• " />

     

    সাধারণত্বে তৈরী অসাধারণ যে 'ওয়াল'!

    সাধারণত্বে তৈরী অসাধারণ যে 'ওয়াল'!    

    মনসুর আলী খান পাতৌদি মেমোরিয়াল লেকচার, ২০১৫-১৬। বিসিসিআই মহাসচিব অনুরাগ ঠাকুর ঘোষণা করছেন বক্তার নাম। এমন একজন এবারের বক্তা, যাঁর মতো ‘পরিপূর্ণ’ ক্রিকেটারকে দলে পেলে টাইগার পাতৌদিও খুশী হতেন! তবে সেই বক্তা এসে কী বলে বক্তব্য শুরু করলেন?


    আগের তিন বছর এ লেকচার দিয়েছেন সুনীল গাভাস্কার, অনীল কুম্বলে আর ভিভিএস লক্ষণ। শুরুতেই প্রশংসা করলেন লক্ষণের, যিনি গতবার এত সুচারুভাবে সব বলেছেন যে, এবারের বক্তা নাকি তার সাথে মেলাতেই পারবেন না নিজেকে। যেমন নাকি পারেননি ব্যাটিংয়ে। লক্ষণের সীমানা, ক্লাসকে ছাড়িয়ে যেতে!

     

    আসলেই কি তাই? রাহুল দ্রাবিড় কি অপরের ছায়া হয়েই ছিলেন সবসময়? হয়তো, হয়তো নয়। তবে রাহুল দ্রাবিড় নামের যে ‘ওয়াল’, তার ছায়াতেও তো ছিল ভারতীয় ক্রিকেট, বিশ্ব ক্রিকেট। কী সুদীর্ঘকাল! যে সুদীর্ঘকাল ধরে তিনি পালন করেছেন কতো দায়িত্ব!

     

    নয়ন মঙ্গিয়ার শূন্যস্থান পূরণ করতে ভারতের একজন উইকেটকিপার দরকার। কে গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়াবেন? ভারতের অধিনায়ক দরকার। নিজের পছন্দের কোচের কারণেই বরখাস্ত হয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। কে নেবেন সেই কঠিন ভার? অথবা, ইংল্যান্ডের কঠিন সিমিং, সুইঙ্গিং কন্ডিশনে নতুন বল সামলাতে একজন যুতসই ব্যাটসম্যান চাই। কে যাবেন ওপেনিংয়ে?

     

    সব প্রশ্নের উত্তরে কিন্তু নাম আসবে অথবা এসেছিল একজনেরই।
    রাহুল শারদ দ্রাবিড়।

     

    ভারতীয় ক্রিকেটে কিংবদন্তীর সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। তবে রাহুল দ্রাবিড় একটু আলাদা। তা ব্যাটসম্যান হিসেবে হোক বা মানুষ হিসেবেই! তাঁর মতো সাধারণ ছিলেনই বা ক'জন! তাঁর মতো অসাধারণই বা ছিলেন ক'জন!  
     

    ***

    প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে অ্যালান ডোনাল্ডকে মাথার ওপর দিয়ে একটা ছয় মেরেছিলেন। সে শটের কথা চিন্তা করলে নাকি এখনও গায়ে কাঁটা দেয় তাঁর! ডোনাল্ড যে সে সময়ের অন্যতম দ্রুততম বোলার! রাহুল দ্রাবিড়কে মনে করে কি গায়ে কাঁটা দেয় কোনো বোলারের? তাঁকে আউট করাটা যে ধৈর্য্যের চরমতম পরীক্ষা নিতো! তবে কাঁটা না দিলেই বা কী! দ্রাবিড়ের তাতে আসলেই কিছু যায় আসে না!

     

    যেমন খুব একটা যায় আসে নি অভিষেকেই ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করাটা। লর্ডসে সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে অভিষেক হয়েছিল। সৌরভ সেঞ্চুরি করেছিলেন, দ্রাবিড় পারেননি। তাতে কী! দ্রাবিড় বরং ৯৫ রানের তৃপ্তি নিয়ে যান, ৫ রানের আক্ষেপ করেন না! সেই সহজ সরল দর্শন- পাত্রের অর্ধেকটা খালি নয় বরং পূর্ণ!

