‘রাফ’,তিনি ‘টাফ’। তিনি এমন দল গড়তে চেয়েছিলেন, যেটা দেখে প্রতিপক্ষরা বলবে, “আমরা কিভাবে তাঁদের হারাবো!”

     

    পন্টিং এমন একটা দলেরই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। হয়ত অনেক তারকা ছিলো তাঁর দলে,তবে সে তারকারাজি সামলানো তো তাদেরকে নিয়ে অজেয় দল গঠনেরই পূর্বধাপ! সেই কঠিন কাজটা পন্টিং করে দেখাতে পেরেছিলেন।

     

    ২৬ ডিসেম্বর ২০০৫ থেকে ২ জানুয়ারী ২০০৮, তাঁর অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল টানা ১৬টি টেস্ট। স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ারও ছিল এই রেকর্ড।  পন্টিং টানা দুইটি বিশ্বকাপ জিতেছেন, তাঁর আমলে অস্ট্রেলিয়া প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছে।  তাঁর অস্ট্রেলিয়া আগেরবারের জয়ী দলকে অ্যাশেজে হোয়াইটওয়াশ করেছে। তাঁর সময়েই অস্ট্রেলিয়া আবার সতের বছর পর অ্যাশেজ হেরেছে, ইংল্যান্ডের মাটিতে হেরেছে পরপর দুই অ্যাশেজই! ঘরের মাটিতে ২৪ বছর পর খুইয়েছে অ্যাশেজ।

     

    সমালোচনা তো ছিলই।  ২০১১ এর বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন রিকি পন্টিং। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মানে যে ‘রোল মডেল’ হওয়া দরকার, যে পরিমান ‘এনার্জেটিক,ভাইব্রেন্ট,অ্যারোগেন্ট’ হওয়া দরকার, তেমনই একজন ছিলেন তিনি। এসব ‘গুণ’ এর কারণেই আবার অনেকেই তাঁকে ঠিক পছন্দ করতেন না, জাস্টিন ল্যাঙ্গারের দাদি পর্যন্ত না!  ভারতের সঙ্গে সিডনি টেস্টের ‘মানকিগেট’ কেলেঙ্কারীর পরও একবার তাঁর ‘পদত্যাগ’ নিয়ে কথা উঠেছিল।  সেই অধিনায়ক সরে দাঁড়ালেন। মাইকেল ক্লার্কের হাতে সঁপে দিলেন ‘উত্তরাধিকারের’ দায়িত্ব।

     

    ৭.

    ২০১২ সালে ফর্মহীনতায় ভুগছিলেন অনেক। সিবি সিরিজের ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে বিদায় বললেন সীমিত ওভারকে। টেস্টেও চলল এই ব্যর্থতার মিছিল। পত্রপত্রিকা ছেয়ে গেল তাঁর বিরুদ্ধচারণে। অ্যাডিলেডের দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যালিসের একটা ফুল লেংথের বলে বোল্ড হলেন। রিকির মতে সেটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ‘কুশ্রী’ ডিসমিসাল। বুঝলেন,সময় এসেছে বিদায় বলার। বাবাকে ফোন দিলেন; বাবা তখন মাকে নিয়ে বিগব্যাশের একটা ম্যাচ দেখছিলেন। ''কী করছেন?'' এর জবাবে বাবা বলেছিলেন, ‘অন্যদেরকে রান করতে দেখছি,যেটা তোমারই সবচেয়ে বেশী করার কথা। রিকি বলেছিলেন, আর বেশীদিন এই রান করার সময় থাকবেনা। বাবা গ্রায়েম যেন মানতে পারেননি, তাঁর মনে হয়েছিল, ‘ রিকি খেলতেই থাকবেন, খেলতেই থাকবেন!’

    নভেম্বরের ২৯ তারিখে পন্টিং ঘোষনা দিলেন, এই শেষ। তাঁর বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে স্ত্রীর মনে হয়েছিল,সবাই যেন কোন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এসেছে, এমন ভাব। তাঁকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন সবাই। তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘সে তো এখনও মারা যায়নি!এটা তো শুধুই ক্রিকেট!’

    রিয়ান্না তো তেমনই বলবেন। কিন্তু ব্যাটসম্যান পন্টিংকে শেষবারের মত দেখার অনুভূতি কী, সেটা ক্রিকেটদর্শক, তাঁর সতীর্থরা তো অন্যভাবে জানেন!

     

    শেষদিনেও তার মাথায় ছিল সেই ব্যাগি গ্রিন। যেমন ছিল তাঁর আগের ১৬৭টি ম্যাচেও।

     

    ৮.

    রিকি পন্টিংয়ের মত করে পুল শট কেউ খেলেননি। ক্লার্ক তাঁকে ব্র্যাডম্যানের পরে অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান মানেন। ল্যাঙ্গার তাঁর কারণেই ইটের দেয়ালের ভিতর দিয়ে যাবারও ইচ্ছা রাখেন।


    শেষবেলায় দক্ষিন আফ্রিকানরা তাঁকে ''গার্ড অব অনার'' দিয়েছিল, গ্যালারীতে বাবা-মার অনুভূতি ছিল তখন সুখের,গর্বের, এবং হ্যাঁ দুঃখেরও। তাঁরা যে ভেবেছিলেন, রিকি খেলে যাবেন অনন্তকাল!

     

    পন্টিং এরপর চলে গিয়েছিলেন তাঁর সেই মাউব্রে ক্লাবে। ৩৮ বছর বয়সে আবার সেই ড্রেসিংরুমে ফিরলেন, যেটা ফেলে এসেছিলেন ১৪-১৫ বছর বয়সে। তাঁর মতে,তিনি আবার ঘরে ফিরেছিলেন।

     

    এর মাঝে রেখে গেলেন একটা বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। একটা বৈচিত্রময় ক্যারিয়ার। যে ক্যারিয়ারের স্বপ্ন অনেকেই দেখেন। পান শুধু রিকি থমাস পন্টিংয়ের মত কেউ কেউ!

     

    এরপর হয়ত ব্যাটসম্যান পন্টিংয়ের মত কেউ আসবেন, আসবেন অধিনায়ক পন্টিংয়ের মতো কেউ, কিংবা অসাধারণ এক ফিল্ডার, পন্টিংয়ের মতো। কিন্তু এমন একজন কি আসবেন, যাঁর মাঝেই থাকবে ব্যাটসম্যান পন্টিংয়ের মতো শুরুতে নড়বড়ে কিন্তু থিতু হওয়ার পরে এত ভয়ঙ্কর কেউ?  যিনি আবার হবেন আক্রমণাত্মক এক অধিনায়ক, যাঁর একটা কথাতেই ড্র ম্যাচ জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন সতীর্থরা!  যিনি আবার হবেন অন্য রকমের এক ‘আক্রমণাত্মক’ ফিল্ডার!  এমন কেউ কি আসবেন?

     

    শীঘ্রই নয়।

    তবে এরকম কাউকে যিনি দেখবেন,তিনি অনেক অনেক সৌভাগ্যবান ক্রিকেটদর্শক হবেন।

    রিকি পন্টিংয়ের মত ‘পান্টার ফ্যান্টাসটিক’কে দেখাটা তো কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়!