লেস্টার সিটির "সিন্ডারেলা স্টোরি"
১.
৬০৬, বিবিসি রেডিও ৫। চলছে লিস্টার বনাম এভারটন ম্যাচের সরাসরি টেলিফোন শো। লেস্টার সিটি জিতেছে ৩-২ ব্যবধানে। ম্যাচ শেষ হতে না হতেই অনুষ্ঠানটিতে ফোন করলেন লি নামের এক লিস্টার ভক্ত। ছেলেকে নিয়ে খেলা দেখতে আসা এই ‘ফক্স’ সমর্থক একটু আবেগাপ্লুতই হয়ে পড়লেন। তা সেটা তো হতেই পারেন। গত ‘বড়দিনে’ পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে ছিলো লিস্টার। আর তাঁরাই কিনা এবার ‘ক্রিসমাস ট্রি’র শীর্ষে!
লেস্টারের ‘ফক্স’দের এভাবে ফিনিক্স পাখির মত পোড়া ছাই হতে জেগে ওঠার কথাই বা কে ভেবেছিলেন? গত ৪০ বছর ধরে লেস্টারের ফুটবলারদের কিট ধোয়ার দায়িত্বে আছেন শিলা কেন্ট। তাঁর কাছেও তো এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে এই সাফল্যকে। কারণটাও যুক্তিযুক্ত। নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনে লিনেকার, হেস্কিদের কিট ধোয়ার সময়টাতেও এত বড় সাফল্য দেখতে পান নি এই বর্ষীয়ান নারী।
২.
১৩১ বছরের পুরনো ক্লাব লেস্টার সিটি। ১৮৮৪ সালে একদল বুড়ো মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই ক্লাবটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দীর্ঘ সময়ে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জেতা হয় নি কখনো। তবে ১৯২৮/২৯ মৌসুমে একবার রানার্সআপ হয়েছিল ‘দ্য ব্লু আর্মি’রা। অন্যদিকে ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে যৌথভাবে সর্বোচ্চ ৭ বার শিরোপা অর্জনের রেকর্ড রয়েছে তাদের। প্রায় এক দশক পর ‘ফক্স’রা প্রিমিয়ার লিগে ফিরেছিল ২০১৪/১৫ মৌসুমে। তবে তাঁদের মৌসুমটা পার হয়েছে প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকার লড়াই করেই। সেই রেলিগেশনের মুখ থেকে ফিরে এসেই যেন নতুন করে জেগে উঠেছে ভার্ডি-মাহরেজরা। কে জানে নতুন ম্যানেজার ক্লডিও রানিয়েরি কি মন্ত্র বলে দিয়েছেন লেস্টারের ফুটবলারদের!
লেস্টারের সাফল্যের নায়ক বলা যায় ভার্ডি-মাহারেজ এবং ম্যানেজার রানিয়েরিকে। তবে ‘ফক্স’দের এই সাফল্যচিত্রের পিছনে রয়েছেন আরো কিছু মানুষ। সে তালিকায় নাম থাকবে ম্যাচ শুরুর আগে মাঠে মাইক্রোফোনে কথা বলা অ্যালান বির্চেনালের। যে লোকটি ঘরের মাঠে ম্যাচ শুরুর আগে দর্শকদের জাগিয়ে তোলেন। সাফল্যের কৃতিত্বটা দিতে হবে ফুটবলারদের কিট ধোয়ার দায়িত্বে থাকা শিলা কেন্ট কিংবা ক্লাবটির খাবার রান্নার দায়িত্বে থাকা গ্যারি পেইনকেও।
গত ১৭ মৌসুম ধরে ম্যাচের আগের দিন আপেলের কাস্টার্ড বানান রাঁধুনি পেইন। এর পিছনেও রয়েছে মজার এক রহস্য। লেস্টারের ম্যানেজার তখন মার্টিন ও’নেইল। সেসময় একবার ম্যাচের আগের দিন আপেলের কাস্টার্ড বানিয়েছিলেন পেইন। এরপরের দিন ম্যাচ জিতে যায় ‘ফক্স’রা! সেদিন থেকে ম্যাচের আগের দিন আপেলের কাস্টার্ড খাওয়া রীতিতেই পরিণত হয়ে গেছে লেস্টার সিটির জন্য।
লেস্টার সিটির ইতিহাসে গ্যারি লিনেকার, পিটার শিল্টন, গর্ডন ব্যাঙ্কস ও ডন রেভিদের মত খেলোয়াড়রা খেলে গেলেও গত কয়েক যুগে এবারের মৌসুমের অর্জনটাকেই সেরা সাফল্য হিসেবে মানছেন যেকোন লিস্টার সমর্থকই। এই সাফল্যের নেপথ্যে থাকা নায়কেরা কেউই কিন্তু তেমন কোন জনপ্রিয় তারকা ফুটবলার ছিলেন না। বরং ভার্ডি, মাহরেজরা নিজেদেরকে ফুটবল বিশ্বে পরিচিত করেছেন এবারের মৌসুমেই।
৩.