     

    দ্রাবিড় জন্মেছিলেন ১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারী, মধ্যপ্রদেশে। বাবা চাকরী করতেন এক জ্যাম প্রস্তুতকারক কোম্পানীতে, কিষান নামের। মা ছিলেন আর্কিটেকচারের অধ্যাপক। বাবার কাজের সুবাদেই দ্রাবিড়ের ডাকনাম ‘জ্যামি’ হয়ে গেল একসময়। দ্রাবিড় বড় হয়েছেন ট্রানজিস্টর রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে। বাবা যে ভালবাসতেন খুব, এই খেলাটা। দ্রাবিড়ের কৌতুহল হতো, নিজের ‘হিরো’ বাবা কেন এত ভালবাসেন এই ক্রিকেটকে! বাবার অবসর সময় কাটানো মানেই ছিল দুই ছেলে, বিজয় আর রাহুলকে নিয়ে ক্রিকেট দেখতে যাওয়া। পড়শিদের সঙ্গে ‘সান্ধ্যকালীন’ ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে খেলতেই দ্রাবিড়ের কৌতুহলটা আগ্রহে রূপ নিল। সে আগ্রহটা ভালবাসায় পরিণত হলোও তখনই! রাহুল স্কুল দলে হকি খেলতেন, অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিতেন। তবে সেই ‘প্রথম প্রেম’ ক্রিকেটের কাছে পাত্তা পেলো না কোনটিই! স্কুল শেষ করে সেন্ট জোসেফ কলেজে ভর্তি হলেন ‘জ্যামি’। স্কুলে রসায়ন আর ইতিহাস পড়তে ভালবাসতেন। তবে একইভাবে অপছন্দ করতেন গণিতও! ব্যাটে বলে হলো না তাই ‘সায়েন্স’ পড়া, রাহুল বেছে নিলেন তাই ‘কমার্স’। কর্নাটকের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ শিরোপা জিতলেন। ভারতের তখনকার ভবিষ্যত তারকার ওয়ানডে অভিষেক হলো ১৯৯৬ সালের ৩ এপ্রিল, সিঙ্গাপুরে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। ওই বছরের জুন মাসেই তো হোম অফ ক্রিকেটে নামলেন। সেই দ্রাবিড়, যিনি একদিন স্কুলে বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ভারতের টেস্ট ক্রিকেটার হওয়া!

     

     

    ***

     

    যদি পাঁচজনের সঙ্গে ডিনার করার সুযোগ মিলতো, যে কোনো পাঁচজন, তবে কাকে কাকে বেছে নিতেন রাহুল দ্রাবিড়? ক্রিকেট ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্র দ্রাবিড় ডন ব্র্যাডম্যানকে ডাকতেন। দেশপ্রেমিক দ্রাবিড় চাইতেন, আসুন মহাত্মা গান্ধী। মানবতাবাদী দ্রাবিড়ের ইচ্ছা, নেলসন ম্যান্ডেলাও যাতে থাকেন সেখানে! দ্রাবিড় শুধু ক্রিকেটারদের আত্মজীবনী নয়, ভালবাসেন অন্য ক্রীড়াজগতের তারকাদের সম্বন্ধে জানতেও! তিনি তাই ডাকতেন মাইকেল জর্ডানকে। আর সংগীতপ্রেমী দ্রাবিড় আমন্ত্রণ জানাতেন বব ডিলানকে। ডিলানের ’৬০ এর দশকের গানগুলি যে খুবই প্রিয় তাঁর!

     

    স্বপ্নের ডাইনিংয়ে কাদের ডাকবেন, সে তালিকা থেকেই ধারণা পেয়ে যাওয়ার কথা কিছুটা, ব্যক্তি দ্রাবিড় সম্বন্ধে। দ্রাবিড় আসলে কেমন?

     

    ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ ক্রিকেটার, যিনি ক্রিকেট নিয়ে অনেক ভাবেন, ক্রিকেটকে অনেক ভালবাসেন, ডাইনিং এ বসেও শ্যাডো প্র্যাকটিস করেন! নাকি যিনি বই পড়তে ভালবাসেন, গান শুনতে ভালবাসেন। নাকি তিনি সেই নিয়ম মেনে চলা মানুষ, যিনি ‘মেডিটেশন’ করেন নিয়মিত। ক্রিকেট নিয়ে তাঁর এতই চিন্তা যে, পরিবারসহ কোনো সফরে গেলেও দুটি ঘর নিতে হতো তাঁকে!

     

    নাকি দ্রাবিড় তিনি, যিনি সবসময় ডান থাই প্যাডটা আগে পরতেন!