দলটির এই মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা জেমি ভার্ডি পাঁচ বছর আগেও কাজ করতেন একটি কারখানায়। আর সাপ্তাহিক বন্ধে আধা-পেশাদার লিগে ফুটবল খেলে আয় করতেন ৫০ ডলার। অন্যদিকে দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা রিয়াদ মাহরেজ কয়েকবছর আগেও খেলতেন ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিভাগের ফুটবল দলে। সেখান থেকে এই আলজেরিয়ানকে লেস্টারে আনতে যে পরিমান ফি লেগেছিল তা ওয়েন রুনির সাপ্তাহিক আয়ের চেয়ে সামান্যই বেশি!
‘দ্য ব্লু আর্মি’দের সাম্প্রতিক সাফল্যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া ওয়েস মরগ্যানের অবদানটাও কম নয়। নেতৃত্বের পাশাপাশি নিজের দলের ডিফেন্সকে আগের চেয়ে শক্তিশালী করার পিছনে কৃতিত্ব দিতে হবে অধিনায়ক মরগ্যানকেও। অথচ এই জ্যামাইকানকে পুরনো ক্লাব নটিংহ্যামে প্রথম মৌসুমটা মাঠে চক্কর দিয়েই কাটাতে হয়েছিল ওজন কমানোর জন্য। পরবর্তিতে অবশ্য ফুটবল লিগের ‘দশক সেরা দল’-এ নিজের নাম লিখিয়েছিলেন এই বিশালদেহী ডিফেন্ডার।
৪.
মাঠে ভার্ডি-মাহরেজ-মরগ্যানরা একের পর এক সাফল্য অর্জন করে যখন ‘হিরো’ বনে যাচ্ছেন তখন পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন এই সাফল্যের মূল কারিগর ক্লডিও রানিয়েরি। এই ইতালিয়ান যখন দায়িত্ব পেয়েছিলেন দল তখন রেলিগেশন এড়িয়ে হাঁফ ছাড়ছে। লেস্টারের দায়িত্ব পাওয়ার আগে গ্রীস জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব থেকে পদচ্যুত হয়েছিলেন। আর তাই তাঁকে নিয়ে শুরুর দিকে সমালোচনাও কম হয় নি। অনেকের ধারনা ছিল রানিয়েরি এসে দলকে আরো বেশি অগোছালো করে দেবে। কিন্তু, সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে ক্লাবের পুরনো পরিবেশ বজায় রেখেই তিনি বদলে দিচ্ছেন লেস্টারকে। এই ভদ্রলোক এমনকি পুরোনো কোচিং স্টাফদেরও বদলান নি। তবুও বদলে গেছে সব। রানিয়েরি বদলে দিয়েছেন ফুটবলারদের মানসিকতাকে। ভার্ডি-মাহারেজদের লেস্টার সিটিতে আনার কৃতিত্বটা সাবেক কোচ নাইজেল পিয়ারসেনের। তবে পিয়ারসেনের গড়ে যাওয়া দলটিকে ‘মিডাসের গোল্ডেন টাচ’ দিয়েছেন ক্লডিও রানিয়েরি।
ক্লদিও রানিয়েরি
রানিয়েরির মন্ত্রে বদলে যাওয়া লেস্টার সিটি যেভাবে খেলে যাচ্ছে সেটা ধরে রাখতে পারলে শিরোপা অর্জন অসম্ভব কিছু নয়। অনেক লেস্টার সমর্থকই হয়ত এবার তেমন কিছুরই স্বপ্ন বুনতে শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু, অতীতে অনেক ছোট দলের আকাশচুম্বী পারফরম্যান্সের পর ছিটকে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। আর তাই তো লেস্টার কোচও এ ব্যাপারে গতানুগতিক ইতালিয়ানদের মতই কিছুটা রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর মতে, এখনো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত নয় তাঁরা। তবে কে জানে, হয়ত একটু সতর্ক থাকার জন্যেও এমনটা বলেছেন। আবার হয়ত মনে মনে ছক কষতেও শুরু করে দিয়েছেন এই লেস্টার কোচ।
গত মৌসুমে লেস্টার সমর্থকদের বড়দিনের প্রার্থনা ছিল যেন লেস্টার রেলিগেশন এড়াতে পারে। আর এবার ‘সান্তা ক্লস’ এর কাছে তাঁদের একটাই চাওয়া, প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা!
লেস্টারের রাঁধুনি গ্যারি পেইনও নিশ্চয় সেই আশাতেই প্রতিটা ম্যাচের আগেরদিন আপেলের কাস্টার্ড বানাবেন!