     

    অথবা তিনিই দ্রাবিড়, যিনি নিজের বাড়িতে ম্যাচ নিয়ে খুব একটা কথা না বললেও হতাশা ব্যক্ত করতেন এক ব্যাপারে! ক্যাচ ড্রপ করলে। টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ক্যাচের (২১০টি) মালিক সবচেয়ে বেশী হতাশ হতেন কোনো বোলারের বলে ক্যাচ ছাড়লে! ওয়াসিম আকরাম কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পাকিস্তানের স্লিপ ফিল্ডাররা আরেকটু ‘ভাল’ হলে আরও অনেক উইকেট থাকতো তাঁর ঝুলিতে! দ্রাবিড়কে পেয়ে নিশ্চয়ই নিজেদের সৌভাগ্যবানই মনে করতেন ভারতীয় বোলাররা! অথচ সেই দ্রাবিড়ই বোলারদের হতাশটা কী চরমভাবে উপলব্ধি করতেন, যখন তাঁর হাত গলেও বেরুতো ক্যাচ!

     

    স্ত্রী ভিজিতার তাঁর স্বামীকে প্রকাশ করার একটা কথায় বেছে নেন, ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’! সবকিছু যিনি নিয়ম মেনে করতে ভালবাসেন। কোনো সফরের আগে তাঁর সব বাক্স-পেটরা ভিজিতা গুছিয়ে দিলেও, কিটব্যাগটা দ্রাবিড় নিজেই গোছাতেন! ড্রেসিং রুমেও নাকি ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস গুছিয়ে রাখা দেখেই সতীর্থরা বুঝে যেতেন, সেসবের মালিক কে!

     

    খেলোয়াড়ি জীবনে সৌরভ মাঠে যতই আক্রমণাত্মক হোন, মাঠের বাইরে ছিলেন অনেক মিশুক। শচীনের বিনয়টা শুধুই লোক দেখানো ছিল না। ভিভিএস এর চোখে লেগে থাকার মত একটা হাসি ছিল, কুম্বলের মাঝে একটা প্রাণোচ্ছ্বল ভাব ছিল। আর দ্রাবিড়ের?

     

    উপরের অনেকগুলো গুণ ছিল তাঁরও, তবে সবচেয়ে বেশী ছিল একটা ‘সাধারণত্ব’। একটু অসাধারণভাবেই! একজন রাহুল দ্রাবিড় হয়েই আমজনতার মাঝে তিনি মিশে যেতে পারতেন। এখনও পারেন। হোটেল রুমে রিসিপশন থেকে হয়তো ফোন পেলেন, কোনো এক ভক্ত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান! দেখা গেল, হাসিমুখে নেমে এসে কথা বলছেন তিনি! এমন নয় যে তিনি ‘তারকা’ ছিলেন না, বা এখন আর তারকা নেই। ‘তারকা’ হয়েও ক্রিকেটের বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমটা ছিল তাঁর জানা। 

     

    প্রথম কোচ কেকি তারাপোর ছিলেন একজন নিয়মানুবর্তী মানুষ। তাঁর কাছে সবকিছুর ওপরে ছিল শৃংখলা, পলিশ করা সু আর একটা পরিপাটি ইউনিফর্ম! তিনিই দ্রাবিড়কে শিখিয়েছিলেন, একজন ভাল ক্রিকেটার না শুধু, একজন ভাল মানুষও কিভাবে হওয়া যায়! তারাপোরকে দ্রাবিড় ‘সেকেন্ড ফাদার’ এর মতো ভাবেন। তবে সেই শৈশব কৈশোরে তারাপোর স্যারের কাছে যে শিক্ষার গাঁথুনি পেয়েছিলেন, দ্রাবিড় তো তাই মেনে চলেন! তাঁর জীবনের একটা ক্ষুদ্রাংশ দেখলেই তো প্রমাণ পাওয়া যায় তার!

     

    ***

     

    শচীন টেন্ডুলকার টেস্টে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ১৪ বার, দেশের বাইরে ৬ বার। আর দ্রাবিড়ের ১১টা ম্যাচসেরার পুরস্কারের ৮টিই পেয়েছিলেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে! প্রথম সেঞ্চুরিও পেয়েছিলেন জোহানেসবার্গে। ২০০২ সালে হেডিংলিতে করেছিলেন ১৪৮ রান, ১৬ বছর পর ভারত ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট জিতেছিল সেবার।

     

    পরের বছর অ্যাডিলেড টেস্টের দুই ইনিংসে করেছিলেন ২৩৩ আর অপরাজিত ৭২, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারত জিতেছিল ২৩ বছর পর। ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালে ক্যারিবীয়তে ভারত টেস্ট সিরিজ জিতেছিল, সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে দ্রাবিড় করেছিলেন ৮১ আর ৬৮। সে ম্যাচে ফিফটি করা একমাত্র ভারতীয় ছিলেন তিনি! ২০০৪ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে তাঁর ২৭০ রানের ইনিংসই ভারতকে ১২ বছর পর বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতিয়েছিল। ২০০৭ সালে তখন তিনি ভারতের অধিনায়ক। ১৯৮১ সালের পর ভারত ইংল্যান্ডের প্রথম সিরিজ জিতেছিল সেবার!

     

    ২০১১ সালের ইংল্যান্ড সফরে চাপে ছিলেন কিছুটা। তার আগের সিরিজটা যে ভাল যায়নি দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। দ্রাবিড় সে ইংল্যান্ড সফরে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনবার, দুইটি আবার ওপেনিংয়ে নেমে। আর কোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরিই ছিলনা সেবার!

     

    দ্রাবিড় তাহলে কি শুধু বিদেশেরই নায়ক?

     

    ২০০১ সালের ইডেন গার্ডেন একাই যথেষ্ট দ্রাবিড়-কাব্যের জন্য। আগের কয়েক ইনিংসে বাজে পারফরম্যান্সের কারনে তাকে ৬ নম্বরে ‘ডিমোশন’ দেয়া হয়েছিল। দ্রাবিড় সেই পজিশনে নেমেই হয়ে গেলেন ইতিহাসের অংশ। অথবা বলা যায়, গড়লেন ইতিহাস, তাঁর প্রিয় ভেন্যু ইডেনে! লক্ষনের সঙ্গে তাঁর ৩৭৬ রানের জুটি তো রূপকথার অংশ! ফলোঅনে পড়েও স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়াকে শুধু হারানো নয়, সে জুটির ওপর ভর করে যে টেস্ট জিতলো ভারত, তা তো একটা পালাবদলের সূচনাই করলো! লক্ষণের ২৮১ এত এত ‘স্পেশাল’, দ্রাবিড়ের ১৮০ না থাকলে কি হতো এমন! শুধু সেই মহাকাব্যিক ইনিংস নয়, দ্রাবিড় ক্যারিয়ারে ৮৮টি সেঞ্চুরি জুটির অংশ ছিলেন! 

     

    টেস্ট ক্যারিয়ারে মোট বল খেলেছিলেন ৩১,২৫৮ টি। আর কেউ ২৯,৫০০ এর কোঠাই পার করতে পারেননি, নিকট ভবিষ্যতে পারবেন বলেও মনে হয় না! ‘দা ওয়াল’- নামটার যথার্থতা কিন্তু পরিসংখ্যানও দেয়!

     


    ***

    ওয়ানডেতে দ্রাবিড়ের রান ১০,৮৮৯, ৩৯.১৬ গড়ে। আছে ৮৩ টি ফিফটি। আর আছে ১৯০ টি ক্যাচ, সাথে ১৪ টি স্ট্যাম্পিং। দ্রাবিড় যে উইকেটকিপিংও করেছেন, ৭৩টি ম্যাচে! ‘৯৯ এর বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। ওয়ানডে অধিনায়কত্বের সাফল্যের হারে তিনি এগিয়ে সৌরভ বা গাভাস্কারের চেয়েও। তবে যে ‘উদ্যমে’ অধিনায়কত্ব শুরু করেছিলেন, শেষে গিয়ে যেন হারিয়ে গেল তা! নিজে থেকেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন, বাদ পড়েছিলেন ওয়ানডে দল থেকেই। ঘরের মাটিতে ভারত বিশ্বকাপ জিতল, রাহুল দ্রাবিড়ের জায়গা হয়নি সে টুর্নামেন্টে। শচীন টেন্ডুলকারের ইচ্ছাপূরণ হলো। দ্রাবিড়ের ইচ্ছা জানা গেল না সেভাবে!

     

    পাঁচ ম্যাচের জন্য ফিরে এসেছিলেন ওয়ানডে দলে। কার্ডিফে খেলেছিলেন শেষ ওয়ানডে।

     

    আন্তর্জাতিক টি-২০ খেলেছেন একটি, সে ইংল্যান্ড সফরেই। দ্রাবিড়ের যে টি-টোয়েন্টিতে শুরু, শেষও তাতেই!

     

    দ্রাবিড়ের স্মরণীয় এক সফর কাটলো সেবার। এরপর গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। দ্রাবিড় চাইলে ফর্মের গ্রাফটা শীর্ষের দিকে থাকতেই বিদায় বলে দিতে পারতেন। বললেন না। তাঁর কাছে সেটা ‘স্বার্থপরতা’ মনে হয়েছিল। সিরিজজুড়ে একাই তিন সেঞ্চুরি করে যদি দেখেন, আশেপাশে নেই কেউই, তখন তাঁর মনে হতেই পারে, দলের তাঁকে প্রয়োজন। দ্রাবিড় তাই মনে করেছিলেন। তবে প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে গিয়ে পেলেন শুধুই ‘বিভীষিকা’! সেই অস্ট্রেলিয়া সফরে যেন কল্পনার তরী ভাসিয়ে যত উপায় বের করা যায়, সব উপায়ে বোল্ড হয়েছিলেন তিনি!

     

    ২০১২ সালের মার্চ মাসের ৯ তারিখে বিদায় বলে দিলেন রাহুল দ্রাবিড়। ঘরের মাঠ চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের কোনো এক সম্মেলনকক্ষে। চাইলে দেশের মাটিতে একটা টেস্ট খেলেই বিদায় বলতে পারতেন। কিন্তু রাহুল দ্রাবিড় শুধু একটা টেস্টের জন্য দলে থাকাটা ‘সঠিক’ মনে করেননি!

     

    ভারতের ‘বিদেশের মাটির নায়ক’-এর বিদায় তাই হলো বিদেশের মাটিতেই!

     

    ***

     

    থেমে গেল সকাল সাতটার জিম, থেমে গেল নেট সেশন। তবুও কি তিনি আসবেন না তাঁর পরিচিত মাঠে, নেটে দাঁড়াবেন না একবার নক করতে! এমন প্রশ্নের উত্তরে দ্রাবিড় হেসে বলেছিলেন, হয়ত আসবেন। সবকিছু যখন শান্ত হয়ে যায়, সেই রাতের আঁধারে তিনি আসবেন। অবসরের পর স্ত্রী বলেছিলেন, হয়তো দ্রাবিড় গিটার বাজানো শিখবেন!

     

    তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর দ্রাবিড় আইপিএল খেলেছেন, ভারতের ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ধারাভাষ্য দিয়েছেন।

     

    বিসিসিআই এর এক পালাবদলে সাবেক ক্রিকেটারদের সংশ্লিষ্টতা বেড়েছে এখন। দ্রাবিড়ের সতীর্থদের কেউ হয়েছেন প্রশাসক, কেউবা বোর্ডের পরামর্শক! আর তিনি হয়েছেন কোচ। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ। ভারতের আগামীর তারকাদের কোচ। সামনেই আসছেন বাংলাদেশে, দল নিয়ে। ভারতীয় যুবারা নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারেন! রাহুল দ্রাবিড় নামের মানুষটার এমন সান্নিধ্য পাওয়া কি কম সৌভাগ্যের ব্যাপার!                         

                                

    রাহুল দ্রাবিড়, টেস্ট ক্রিকেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সবচেয়ে বেশী ক্যাচ নেয়া ফিল্ডার,যার বেশীরভাগই নিয়েছিলেন প্রিয় স্লিপ কর্ডনে। সেই সাত বছর বয়সে যখন বাবার হাত ধরে চিন্নাস্বামীতে যেতেন, তখন কি দ্রাবিড় ভেবেছিলেন একদিন এত এত অর্জন থাকবে তাঁর নামের পাশে?

     

    তবে ব্যাটসম্যান বা ফিল্ডার রাহুল দ্রাবিড়ের চেয়েও ব্যাক্তি রাহুল দ্রাবিড়ের অর্জনের পাল্লাটাই হয়তো ভারী! ক্রিকেটের চেতনা যে তিনি ধারণ করেন অহর্নিশ! তিনি যে ক্রিকেট খেলেছেন তাঁর দেশের জন্য! ক্রিকেট খেলতে খেলতেই তিনি তৈরী করেছিলেন এক ‘ওয়াল’। যার অন্যপাশে তিনি ভারতের ক্রিকেটকে আগলে রেখেছিলেন অনেকদিন, সে ‘ওয়াল’ তৈরীতে আবার অবদান ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যাক্তিত্বেরও!

     

    সে ‘ওয়াল’ হয়ত দৃশ্যমান নয়। সে ‘ওয়াল’ হয়তো শুধুই ব্যাট, প্যাড, আর্ম গার্ড আর হেলমেটে তৈরী নয়। তবে এটা নিশ্চিত, এমন ‘ওয়াল’ সবাই তৈরী করতে পারেন না। ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসাটাও বোধহয় দ্রাবিড়ের সেই ‘ওয়াল’-এর মতোই দৃঢ় ছিল।

     

    ক্রিকেটকে যিনি এতোটা ভালবাসেন, কে জানে, তিনি হয়ত রাতের শেষভাগে সত্যিই আসেন চিন্নাস্বামীতে।

     

    নিজের কিটব্যাগটা কাঁধে নিয়ে!